ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

কুন্ডেরা, প্যারিস ও নুস্টাড পুরস্কার | এনামুল রেজা

বিশ্বসাহিত্য ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০১৬
কুন্ডেরা, প্যারিস ও নুস্টাড পুরস্কার | এনামুল রেজা

বিশ্বসাহিত্য একটা সমুদ্র, আপনি এর অংশ হতে চান তো তীরে দাঁড়িয়ে থাকলে সমুদ্রের অল্পই দেখতে পাবেন—পুরোটা পেতে চাইলে আপনাকে যা করতে হবে তা হলো ভেসে পড়া। আমাদের দেশে যদিও নোবেল মৌসুমে বেশ ভালো আলাপ-আলোচনা হয় এসব নিয়ে, কিন্তু নোবেলের বাইরেও প্রায় সারাবছর বিচিত্র সব ঘটনা ঘটে বিশ্বসাহিত্য জগতে।

লেখাটা শুরু করছি প্রিয় লেখকদের হালহাকিকত থেকে—তাদের অনেকেই ভালো নেই, অনেকে আবার আছেন ভালোর চেয়ে ভিন্ন অবস্থায়। ধীরে ধীরে হয়ত আলাপ জমে উঠবে উপমহাদেশ থেকে ইউরোপ কিংবা আফ্রিকা—সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্যের খুঁটিনাটি অজস্র বিষয় নিয়েই।


এইসব ছিয়াশিতে মিলান কুন্ডেরা
ঠিক পনের বছর পর ফরাসি চেক ঔপন্যাসিক মিলান কুন্ডেরার নয়া উপন্যাস বেরুলো, ঘটনা ২০১৫ সনের মাঝামাঝি। বিশ্বসাহিত্যের আগ্রাসী পাঠকেরা উত্তেজনায় উড়ে গেল বইটির দিকে, আমি নিজেও অন্তর্জালে উঁকি মারলাম অতি আগ্রহ নিয়ে যে, দা বুক অফ লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং অথবা ইমরালিটি অথবা দা আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিয়িং’র স্রষ্টা ছিয়াশিতে এসে কী লিখলেন? ১২৮ পৃষ্ঠার উপন্যাসটির নাম ‘দা ফেস্টিভাল অফ ইনসিগনিফকেন্স। ’ তার বইগুলোয় স্বভাবত যে ভ্রমণ আমরা দেখতে পাই, ওসবকে খুব সিরিয়াসই বলা চলে—যেখানে প্রেম, দর্শন, মানব অস্তিত্ব এবং সমাজ-রাজনৈতিক বাস্তবতা মিলেমিশে তৈরি করে এক বিচিত্র ককটেল; ফেস্টিভাল অফ ইনসিগনিফিকেন্স এইসব বিষয়ের পুনরাবৃত্তি করল কিনা, আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল এ প্রশ্ন। কুন্ডেরার স্ত্রী ভেরা হরাব্যানকোভা এক সাক্ষাৎকারে বললেন, “আমি চিরদিন চেয়েছি ও এমন একটা বই লিখুক, যেখানে এক বিন্দুও সিরিয়াস কোনো কথা থাকবে না। ”

জীবন সায়াহ্নে এসে কুন্ডেরা কি স্ত্রীর কথা রেখেছেন? বইটা এখনো পড়া না হলেও তা নিয়ে বিস্তর আলাপ আলোচনা পড়বার সুযোগ হয়েছে—যার মূল বক্তব্য কুন্ডেরা তার পাঠকদের দু’খণ্ডে ভাগ করে দিয়েছেন। একদল বলছেন, সিরিয়াস কুন্ডেরাকে না পেলেও এ উপন্যাস হাতে নিলে শেষ না করে উপায় নেই, ঔপন্যাসিক হিসেবে তিনি এখনো সমান আকর্ষণীয়। অন্যদল বলছেন, মাত্র ১২৮ পৃষ্ঠার উপন্যাসে নতুন এমন কিছুই নেই যা লেখক আগে বলেননি।

