ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

অসচরাচর | অমিতাভ পাল

মুক্তিযুদ্ধের গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫
অসচরাচর | অমিতাভ পাল

             (উৎসর্গ: যারা যুদ্ধের বলি)
নেক অনেক  বছর পরের কথা। কোনো এক বাতাসহীন গম্ভীর সন্ধ্যায় শরীর মনে একটু শীতলতার স্পর্শ পাবার জন্য একদল তরুণ মিলিত হয়েছিল একটা পার্কের কোণায়।

এমনিতে রোজই দলটি কর্মব্যস্ত দিনের শেষে মিলিত হতো এই জায়গাটাতে। প্রতিদিন একই জায়গায় বসতে বসতে একটা বসার স্বত্বও যেন তৈরি হয়েছিল তাদের। নিয়মিতভাবে তাদের নিতম্বের প্রভাব বিস্তারকারী এই উপবেশন আশপাশের অন্যান্য বায়ুসেবীদের তো দূর করে দিয়েছিলই—এমনকি ঘাসও আর ওই জায়গায় গজাতে সাহস পেত না। সাদা থান পরা বিধবার মতো সেই জায়গাটা যেন ঘাস স্বামীর সোহাগ রসে বঞ্চিত ছিল। সমস্ত পার্কটার সবুজ শ্যামল নারীসুলভ সৌন্দর্যের মধ্যে এর ফলে জায়গাটা হয়ে উঠেছিল দৃষ্টিকটু কেউ।

কিন্তু এসব বিষয়ে উপবেশনকারী দলটির বিন্দুমাত্র সচেতনতা নেই। তারা বসে এবং পরস্পরের সঙ্গে গল্পের মাধ্যমে সন্ধ্যাটা কাটায়—তাদের বাস্তবায়নকৃত প্রকল্পের এটাই ছিল লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং ভবিষ্যত। গল্পের সেই বালকদের ক্রীড়া যে ব্যাঙদের মৃত্যুর কারণ—এই ছেঁদো নীতিকথায় আপ্লুত হয়ে তারা তাদের দিবসের শেষ অংশটুকুকে ব্যর্থ হতে দিতে নারাজ। বরং মৃত্যুবরণকারী ব্যাঙগুলি যেন এই ক্রীড়াক্ষেত্র এড়িয়ে চলে—চাঁদমারির আশেপাশের গ্রামগুলি যেইভাবে সতর্কতার সাথে এড়িয়ে থাকে ঘনিষ্টতাজনিত দুর্ঘটনা—বড়জোর এইটুকু উপদেশভরা মুহূর্ত তারা দান করতে পারে নিজেদের সময় মূলধন থেকে। ভবি যদি এতে ভোলে তো ভালো—নইলে নিজেরাই ভুলে থাকবে ভবির কথা।



মানুষ হিসাবে মোটামুটি ধূর্ত আর সাহসী ছিলাম বলেই হয়ত আমার কোম্পানির কমান্ডার সেতুটা উড়িয়ে দেবার ভার দিয়েছিলেন আমার ওপর। পুরাটা ভারই ছিল আমার কাঁধে। অর্থাৎ ক্যাম্প থেকে বোমা বহন করে সেতুর কাছে নিয়ে যাওয়া, সেতুর দুর্বল জায়গাগুলিতে বোমা বসানো এবং তার বিস্ফোরণ ঘটাতে বোতামে চাপ দেওয়া—সমুদয় কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে সম্পন্ন করার পর সাফল্যের খবরটাকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল আমাকে



এই সন্ধ্যাটিতেও নিজেদের দর্শনচিন্তার সুস্থ প্রতিফলন ঘটিয়ে দলের সভ্যরা যখন আলাপ আলোচনার এভারেস্টের কাছাকাছি পৌছে গেছে—ঠিক তখনই ঘটল একটা অসচরাচর ঘটনা। দেখা গেল একটি মধ্যবয়স্ক লোক তাদের পাশ ঘেঁষে বসে পড়ল আমন্ত্রণ, উপেক্ষা জাতীয় শব্দগুলিকে কোনোরকম প্রাধান্য না দিয়ে। ব্যাপারটিতে একটু হকচকিয়ে গেল দলটা। তাদের ব্যক্তিগত মাথাগুলিতে খেলে গেল বিচিত্র সব ভাবনা। কেউ ভাবল তাদেরই কারো পরিবারের সূত্র ধরে মধ্যবয়স্কের আগমন ঘটেছে। কেউ ভাবলো শ্রান্ত—কোনো অচেনা পথিকের শান্তি অন্বেষণই এর হেতু। কেউ ভাবল লোকটা পাগল। আর কেউ ভাবল অন্যরাই ব্যাটাকে নিয়ে ভাবুক।

ততক্ষণে তাদের আড্ডা থেমে গিয়েছিল। আর মস্তিস্ক যেহেতু ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল ভাবনার কাজে তাই বাক্য বর্ষণের ক্ষেত্রে তার ইশারা ইঙ্গিত না পেয়ে জিহবাগুলি থাকল চুপ করে। নিশ্চুপতার এই অবসরে দেখা গেল আগন্তুক তার বসে পড়ার ঘটনাটিকে একটা স্থায়ীরূপ দিচ্ছে। যেমন কাঁধের ব্যাগটিকে পাশে নামিয়ে রেখে পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে সে শুরু করল মুখ ঘাড় মোছার কাজ—যা সচরাচর পরিশ্রান্ত ব্যক্তিরা গন্তব্যে পৌঁছানোর পরেই করে থাকে এবং পিপাসার কথা মনে পড়ে যাওয়ায় একগ্লাস জল চেয়ে খায়।

লোকটি অবশ্য পিপাসার জল চাইল না, তবে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরিয়ে যখন সে সেটাতে লাগাল কষে একটা টান—মনে হলো প্রচণ্ড তৃষ্ণার পর এক গ্লাস জলই সে খাচ্ছে। তারপর সে শুরু করল ধোঁয়া ছাড়তে এবং উদগিরিত ধোঁয়ার ফাঁকফোকড় দিয়ে তাকিয়ে দেখতে শুরু করল দলের ছেলেপিলেগুলিকে। তারা তখন হতাশ ও হতভম্ভ, নিশ্চুপ ও নীরব।

