ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

কবির সাহেবের পথচলা | সাজ্জাদ হোসেন

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১৬
কবির সাহেবের পথচলা | সাজ্জাদ হোসেন

সাত সকালে অফিসে আসার পথে ভয়াবহ একটা দৃশ্য দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল কবির সাহেবের। গেটের সামনে থেকে সামান্য একটু দূরে একটি চটের উপরে ছোট একটি বাচ্চাকে শুইয়ে সামনে বসে আছে কম বয়সী একটা মহিলা।

মুখ তার মলিন। ছিন্ন বস্ত্র গায়ে।

শিশুটির বয়স আন্দাজ করার চেষ্টা করলেন কবির সাহেব। দেড় কি বড় জোর পৌনে দুই বছর হবে। মহিলাটির বয়স ২৪/২৫ এর বেশি হবে না। বাচ্চাটিকে একটি চটের ব্যাগে শুইয়ে সে সামনে বসে আছে। মনে আশা, মানুষ টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করবে। কোনো কিছুর আশা ছাড়া কেউ কি আর এমনি এমনি বসে থাকে।

অনেক মানুষ আছে যারা সরাসরি ভিক্ষা চাইতে পারে না। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা ছাপানো লিফলেট হাতে নিয়ে বাসে উঠে পড়ে। যাত্রীদের হাতে হাতে সেই লিফলেট বিলি করে। কেউ নিতে না চাইলেও তার কোলের ওপর রাখে। সবার মাঝে বিলি হয়ে গেলে ঝোলা থেকে বের করে লজেন্স। এই লজেন্স জিনিসটা তো সবার পছন্দ নাও হতে পারে। দেখা যায় বেশির ভাগ লোকই তা কেনে না। কেউ কেউ না কিনলেও টাকা দিয়ে দেয়। কবির সাহেব মনে করেন, এই বিষয়টি একেবারে ভিক্ষা নয়। যদিও মানুষ বিরক্ত হয়। কার ঠেকা অপ্রয়োজনে লজেন্স কেনার। কবির সাহেব ভাবেন, এর মধ্যে ভালো একটি দিক আছে। তা কেউ লক্ষ্য করে না। লিফলেট আর লজেন্স না নিয়ে এই লোকের হাতে তো চাকুও থাকতে পারত। মানুষের বুকে চাকু ঢুকিয়ে দিয়ে টাকা আদায় করে নিতে পারত।



নীরব প্রতিবাদ জাতীয় কিছু হলে এত কষ্ট লাগত না। একসময় মৌন মিছিল নামে এক ধরনের বিষয় ছিল। ঢাকা হলো বিচিত্র শব্দ আর চিৎকারের শহর। এখন আর নীরব প্রতিবাদ চলে না। তাই তো সারা দিন চলে বেজায় চেঁচামেচি। এখন মনে হচ্ছে প্রেসক্লাবটাই হয়তো যত নষ্টের মূল! এটা ঢাকায় না হয়ে সাভার কিংবা জয়দেবপুরে হলে এইসব ভাষণ আর দাবি-দাওয়ার চিৎকার চেঁচামেচি আমাদের বিরক্ত করত না। কবির সাহেব শোনেন আর ভাবেন



হয়তো এই মহিলাটিরও সরাসরি ভিক্ষা চাইতে শরম লাগে। তবে সে কোনো লিফলেট ছাপায়নি। মেয়েটির চেহারায় অসহায়ত্বের ছাপ আছে। কোনো সুখে থাকা রমণী তো আর রাস্তায় এভাবে বসে থাকবেন না। কবির সাহেব জানেন, সন্তান সব মায়েরই অনেক প্রিয়। তাকে যেখানে সেখানে ফেলে রাখা যায় না। তাকে রাখতে হয় যতটা সম্ভব তারও চেয়ে বেশি আদর-যত্নে। কী এমন হলো যে আত্মজাকে পথে ফেলে বসে থাকতে হবে। ব্যাপারটা কবির সাহেবের মতো সামান্য চাকুরের মাথায় ঢোকে না।