পশ্চিমা মিডিয়া কাকে অমর রাখবে, কাকে জীবৎকালেই মেরে ফেলবে খুব হিসেব নিকেশ করে সিদ্ধান্ত নেয়। কুন্ডেরা সম্ভবত তাদের ব্ল্যাক লিস্টে পড়ে গিয়েছেন, যে মাপের আলাপ আলোচনা হবার কথা ছিল, তেমন কিছুই হয়নি বইটি নিয়ে, যদিও বিশ্বসাহিত্যের পাঠকদের কাছে তিনি চিরকাল খুব বড় এবং দরকারি নাম, ছিয়াশির কুন্ডেরা এখনো বইয়ের দোকানে হটকেক। এবং এখন কাউকে অনুমান করতে হচ্ছে না যে, নিশ্চিতভাবেই প্রিয় লেখক কুন্ডেরা নোবেল পাচ্ছেন না আর।


প্যারিসে ফিরে এলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে
প্যারিস কখনো ফুরাবে না, ফুরাবে না এখানে বসবাস করা প্রতিটি মানুষ প্যারিসের যে স্মৃতি বয়ে বেড়ায় তাও যা আর সব কিছু থেকেই আলাদা। আমরা সবসময় এখানে ফিরে আসব যেখানেই থাকি না কেন, যতটা বদলে যাক এ শহর কিংবা যাই ঘটে যাক আমাদের ফিরতেই হয়। প্যারিস এ প্রত্যাবর্তনের যোগ্য এবং আপনি তেমন প্রতিদানই এ শহর থেকে পাবেন যতটা আপনি একে দিয়েছেন। - আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, আ মুভেবল ফিস্ট

আ মুভেবল ফিস্ট নোবেলজয়ী মার্কিন ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মেমর বা স্মৃতিচারণ। ঊনিশ শতকের বিশের দশকে যখন তিনি প্যারিসে কাটাচ্ছেন প্রবাস জীবন এক তরুণ সাংবাদিক হিসেবে—লিখছেন আর নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেই স্বর্ণযুগের যাকে বলা হয় লস্ট টোয়েন্টিজ, যে সময়টায় শিল্প-সাহিত্যে গোটা ইউরোপ জেগে উঠছে নতুন আন্দোলনে—ওইসব দিনরাত্রির প্যারিস যে গল্প ধারণ করেছিল, আ মুভেবল ফিস্ট সেসব বাস্তব দিবস রজনীর প্রামাণ্য। হেমিংওয়ে মারা যান ১৯৬১ সনে, এর ঠিক দু বছর পর ১৯৬৪’র ডিসেম্বরে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়, স্বভাবতই হয়ে ওঠে তৎকালীন বেস্ট সেলার এবং চিরায়ত বিশ্বসাহিত্যের অংশ। হঠাৎ এ বই নিয়ে আলাপ পাড়বার কারণ সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা—টুকে রাখাটা জরুরি।