‘আপনারা গল্প করছিলেন বুঝি?’ ধোঁয়া ছাড়া শেষ হলে লোকটা জানতে চাইল দলটার কাছে। কিন্তু অধিক শোকে পাথরের দল তখনও ভাঙচুরের পর মৃত্তিকার নিকটবর্তী হতে পারেনি। তবে বিচূর্ণভবনের প্রাথমিক কাজটা শুরু হয়েছে তাদের ভিতরে। লোকটার অকস্মাৎ উপবেশনের ফলে যে উষ্ণতা জন্মেছিল তাদের মনে চোয়ালে—লোকটার বেহায়াপনাতে সেই উষ্ণতা আরো বেড়ে গিয়ে বিষ্ণুব অঞ্চলের তাপমাত্রার মতো ছড়িয়ে পড়েছিল পেশীতে হাড়ে। কিন্তু সন্ধ্যার মৃদুমন্দ বাতাসেই হোক বা তারুণ্যের ক্ষমাধর্মীতার জন্য—একটা তিব্বতী আবহাওয়ার ছড়িয়ে পড়াকে স্পষ্টই উপলব্ধি করতে পারছিল তারা।

সেই আবহাওয়ার ভৌগলিক গুনে শেষ পর্যন্ত চূর্ণবিচূর্ণ হলো দলের শোক ও স্তব্ধতা। প্রায় সাথেসাথেই তালা খুলে মুখের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো জিহবা আর জিহবার ঘাড়ে সওয়ার হয়ে একদল শব্দের বাক্স প্যাটরা। মুহূর্তেই পার্কের সেই কোণাটা পরিণত হলো সদ্য ট্রেন আসার পরে জমজমাট একটা প্লাটফর্মে।

শব্দসঙ্কুল সেই পরিস্থিতির জন্ম হওয়াতে আগন্তুককে মনে হলো খুশিই হয়েছে। ধা ধা করে তার দিকে ধেয়ে আসা অবিরল বাক্যের আঘাতে একটা নিস্তরঙ্গ পুকুরে ঢেউ জাগার আনন্দ অনুভব করল সে। তারপর প্রশংসাসূচক ভঙ্গিতে দলটার দিকে ছুঁড়ে দিল আপনাদের তো বেশ প্রাণশক্তি আছে—নামক বাক্যটি। এই বাক্যের নিমিত্ত ছিল অফুরন্ত গালাগালির নহর।

প্রাণশক্তির প্রশংসায় সেই নহর যেন হঠাৎই খেই হারিয়ে ফেলল। প্লাটফর্ম থেকে চলে গেল ট্রেন। আর সেই শান্তিপূর্ণ কোলাহলহীন পরিবেশে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলে লোকটা বলে উঠল, ‘প্রতিদিনই তো আপনারা নিজেদের কথাবার্তা শোনেন। বিশেষ কোনো ঘটনা না ঘটলে ব্যাপারটা মূলত একঘেয়ে। কাহাতক আর একই গল্প শোনা এবং বলা যায়? আজ বরং আমি আপনাদের একটা গল্প বলি। একটু নতুন কিছুর স্বাদ হয়ত এতে আপনারা পাবেন। ’

এইরকম একটি প্রস্তাব শুনলে পৃথিবীর সকল শ্রোতাই নড়েচড়ে গ্যাট হয়ে বসে। দলটাও তাই করল—তবে মনে মনে। প্রকাশ্যে এইরকম কিছু করাকে নিজেদের দুর্বলতা বলেই মনে করে তারা। ভাবে, এটা গ্রামের লোকদের কাজ। তবে মনে মনে যাই কিছু করুক না কেন—তাতে অন্তত চৌকশ ভাবটা ঠিকই বজায় থাকে। ফলে মনে মনে অনেক কিছু করার একটা অভ্যাস দলের সদস্যদের তো আছেই, এই পার্কটা যে শহরে অবস্থিত—সেই শহরের অধিবাসীরাও এই ব্যাপারে অভ্যস্ত। অধিবাসীরা সকলেই দলটির সভ্যদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা প্রতিবেশী হয়।

‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা’। লোকটার বাক্যটা শেষ হওয়ার সাথেসাথেই চনমনে একটা বিকাল যেন অমোঘ বৃষ্টিতে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে গেল। ঝটপট অন্ধকার নেমে এলো চারপাশে। মনে মনে নড়েচড়ে বসা দলীয় সভ্যদের মনে হলো তারা অনেকদিন যাবৎ একই জায়গায় একটুও না নড়ে বসে আছে। মনে হলো তারা অযত্নে মলিন একটা প্রাচীন বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। মানসিক এই অনুভূতি তাদেরকে আরো নিস্পৃহ করে দিল। তাদের মুখগুলি হয়ে পড়ল উৎসাহহীন—রঙের দিক থেকে আরেকটু কালো।

এই সমস্ত ব্যাপারই ঘটল বয়স্ক লোকটা মুক্তিযোদ্ধা শব্দটা উচ্চারণ করার ফলে। এই শব্দটা গত পঁচিশ বছর ধরে এত জায়গায় এত জনের মুখে এত বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়েছে যে এখন আর শব্দটির মধ্যে কোনো কৌতূহল অবশিষ্ট নেই। শব্দ হিসাবেও যে চারটি বর্ণে তারা গঠিত—সেই বর্ণগুলি যেন কয়েক বছর বিবাহিত জীবন কাটানো কোন মহিলা—যার প্রতি অভ্যাস ছাড়া তার স্বামীর আর কোনো প্রেমের স্পৃহা নেই। এখন এইরকম ঘেঁয়ো রোগগ্রস্ত রাস্তার কুকুরের মতো একটা শব্দ যখন উচ্চারণ করল লোকটা—দলের তরুণদের নাক গেল কুঁচকে।   ঘেঁয়ো কুকুরের গন্ধ আর কেইবা সহ্য করতে পারে। ফলে যে গালাগালির নহর প্রাণশক্তির প্রশংসায় লজ্জা পেয়ে বদ্ধ জলাধারে পরিণত হয়েছিল—সে আবার স্বতঃশ্চল হয়ে উঠল।