কবির সাহেব রাজধানীর শহরের একটি সরকারি অফিসে চাকরি করেন। মর্যাদার বিচারে খুব সামান্যই একটি চাকরি। বর্তমান বাজারে পরিচয় দেয়ার মতো কোনো চাকরি নয়। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, তিনি যে একটি সরকারি অফিসে চাকরি করেন এটা জেনে অনেকেই তার কাছে নানা ধরনের তদ্বির নিয়ে হাজির হন। তিনি যতই বোঝাতে চেষ্টা করেন তিনি অফিসের সবচেয়ে নিচের পদে আছেন। তার চেয়ে নিচে যারা আছেন তারাও তারই সমান। তার নিজের চাকরিই দিনের মধ্যে ৫০ বার যায় আর আসে। তিনি কোনো তদ্বিরের সমাধান করতে পারেন না। তারপরও অনেকে তাকে ধরে—কবির সাহেব, আপনি যদি একটা উপায় করেন..

কবির সাহেবের একটি গুণ আছে। তিনি মিথ্যা বলেন না। তিনি যা বিশ্বাস করেন তাই বলেন। তিনি এমনিতে রাগ করেন না। কিন্তু কখনো রেগে গেলে বলেই বসেন—আমি কেরানীর চাকরি করি বলে কি আমার একটু শখও থাকবে না। কেরানী হয়ে কি এমন মহা অন্যায় করলাম বাবা। কেরানীরা কি মানুষ নন। নাকি তাদের মানুষ ভাবতে নেই। দুনিয়ার সব মানুষ তো আর জজ ব্যারিস্টার হয় না। কেউ কেউ তো কেরানীও হবে। কেউ হবে মুচি। কেউবা ঝাড়ুদার। পৃথিবীটাকে পরিষ্কার রাখার জন্যও তো এই সব মানুষ দরকার। সবাই লাট সাহেব হলে তো আর জগৎ চলবে না। জগৎ চালানোর জন্য বিধাতা কাজ ভাগ করে দিয়েছেন। তাই তো কেউ ঝাড়ুদার, কেউবা কেরানী। আবার কেউবা বড় বড় হর্তা-কর্তা। এই সবই বিধাতার খেলা। কবির সাহেব এটা বিশ্বাস করেন।

কবির সাহেব জানেন, সব মানুষেরই মর্যাদা আছে। রাজার যেমন মর্যদা আছে তেমনি প্রজাও মর্যাদাহীন নয়। যার যার স্থানে দু’জনেই মর্যাদাবান। কবির সাহেব মনে করেন, সততার সাথে কাজ করার মাঝেই মানুষের মর্যাদা।

কবির সাহেব খুবই নিরীহ, গোবেচারা ধরনের মানুষ। কারো সাতে নেই। পাঁচেও নেই। তার ধারণা, তার বুদ্ধি বিবেচনা কম বলেই তাকে বারবার কথা শুনতে হয় স্ত্রীর কাছে। পরিচিত সবাই তাকে বলদ বলে জানে। নইলে তার মতো পড়ালেখা জানা লোক কত বড় হোমরা চোমরা কিছু একটা হতে পারত। সে কোনো বড় চাকরি বাকরি পেল না। কবির সাহেব মাঝে মাঝে বলেন—আমার বাবার যদি অনেক জমি-জমা থাকত তবে কি আর আমি চাকরি করি। চাকরি মানে চাকরের কাজ। নামেই এর পরিচয় নিহিত। উপায় নেই বলেই আজ তিনি কেরানী।

অফিসে তার যিনি বস তিনি প্রায়ই রেগে গিয়ে বলেন—বাংলা বুঝেন না কবির সাহেব? নাকি অন্য কোনো ভাষায় বলতে হবে?

শুনে কবির সাহেবের খুব মন খারাপ হয়। তিনি অফিসের কাজ যে খারাপ জানেন এটা তিনি বিশ্বাস করেন না। তবে বসদের এই ভাষার জটিল প্রয়োগ তাকে আহত করে।

কবির সাহেব একদিন বসের যিনি বস তার র‍মে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে শোনেন—বড় বস তার বলছেন—বাংলা বুঝো না মিয়া, নাকি অন্য ভাষায় কথা বলতে হবে। আমি কিন্তু বাংলা ছাড়াও আরো কয়েকটি ভাষা জানি।