গেল বছর প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার ইমিডিয়েট রি-অ্যাকশন হিসেবে সাহিত্য জগতের সবচে বিস্ময়কর ঘটনা সম্ভবত এটাই যে মধ্য নভেম্বরের ওই দুর্ঘটনার পরের সপ্তাহ থেকে আচমকা হেমিংওয়ের আত্মজৈবনিক আ মুভেবল ফিস্টের বিক্রি বেড়ে যায় বিপুল পরিমাণে। সচরাচর প্রতিদিন ১০/১৫ কপি করে বিক্রি হতো বইটা—ক্লাসিক যেকোন বইয়ের রেশিও হিসেবে একে দুর্দান্ত বলা চলে—হঠাৎ করেই সংখ্যাটা উঠে যায় ৫০০/৬০০-তে। প্যারিসের লোকজন স্বজন ও বন্ধু হারানোর বেদনায় সম্ভবত হেমিংওয়ের আত্মজৈবনিক বইটিতে পেয়েছে নস্টালজিক আশ্রয়। শিল্প-সাহিত্যের তীর্থভূমি এ নগরীতে যে শোকের কালো ছায়া নেমে এসেছে, বিশের দশকের সেই সৌরকরোজ্জ্বল স্মৃতি হয়ত তাদের বেদনায় একটু হলেও বুলিয়ে দিচ্ছে প্রলেপ। কোনো বিচিত্র কারণে প্যারিসের লোকজন মনে করে হেমিংওয়ে তাদের সবচে আপন আমেরিকান লেখক, হেমিংওয়ে নিজেও হয়ত শহরটাকে ভাবতেন কল্লোলিনী তিলোত্তমা।


নুস্টাড আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কার ২০১৬
হাল আমলে কিংবা বলা চলে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশ্বসাহিত্যের সম্মানজনক পুরস্কারগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীরা পেয়েছেন। বিশেষত কথাসাহিত্যে এটি এক ধরনের উত্থান বলা যেতে পারে—যদিও উপমহাদেশের নারী লেখকদের মতো ইউরোপিয়ান মেনস্ট্রিম নারী লেখকরা শুধু ফেমিনিজমকে আপ্ত বাক্য মেনেই লেখেন না, সবচেয়ে বড় প্রমাণ ২০১৫ সনের নোবেলজয়ী সভেতলানা আলেক্সেভিচ, তার লেখার বিষয়বস্তু সোভিয়েত আমল কিংবা সোভিয়েত পরবর্তী লোকজনের ইতিহাসচারণ। ইউরোপে নারীরা যে মুক্তি পেয়েছেন, সেটি উপমহাদেশে আসছে উল্টোপথে, দরজা খুলতে দেয়া হচ্ছে না স্বাধীন মত প্রকাশের—সুতরাং গণ্ডী থেকে এদেশের নারীরা বেরুতে পারছেন না, এক সময় হয়ত পারবেন।

গেল বছরের সবচেয়ে বেস্টসেলার বইটির লেখকও একজন নারী, পলা হকিনস—তার গার্ল অন দা ট্রেন মোটামুটি সারা বিশ্বেই জনপ্রিয় বই ছিল, উইকি বলছে বইটা শুধু ইউএসেতেই বিক্রি হয়েছে তিন মিলিয়ন কপির বেশি।

আলাপের এ অধ্যায়টি যে কারণে পাড়া—নুস্টাড আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কার ২০১৬ ঘোষিত হলো। ইউরোপে এটি বেশ নামকরা পুরস্কার, প্রায় নোবেলের সমতুল্যও বলা হয় নুস্টাডকে। গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, অক্তাবিও পাজ, টোমাস ট্রানট্রোমার থেকে আসিয়া জেবার কিংবা হালের রোহিন্তন মিস্ত্রি—নুস্টাড লরেটদের অনেকেই আগে কিংবা পরে নোবেল জিতেছেন। ১৯৭০ সন থেকে দু’বছর অন্তর এ পুরস্কার দেয় আমেরিকার ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৬ সনের  ২৪তম খেতাবটি জিতলেন প্রাক্তন জুগোশ্লাভিয়ায় জন্ম নেয়া নেদারল্যান্ড নিবাসী নারী ঔপন্যাসিক দুবরাভকা ইউগরেসেক। মূলত সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম মূল্যয়ন করে এ পুরস্কার প্রদান করে থাকে কর্তৃপক্ষ, ইউগরেসেকের সবচে বিখ্যাত উপন্যাস স্টেফি স্পেক ইন দা জস অফ লাইফ (১৯৮২)।

** বড় আয়োজনে বিশ্বের আট বইমেলা



বাংলাদেশ সময়: ২০৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০১৬

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।