এবার লোকটা বৃষ্টির সময় নীরব হয়ে পড়া একটা গাছের মতো নত হয়ে সহ্য করল সব। একটা মেঘভরা আকাশ বৃষ্টির পরে যেহেতু নিঃস্ব হয়ে যায়—এই দলটিও সেইরকম গ্লানি বিসর্জনের পরে তাই হয়ে যাবে—এটাই তার আশা। যুক্তিপূর্ণ এই আশা অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই মূর্ত হতে শুরু করল—মেঘলা দিনের অলিতে গলিতে দেখা দিতে শুরু করল আলোর আভা। দলের তরুণদের কারো কারো মনে পড়তে শুরু করল মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত পারিবারিক স্মৃতি। কেউ কেউ নিজেদের আত্মীয়স্বজনের বীরত্বপূর্ণ রণকৌশল বর্ণনা করতে শুরু করল আবেগের অনিয়ন্ত্রিত রং ব্যবহারের মাধ্যমে। আর কেউ নিজেকেই কল্পনা করল কোনো এক ভয়াল রণাঙ্গণের সম্মুখে দাঁড়িয়ে অজস্র শত্রুসৈন্য ভূপাতিত করা এক বীর সেনানায়কের ভূমিকায়। সত্যতথ্যের খড়বাঁশের ওপর তাদের কল্পনার রং-মাটি যুক্ত হতে শুরু করল এক নবীন আনন্দে। এই আনন্দ জন্মেছিল কিছুক্ষণ আগে দলটির সবাই মিলে টানা কয়েকটি গাঁজা ভরা সিগারেটের প্রেরণায়।

মুক্তিযুদ্ধ যখন কল্পনার সবটুকু জমি দখল করে নিয়েছে দলটির—যখন তাদের বর্তমান প্রতিস্থাপিত হয়েছে একটা অতীতের হাতে এবং এর ফলে বিবর্ণ বহু ব্যবহৃত মুক্তিযুদ্ধ শব্দটিও ফিরে পেয়েছে তার যৌবনের উজ্জ্বলতার রূপ—লোকটি তখন অনুভব করল আকাশের সবটুকু মেঘ কেটে গেছে। আলোতে আর নীলে পরিপূর্ণ এই আকাশে এখন আবার সে ওড়াতে পারে গল্পের ঘুড়ি। এবার আর তার ব্যর্থ হবার কোনো সম্ভাবনা নেই—স্থলভাগের মানুষ ঘাড় উঁচিয়ে তাকাবেই এই উড়ন্ত ঘুড়ির দিকে। পার্থিব মনোযোগ খণ্ডিত হবে মহাশূন্যের বিপুলতায়।

গলা খাঁকড়ানোর শব্দ দিয়ে লোকটি তরুণদের মনোযোগ ফিরিয়ে আনল তার দিকে। ‘আমার ঘটনাটা কতটুকু বীরত্বপূর্ণ জানি না—তবে আমার নিজের কাছে এর গুরুত্ব অসীম। ঘটনাটা ঘটেছিল মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার মাসখানেক আগে যখন পাকিস্তানি সৈন্যদের যোগযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়ে আমরা তাদের কোনঠাঁসা করতে চাইছিলাম। আমার ওপর দায়িত্ব ছিল একটা সেতু উড়ানোর। এই সেতুটা ধ্বংস করতে পারলে শত্রুসৈন্যের একটা বিরাট দল আটকা পড়ত এমন একটা জায়গায়—সেখান থেকে তাদের পক্ষে সক্রিয় হওয়া সম্ভব হতো না কোনোভাবেই। বরং নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে হয় আত্মসর্ম্পন না হয় মৃত্যু—এই দুই বিকল্পের কোনো একটাকে বেছে নিতে বাধ্য হতে হতো তাদের।

মানুষ হিসাবে মোটামুটি ধূর্ত আর সাহসী ছিলাম বলেই হয়ত আমার কোম্পানির কমান্ডার সেতুটা উড়িয়ে দেবার ভার দিয়েছিলেন আমার ওপর। পুরাটা ভারই ছিল আমার কাঁধে। অর্থাৎ ক্যাম্প থেকে বোমা বহন করে সেতুর কাছে নিয়ে যাওয়া, সেতুর দুর্বল জায়গাগুলিতে বোমা বসানো এবং তার বিস্ফোরণ ঘটাতে বোতামে চাপ দেওয়া—সমুদয় কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে সম্পন্ন করার পর সাফল্যের খবরটাকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল আমাকে।

সেতুটা ছিল একটা মফস্বল শহর থেকে বেরুবার মুখে। সেই শহরেই ঘাঁটি গেড়েছিল পাকিস্তানিরা। কৌশলগতভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল শহরটার অবস্থান। তার দুইপাশে ছিল সীমান্ত ও রাজধানী। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা—যারা সীমান্তের ওপারে প্রশিক্ষিত হয়ে দেশে ঢুকতে চাইত, তাদের জন্য শহরটা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। এদিকে মূলভূখণ্ডের সঙ্গে সেই সেতুটাই ছিল শহরের একমাত্র যোগাযোগ। দ্বীপের মতো শহরটা প্রধান রাস্তার ঠিক পাশেই গুটিসুটি মেরে বসে থাকত একটা বয়স্ক লোকের মতো।

সেতুটা উড়াবার কাজে আমি মনোনীত হবার পরই বিস্ফোরক দ্রব্য বহন ও স্থাপন  বিষয়ে একটা সাতদিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় আমাকে। দায়িত্বটা আমাকে বেশ কিছুটা উজ্জীবিত করেছিল বলেই বোধ হয় প্রশিক্ষণে চমৎকার দক্ষতা প্রদর্শন করলাম। আমার প্রশিক্ষক ছিলেন একজন ভারতীয় সমরবিদ। একদিন কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেই ফেললেন চাকরি জীবনে আমার মতো ছাত্র পাননি। অবশ্য সেই সঙ্গে এটাও তিনি বলেছিলেন যে চাকরি করতে আসা কোনো সৈনিকের পক্ষে আমার মতো দ্রুত সবকিছু আয়ত্ত করা একেবারেই অসম্ভব। আমি নাকি পেরেছি আমার দেশপ্রেমের প্রেরণায়।

এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে দেশপ্রেম আমাকে যতটা প্রেরণা জুগিয়েছিল তার চেয়ে বেশি প্রেরণা বোধ হয় দিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর নির্মিত হলিউডের সিনেমাগুলি। এইসব সিনেমায় প্রচারিত নায়কদের অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন ও পরিশেষে সুন্দরী রমণীদের সঙ্গে রোমান্টিক জীবন শুরু করার ঘটনাগুলি আমাকেও ভাবাত যে একটা যুদ্ধ পেলেই হয়। তখন আমিও দেখাব বীরত্ব কাকে বলে। সেই সাথে আমার ডালসিনিয়া দেল টোবোসোকে কব্জা করবার জন্যও এই বীরত্বটুকুর প্রয়োজন ছিল। মুক্তিযুদ্ধেরও। ’

এই পর্যন্ত বলে লোকটি একটা সিগারেট ধরাবার জন্য গল্পটাকে থামাল। তরুণ শ্রোতার দল—যারা এতক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে শুনছিল লোকটার কথা—তারাও একটু নড়েচড়ে ভেঙে নিল স্থবিরতার পাতলা আস্তরণ। কেউ একটা সিগারেট ধরাল। কেউ সেটাকে বুক করে ফেলল সাথে সাথেই। একজন উঠে গেল প্রশ্রাব করার জন্য এবং যাবার আগে শাসিয়ে গেল সে আসার আগে যেন গল্প শুরু না হয়।

গল্প থামার এই অবসরে লোকটা নীরবে বসে সিগারেট টানছিল। একটা গভীর আত্মমগ্নতার ছায়া পড়েছিল তার অবসরে। স্মৃতির কুয়ায় একটা বালতির মতো নেমে গিয়ে সে যেন তুলে আনছিল অবশিষ্ট গল্পের জল। তার সেই তন্ময়তার এমন একটা বৈশিষ্ট ছিল যে, কেউ আর সেটাকে ভাঙতে চাইছিল না। লোকটা নিজেই যেন প্রয়োজনীয় মুহূর্তে জেগে উঠবে—একটা তীব্র হুইসল দিয়ে আবার চলতে শুরু করবে ট্রেন- এটাকেই সবাই মনে করেছিল পরিণতি। ফলে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া যাত্রীদের মতো তারা অপেক্ষা করছিল গার্ডের পতাকা সংকেতের। অসমাপ্ত গল্পটার ছড়িয়ে পড়া কৌতূহলের কল্যাণে সবার চোখেই ভাসছিল একটা অচেনা সেতু—যে প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে ধরা দিয়েছিল সেই ব্যক্তির চেনা কোনো সেতুর আদলে।

অবশেষে সিগারেটে শেষ একটা টান দিয়ে লোকটা আবার গল্প বলা শুরু করল। শ্রোতারাও তাদের ব্যক্তিগত কল্পনা থেকে ফিরে এলো গল্পের বাস্তবতায়। এতক্ষণ ধরে খোসা ছাড়িয়ে বের করে আনা গল্পের নারকেলটিকে এইবার যেন ভাঙবে লোকটা। তার ভিতরের সুমিষ্ট জল আর নরম নারকেলের স্বাদ পাবার জন্য অধীর হয়ে উঠল চারপাশ।

‘প্রশিক্ষণ শেষ হবার পরে ভারতীয় উপদেষ্টাসহ কোম্পানি কমান্ডার আমাকে নিয়ে বসলেন সেতু উড়িয়ে দেবার তারিখ ঠিক করতে। আমি তখন প্রশিক্ষণের ফল হাতেনাতে প্রমাণ করার জন্য এতটাই অধীর যে একবিন্দু তর সইছিল না। মনে হচ্ছিল এখনই বেরিয়ে পড়ি। তারপর দৌড়ে গিয়ে সেতুটার ওপর বোমাটা পেতেই ওটাকে উড়িযে দেই। কিন্তু কোম্পানি কমান্ডার আর ভারতী উপদেষ্টার যেন কোনো তাড়া নেই। সেতুর অবস্থান নির্নায়ক মানচিত্রটাকে নিয়ে সেই যে তারা হুমড়ি খেয়ে পড়লেন—আমার বিরক্তির শেষ বিকালের আগে তাদের আর উঠতে দেখা গেল না। পরিশেষে আমি বাধ্য হলাম তাদের দ্রুতগামিতা নিশ্চিত করতে। ঘনঘন প্রসঙ্গ পাল্টানোর কৌশল দিয়ে সম্পন্ন করতে চাইলাম আমার উদ্দেশ্যটাকে। তারাও ব্যাপারটাতে সায় দিলেন কেননা এতক্ষণে তাদের ভিতরকার চিরাচরিত সাধারণ মানুষটাও বিরক্ত হয়ে উঠেছে।

অবশেষে শুরু হলো পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ। অবস্থানজনিত কারণে কখন সেতুটার কাছে যেতে হবে, কতক্ষণ সেখানে থাকা যাবে, কখন বিস্ফোরক বসাব আর কখন তার বোতাম টিপব—সব কিছুই চূড়ান্ত করা হলো নিরাপত্তাকে প্রথম প্রাধান্য দিয়ে। তবে যে কোনো মূল্যে সেতুটাকে উড়াতে হবে—এটাই ছিল শেষ সিদ্ধান্ত।

ঠিক হলো তিনদিন পর এক দুপুরবেলায় আমি রওনা হব বোঁচকা বুঁচকি নিয়ে। সন্ধ্যা নাগাদ সেতুটার কাছে পৌঁছে তারপর অন্ধকার হবার জন্য অপেক্ষা করব রাত আটটা পর্যন্ত। নয়টায় শেষ হবে বোমা বসানোর কাজ। তারপর নিজের পলায়নের পথটি ঠিকঠাক রেখে ঠিক দশটায় টিপে দেব বোমা ফাটানোর বোতাম। ঠিক হয়েছে, বিস্ফোরকজনিত বিশৃঙ্খলাই আমার পালানোকে নিশ্চিত করার সুযোগ হিসাবে ব্যবহৃত হবে। ’

গল্পের শেষ এবং রোমাঞ্চকর অধ্যায়টি শুরুর এই মুহূর্তে আরেকবার গল্প বলা থামাল লোকটা। যেন টারমার্কের শেষ মাথায় এসে দাঁড়িয়েছে একটা বিমান। এখন গতি বাড়িয়ে একটা প্রচণ্ড দৌড় এবং সবশেষে একটা অতিকায় লাফ দিয়ে আকাশে পৌঁছে যাওয়ার কাজ। লোকটিও মনে হলো এইরকমই একটা প্রস্তুতি নিচ্ছে। দলের তরুণরাও এখন সিটবেল্ট বাঁধা যাত্রীদের মতো সতর্ক ও উদগ্রীব। নিজেদেরকে তারা এই গল্পের পরিশেষে নিয়ে যেতে চায় কিন্তু লোকটার থেমে থাকাটা যেন আর শেষ হচ্ছিল না। পরিকল্পনার তিন দিনের মতোই যেন দীর্ঘ ছিল তা।

‘তিন দিন পরে আমি রওনা হলাম সেতুর উদ্দেশ্যে। একজন সাধারণ গ্রামবাসীর ছদ্মবেশে ওই এলাকায় যেতে চাওয়া আরো কয়েকজনের দলে ভিড়ে গেলাম আত্মপরিচয়কে বিপদে না ফেলতে। দলটির লোকেরাও জানত না আমার প্রকৃত পরিচয়। এটা আমার এবং তাদের নিরাপত্তার জন্যই প্রয়োজন ছিল। আমার ভ্রমণসঙ্গীরা জানত অসুস্থতার খবর পেয়ে এক নিকটাত্মীয়কে দেখতে যাচ্ছি সাথে কিছু খাবারদাবার নিয়ে। বোমা বানানোর আগ পর্যন্ত আমার বহন করা জিনিসগুলি ছিল ইটের টুকরার মতোই বৈশিষ্টহীন। ফলে সঙ্গের পোটলাটার ব্যাপারে অতিমাত্রায় সতর্ক থাকতে হচ্ছিল না আমাকে। কেবল একটা ব্যাপারে খেয়াল রাখছিলাম—খাবারের লোভে কেউ যেন পোটলার মুখ না খোলে।

সন্ধ্যার মুখে সেতুটার কাছে গিয়ে পৌঁছালো আমাদের দলটা। এখন বড় রাস্তা ছেড়ে সেতু পেরিয়ে ঢুকতে হবে শহরে। সেতুটার শহরের দিকের প্রান্তে পাকিস্তানিদের একটা চেকপোস্ট ছিল। শহরে প্রবেশ করতে চাওয়া প্রতিটি ব্যক্তিকে ঐ চেকপোস্টে গিয়ে নিজের আত্মপরিচয় উম্মোচন করতে হতো। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে চেকিংয়ের ব্যাপারে পাকিস্তানিরা খুব একটা সতর্ক ছিল না। কিন্তু যতই তাদের পরাজয়ের সম্ভাবনা বাড়ছিল, যুদ্ধের শেষ পর্যায়ের সেই সময়গুলিতে ততই তাদের চেকিং হচ্ছিল কঠোর থেকে কঠোরতর। শহরে ঢুকতে কিম্বা বের হতে গেলে প্রায় নগ্ন করে চেক করা হচ্ছিল প্রতিটি নাগরিককে। দুইটি উদ্দেশ্যে এটা করা হতো—প্রথমত পাকিস্তানিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং দ্বিতীয়ত লৈঙ্গিক পরীক্ষার মাধ্যমে হিন্দু বাঙ্গালিকে সনাক্ত করতে। পাকিস্তানি সৈন্যরা এটা ভালোভাবেই বিশ্বাস করত যে, মুসলমান বাঙালিরা আসলে যুদ্ধফুদ্ধ চায় না। পাকিস্তান ভেঙে যাক এটা তারা স্বপ্নেও ভাবে না। কিন্তু ভারত চায় পাকিস্তান দুর্বল হয়ে পড়ুক। এ দেশে থাকা বাঙালি হিন্দুরা তাদেরই স্থানীয় এজেন্ট। সমস্ত অন্তর্ঘাত এই হিন্দুরাই চালাচ্ছে আর দিকভ্রান্ত করতে চাইছে তাদের মুসলমান প্রতিবেশীদের। গভীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের জটিল ভাবনা সাধারণত সৈন্যদের মগজ ধারণ করতে পারে না। ফলে ওই বিশ্বাসটা জনপ্রিয়তা পাচ্ছিল দ্রুতগতিতে। আর জনপ্রিয়তা যতই তীব্রতর হচ্ছিল—হিন্দু বাঙালিরা ততই শোচনীয়ভাবে আক্রান্ত হচ্ছিল। ছদ্মবেশ ধরেও তারা রক্ষা পাচ্ছিল না কেননা কলেমা হয়ত মুখস্ত করা যায় কিন্তু পুরুষাঙ্গের পরিবর্তন সাধন করা হঠাৎ করে সম্ভব হয় না। পাকিস্তানিরা ঠিক এই বৈশিষ্টটাকেই সনাক্তকরণের প্রধান চিহ্ন হিসাবে ধরত।

দিনের শেষ আলোতে আমাকে সেতুর এপারে রেখেই আমাদের দলের বাকি সদস্যরা সেতু অতিক্রম করে এগিয়ে গেল শহরের দিকে। আমি থেকে গেলাম আমার ভবিষ্যত কর্ম সম্পাদনের প্রয়োজনে। সৈন্যরা যেন আমাকে দেখতে না পায়—সেইজন্য আগে ভাগেই নিজেকে লুকিয়ে ফেললাম পারের ঝোপঝাড়ের মধ্যে। তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে থাকলাম সঙ্গীদের সেতু পার হওয়ার দৃশ্য। এখন আমার অফুরন্ত অবসর।

সেতুর ওই প্রান্তে সঙ্গীরা পৌঁছাতেই একটা রাগী গলার ধমক শোনা গেল। তাকিয়ে দেখলাম সঙ্গীরা দাঁড়িয়ে পড়েছে। এত দূর থেকেও স্পষ্ট বুঝতে পারলাম তারা ভয় পেয়েছে। জড়োসড় হয়ে পরস্পরের সঙ্গে সেঁটে রয়েছে প্রত্যেকে। এই সময় রাগী গলার আওয়াজটা দ্বিতীয়বার শোনা গেল। এবার তা যেন আরো হিংস্র, আরো আক্রোশে ভরা। আমার সমস্ত শরীর রী রী করে উঠল শব্দটার ধাতব আওয়াজে। সেই সঙ্গে একটা আতঙ্কও যেন বোধ করলাম মনের গভীরে। কিছুক্ষণ পরেই সেই আতঙ্ক ঘাম হয়ে বেরিয়ে এলো লোমকূপ দিয়ে। আমি প্রায় ভিজে গেলাম। ইচ্ছা হলো দৌড়ে পালিয়ে যাই দূরে কোথাও। এইসব সেতু উড়ানো ফুরানো আমাকে দিয়ে হবে না।

ঠিক তখনই একটা শীতল বাতাসের ঝাঁপটা এসে জড়িয়ে ধরল আমাকে। একটু যেন শান্ত হলো আতঙ্কিত আত্মা। আর এর ফলেই চোখ ঘুরিয়ে তাকাতে পারলাম সঙ্গীদের দিকে। কিন্তু সেই দিকে তাকিয়েই চোখটা যেন একটু থমকে গেল। স্পষ্ট দেখলাম সঙ্গীরা কেউ ওই জায়গায় নেই। সাথে সাথে চোখ ঘুরিয়ে তাকালাম শহরের দিকে। মনে হলো তাদের দলবদ্ধ হেঁটে যাবার দৃশ্যটা দেখতে পাব। চেকপোস্ট অতিক্রম করে তাদের নিরাপদে শহরে প্রবেশ আমার মনেও একটা নিরাপত্তার জন্ম দেবে—এইটুকু আশা অবচেতনের কোথাও প্রোথিত ছিল।

কিন্তু খাঁ খাঁ করে উঠল চারদিক। সেতুর এপাশ থেকে রাস্তাসহ শহরের যতটুকু অংশ চোখে পড়ে—তার কোথাও কোনো মানুষজনের চিহ্ন নেই। যেন এখানে একটা মরুভূমি পড়ে আছে যার দিগন্ত বিস্তৃত আয়তনে শূন্যতাই প্রধান অভিবাসী। ভাবলাম তাহলে কি এখনো লোকগুলিকে চেক করছে সৈন্যরা? নাকি তাদের কাছে সন্দেহজনক কিছু পেয়ে যাবার ফলে তাদেরকে আটকে রেখেছে ওরা। কিন্তু আমি যতদূর জানি—সন্দেহজনক কিছু তো নেই ওদের সঙ্গে। নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের কিছু জিনিসপত্র ছাড়া আর কিছুই সঙ্গে আনেনি। তবে হ্যাঁ, ওদের সঙ্গে একটা জিনিস ছিল যা খুবই সন্দেহজনক। কিন্তু সেটা তো ওরা সেতুর এপারে রেখে গেছে। ফলে সৈন্যদেরও ওটা জানার কথা না।

সন্দেহজনক সেই জিনিসটা হলাম আমি। নিজের কথা ভাবতে গিয়ে আতঙ্কে সারা শরীর শিউরে উঠল আমার। তাহলে কি আমাদের দলের ভিতরে কোনো গুপ্তচর ছিল, যে কোনোভাবে টের পেয়েছে আমার পরিচয়? কথাটা মাথায় আসতেই পালাতে ইচ্ছা করল আমার। মনে হলো আমার পেছনেই বোধহয় নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে একদল সৈন্য। অপ্রস্তুত আমাকে দেখে তারা দাঁত বের করে হাসছে। তাদের রাইফেল স্থির চোখে তাকিয়ে আছে আমার হৃদপিণ্ডের দিকে। আর এক মুহূর্ত পরেই ঝাঁকঝাঁক গুলি এসে পেড়ে ফেলবে আমাকে। অচেনা এই প্রান্তরে একটা অজানা ঘাসের মতো পড়ে থাকব আমি। আমার ডালসিনিয়া দেল টোবোসো জানতেও পারবে না তার ডন কুইকজোট হারিয়ে গেছে এই পৃথিবীর জীবন সমুদ্র থেকে।

ঠিক তখনি একদল কাকের মতো কর্কশ কালো শব্দে ডেকে উঠল কয়েকটা বন্দুক। সীমাহীন প্রতিধ্বনিতে ভরা সেই শব্দে কাপ পিরিচের মতো ভেঙে গেল নিস্তব্ধতা। আমার মনে হলো যা ভেবেছি—ঠিক তাই ঘটেছে। চোখ বন্ধ করে সাথে সাথেই মাটিতে পড়ে গেলাম আমি। অনুভব করতে চাইলাম একটা তীব্র বেদনাকে যা উষ্ণ রক্তের মোড়কে আবৃত। বুকে হাত দিয়ে অনুভব করতে চাইলাম সেই তরল রক্তের ফিনকি। কিন্তু কিছুই অনূভূত হলো না। এমনকি একবিন্দু বেদনাও আবিষ্কৃত হলো না শরীর প্রান্তরে। ফলে চোখ মেলে তাকিয়ে নজর দিয়ে বুঝতে চাইলাম ঘটনার সত্যতাকে। দেখলাম আমি আহত হইনি। আমাকে ঘায়েল না করেই গুলি উড়ে গেছে দেশান্তরী পাখিদের মতো অন্য কোনো জলাশয়ের খোঁজে।

আমার আহত না হওয়াটা বরং আমাকে সচেতন করে তুলল গুলির ব্যাপারে। কেন তারা নির্গত হলো বন্দুক থেকে, কোন অভিযান তাদের টেনে নিয়ে গেল এবং কোন দিকে গেল তারা—এই বিষয়গুলি জানার জন্য ছটফট করে উঠল আমার কৌতূহল। ফলে শুয়ে পড়া থেকে উঠে বসলাম এবং ঝোপের ভিতর থেকে ঘাড় তুলে তাকালাম মিলিটারি ক্যাম্পের দিকে। সেখানে যেন একটা মৃদু উত্তেজনার জন্ম হয়েছে। দ্রুত পায়ে হাঁটাহাটি করছে কয়েকজন সেপাই। আর একজন দাঁড়িয়ে হাঁকডাক করছে। আমি তাড়াতাড়ি তাদের পায়ের কাছের মাটির দিকে তাকালাম। আমাদের দলের কারো মৃতদেহ সেখানে পড়ে আছে কিনা—সেটা দেখাই ছিল আমার উদ্দেশ্যে। আমার মনে হচ্ছিল কিছুক্ষণ আগের ওই গুলি হয়ত আমার দলসঙ্গীদের উদ্দেশ্যে বর্ষিত হয়েছে। ফলে লাশ দেখার একটা অবচেতন আকুতি শুরুতেই আমাকে প্রভাবিত করল।

ঠিক এই সময় ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো দুইজন সৈনিক। তারা একটি দেহকে বহন করছিল। বেরিয়ে এসেই সৈনিক দুইজন সেই দেহটাকে সেতুর নিচের খালের জলে ফেলে দিল। তারপর তারা ফিরে গেল ঘরে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আরেকটি মৃতদেহকে এনে ঠিক একইভাবে খালের জলে ফেলল। এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল সাতবার। দেহের সংখ্যাটা বারবার আমাকে কী যেন মনে করিয়ে দিতে চাইছিল কিন্তু উত্তেজনা আমার স্মৃতিকে নিশ্চেষ্ট করে রাখার ফলে ব্যাপারটা ধরতে পারলাম না।

‘খালের জলে ফেলে দেওয়া মৃতদেহগুলি ভেসে আসছিল আমার দিকেই। প্রথম যে দেহটিকে ফেলা হয়েছিল, এতক্ষণে দেখলাম সেটা ভেসে এসে ঠেকেছে খালের এই পারে। উপুড় হয়ে ভেসে থাকা সেই দেহটার পোশাক দেখেই চমকে উঠলাম আমি। আরে! এটা তো আমাদের দলের সেই প্রবীণ লোকটার জামা। সাথে সাথেই সাত সংখ্যাটার তাৎপর্য স্পষ্ট হয়ে উঠল আমার কাছে। আমি ছাড়া আমাদের দলে এই ক’জন লোকই ছিল। যদিও এতক্ষণ ধরে আমি সঙ্গীদের মৃত্যুর কথাই ভাবছিলাম কিন্তু চাক্ষুষ কোনো নজির না থাকায় তাদের বেঁচে থাকার ক্ষীণ হলেও একটা সম্ভাবনা ছিল। এবার মৃতদেহগুলি দেখার পর আমার হৃদয় যেন অবশ হয়ে এলো। জেনে ফেলা সত্যের মতো ভেসে ভেসে এগিয়ে আসতে থাকা সাতটি মৃতদেহ আমাকে স্তব্ধ করে দিল শোকে। অর্থহীন হয়ে গেল বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোদুল্যমানতা।

আচ্ছা এদেরকে কি শহীদ বলা যায়? না এরা একটা সংঘটিত যুদ্ধের বলি?’ বিষাদ মাখা গলায় লোকটা প্রশ্ন করল শ্রোতাদের। এতক্ষণ কেবল কান দিয়ে ভূমিকা পালন করে যাওয়া তরুণ শ্রোতার দল প্রশ্নের প্রথম ধাক্কাতে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল যদিও, কিন্তু তারপরই তারা মেতে উঠল শহীদ ও বলি নির্ণয়ের তর্কে। তাদের উত্তেজিত কথাবার্তার ভিড়ে মুক্তিযোদ্ধা লোকটা একদম নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল বহু দূরের একটা তারার মতো। তার মিটমিটে প্রায় না দেখা অনুজ্জ্বল আলো কোনো প্রভাবই বিস্তার করতে পারল না উজ্জ্বল তারাগুলির শব্দময় আলোর জনসভায়। একটা ব্যক্তিগত শোক যেন লোকটার সর্বাঙ্গ দিয়ে ফুটে বেরুচ্ছিল একদলা অন্ধকারের মতো। যদিও অনেকদিন আগের ঘটনা কিন্তু শোকের তীব্রতা ছিল একেবারে তাজা। উচ্চকিত কণ্ঠে তর্ক করতে থাকা তরুণদের দল হঠাৎ তার দিকে চোখ পড়াতে কেমন যেন থতমত খেয়ে থেমে গেল। লোকটার শোকের চুইয়ে পড়া অন্ধকার একটু একটু করে যেন ভিজিয়ে দিচ্ছিল তাদের আলোচনার মাটি। সেই মাটিতে বসে থাকা নিতম্বগুলি সেই স্যাঁতস্যাঁতে শোকের স্পর্শে উপভোগের আনন্দ হারিয়ে ফেলল। একটু নড়েচড়ে বসতে পারলে ভালো হয়—এই আকাঙ্ক্ষায় ভরে গেল তাদের মনের মাটি।

অসহ্য সেই সিক্ত নীরবতা ও অস্বস্তি থেকে শ্রোতাদের বাঁচাবার জন্যই যেন লোকটা আবার কথা বলতে শুরু করল। এবার তার কণ্ঠস্বর ছিল গভীরতম মৃদুতায় মাখা একফোঁটা মধুর মতো নরম।

‘আমি অনেক ভেবেছি এই বিষয়টা নিয়ে। মাঝে মাঝে মনে হয় তারা শহীদ—কিন্তু পরক্ষণেই একটা নির্মম সত্য যেন গলা বাড়ায় পাশের বাড়ির খোলা জানালা দিয়ে। তার উজ্জ্বল যুক্তিপূর্ণ কণ্ঠস্বর সমস্ত কোলাহলকে এক ধমকে থামিয়ে দিয়ে ঘোষণা করে এই মৃত্যুগুলিকে নির্ভেজার বলি বলেই। শহীদের একটা যুদ্ধে কোনো না কোনোভাবে একটা অংশগ্রহণ থাকে। কিন্তু এদের অংশগ্রহণ কোথায়? আমি তখন তাকে মনে করিয়ে দিতে চাই যুদ্ধটা ছিল একটা জাতির মুক্তির সপক্ষে। ফলে সেই জাতির যেকোন ব্যক্তি সেই যুদ্ধের একটা অংশ। যুদ্ধ অনুষ্ঠানের স্থানে তাকে উপস্থিত থাকতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। ব্যক্তি যে এই জাতিরই একজন—এটাই তার অংশগ্রহণের প্রধান যোগ্যতা।

আমার কথা শুনে নির্মম সত্য দাঁত বের করে হাসে। তারপর এমন সস্নেহ করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায় যে, নিজের কাছ নিজেকে আমার মনে হতে থাকে একটা দুগ্ধ পোষ্য শিশু—যার শারীরিক আবেগ পৃথিবীর সমস্ত স্বাভাবিকতাকে বিপরীতার্থক হলেই অগ্রাহ্য করতে পারে। আমার কথাগুলি যেন বড়দের আসরে একটা ইঁচড়েপাকা কিশোরের একঘেঁয়ে প্যানপ্যানানির মতো শোনাচ্ছে—এইভাবে সে আমাকে এড়িয়ে যেতে চায়।

যাই হোক আমাদের দলের সঙ্গীদের এই আকস্মিক মৃত্যু আমাকে যেন ভীতির ভিতর থেকে বের করে আনল একটা প্রেরণার বিস্তীর্ণতায়। তার উজ্জ্বল আলো সাময়িকভাবে ধাঁধিয়ে দিল আমার চোখ। আর গুমোট একটা আবহাওয়া পরিবর্তিত হয়ে বায়ুপ্রধান হয়ে ওঠায় মনের ভিতরেও একটা স্বাচ্ছন্দ্য জেগে উঠল। যে দায়িত্ব নিয়ে আমি এখানে এসেছি—তা সম্পন্ন করার একটা তাগিদ ফুলেফেঁপে বিশাল হয়ে একটা বিরাট চাপ তৈরি করল আমার মনে। ভাবলাম কাজটা শেষ না করে আর ফিরব না। এমনকি এর জন্য যদি মৃত্যুবরণ করতে হয়—তাহলেও। অনুভব করলাম হৃদয়ে একটা বীরত্বের জন্ম হচ্ছে। আর এই বীরত্বের ভিতর দিয়ে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম পৃথিবীর সব বীরদের মানসিক অবস্থাকে। কোনো একটা যুদ্ধের আগে বীররা ঠিক আমার মতোই বোধহয় এইরকম একটা বীরত্ব অনুভব করে মনের মধ্যে।

তবে এই যুদ্ধে আমি হা-রে-রে-রে করতে করতে ঝাঁপিয়ে পড়ব না—এটা নিশ্চিত। আমার কৌশল হবে গোপনে নিঁখুতভাবে আঘাত হানার। আর এর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটা অন্ধকারের পরিপ্রেক্ষিত। আর এটা আমাকে দিতে পারে আসন্ন রাত।

অবশ্য রাতের আগমন শুরু হয়ে গেছে এরমধ্যেই। সন্ধ্যা এখন পূর্ণযুবতী। মাঠঘাটের ভিতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঝোপঝাড়গুলি তাদের ভিতরে সারাদিন ধরে লুকিয়ে রাখা অন্ধকারের থানগুলিকে এর মধ্যে মেলে দিয়েছে চারপাশে। আর জোনাকিগুলি ঘুম থেকে জেগে উঠে শুরু করে দিয়েছে ল্যাম্পপোস্ট হবার কাজ। সেতুর ওই পারের ক্যাম্পটাকে এখন আর স্পষ্ট দেখা যায় না। কেবল একটা অপ্রতুল বাল্বের ঝাপসা আলোতে অস্বচ্ছ পলিথিনের মতো মনে হচ্ছিল তাকে।

সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার মনের মধ্যে জেগে উঠল একটা তীব্র তীক্ষ্ণ জিদ। আর সেই জিদ তখনকার মতো তৈরি হওয়া অন্ধকারকে সাথে নিয়েই পা বাড়াল সেতুতে বোমা বসানোর কাজে।

ঝোপ থেকে বেরিয়েই আমি অন্ধকারের  মধ্যে মিশে যেতে চাইলাম আরেক টুকরা অন্ধকারের মতো। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আমার পরনে ছিল গাঢ় পোশাক। তারপরও অন্ধকারে দাঁড়িয়ে যখন নিজের দিকে তাকালাম—চোখে স্পষ্ট ধরা পড়ল নিজের অবয়ব। অথচ আমার মনে হচ্ছিল এই বিশ্ব চরাচরে নিরেট বস্তু হবার পরও আমি অদৃশ্য হয়ে গেছি। এখন নিজের চোখে নিজে ধরা পড়তেই আমি যেন নগ্ন হয়ে পড়লাম এক তুমুল আলোর বৃত্তে। ব্যাপারটা আমাকে চমকে দিল। পরিস্থিতির চোখে নিজে ধরা পড়ে গেছি এই কথা ভেবে আবার কোনো একটা অন্ধকারের আড়ালে লুকিয়ে পড়তে চাইলাম সাথে সাথেই।

হঠাৎ মনে হলো নিজের কাছাকাছি আমার অবস্থানই আসলে আমাকে দেখে ফেলার জন্য দায়ী। কিন্তু কেউ যদি দূরে দাঁড়িয়ে থাকে সে হয়ত খুঁজে পাবে না আমাকে। আর অন্ধকার যত গাঢ়ই হোক না কেন—আমি যেহেতু আমার সবচেয়ে কাছে দাঁড়িয়ে আছি—আমি আমাকে দেখবই। ভাবনাটা মনে আসতেই আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম। বুঝলাম অত্যধিক নাড়াচাড়া না করলে সেতুর অপর পারের সৈন্যরা আমাকে দেখতেই পাবে না। ফলে নিশ্চিন্তে আমি সেতুতে বোমা বসানোর কাজ শুরু করতে পারি।

বাকি অংশ পড়তে ক্লিক করুন >>

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।