কবির সাহেবকে দেখে বস খুব লজ্জা পেলেন বলে মনে হলো।

তার স্ত্রী আলেয়া বেগম মাঝে মাঝে বলেন—মনটাকে আরো একটু বড় কর। অফিসে তুমি কেরানী হতে পারো। কিন্তু যখনই তুমি অফিসের বাইরে বের হয়ে আসো তখন তো আর তুমি কেরানী নও। তখন তুমি নিজেকে রাজা ভাবো না কেন? অফিসের বাইরেও তোমার একটা জগত আছে। তোমার সেই জগতের তুমিই তো রাজা। অফিসে পদবিতে তুমি হয়তো ছোট হতে পারো। কিন্তু মানুষ হিসাবে তুমি অনেক বসদেরকেই ছাড়িয়ে যেতে পারো। সেখানে কেউ তোমার কাছে হালে পানি নাও পেতে পারে। তাই অফিসের বাইরে বের হওয়া মাত্র তোমার মনটাকে প্যারাসুটের মতো ছড়িয়ে বড় করে দাও। মনে রাখতে পারো, তুমি যদি ইনফেরিয়র জটিলতায় ভোগো তোমার বসরা অনেকেই দেখতে সুপিরিয়র জটিলতায় ভুগবে। তখন তুমি অনেক মজা পাবে। জগতের এই সব মজা সবাই বোঝে না। যারা বোঝে তারা খুব সুখী মানুষ হয়। তুমি সুখী হবার চেষ্ট করো।

শুনে কবির সাহেব হাসেন। এই সব কথা শুনলে তার মন ভালো হয়ে যায়।

আলেয়া বেগম মানুষটি অনেক ভালো। তিনি ভাবেন, তার বউটা অনেক জ্ঞান বুদ্ধি রাখে। আহা, বেচারী অনেকবার বিসিএস পরীক্ষা দিতে চেয়েছে। কিন্তু সরকারি চাকরি পেলে কোন অজপাড়া গাঁয়ে পোস্টিং হবে সেই আশঙ্কায় আর পরীক্ষাই দেয়া হয়নি। তার ভাব দেখে মনে হয় যেন বিসিএস পরীক্ষা দিলেই চাকরি খাড়া। আর বিসিএস কি এতই সোজা। কত পড়ালেখা। তারপর আছে নানা কোটা। আছে নেতাদের দলীয় তদ্বির। এখানে টিকে নির্বাচিত হওয়া কি যার তার কাজ! তাই বেচারী শেষ পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবেই কর্মজীবন শুরু করল। সামান্যই চাকরি। ছোট ছোট শিশুদের পড়াতে তার খুব ভালো লাগে। তার মুখে লেগে থাকে সহজ সরল হাসি। সরল সেই হাসি নিয়েই তো চলছে তাদের সংসার। তাদের সংসারে দুটি ছেলে-মেয়ে। তাদের বড় করে তোলার কাজটিই দু’জনে করতে চান অত্যন্ত সুচারুভাবে।

কবির সাহেবের অফিস ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে। এই প্রেসক্লাব জায়গাটি কবির সাহেবের খুবই অপ্রিয় একটি জায়গা।

প্রেসক্লাবের সামনে প্রতিদিনই সমানে ব্যানার হাতে নিয়ে আর মাইক লাগিয়ে দেদারসে চলতে থাকে ভাষণ! যেন ভাষণের মহোৎসব। যেন কে কত জোরে চিৎকার করতে পারে তার প্রতিযোগিতা। তাদের ভাষণের কথাগুলো যে খুব মার্জিত তাও নয়। যা ইচ্ছে তাই বলে যায়। কেউ কেউ বলে তাদের মুখে লাগাম দেয়া দরকার। মাইকগুলো তাক করা থাকে তাদের অফিসের দিকে। ফলে সব দাবি দাওয়া সারাদিন তাদেরকেই শুনতে হচ্ছে। যাকে উদ্দেশ্য করে দাবি পেশ তারা থাকেন অনেক দূরে। তারা হয়তো পত্রিকায় পড়বেন যদি এগুলো ভাগ্যক্রমে ছাপা হয়।

আজকাল খবর ছাপানো হয় তদ্বির করে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো সভা এখানে হবেই। এত খবর ছাপার মতো জায়গা হয়তো পত্রিকাওয়ালাদের নাই। খবরের চেয়ে বিজ্ঞাপন ছাপলে পত্রিকার ব্যবসা হয়। লাভজনক ব্যবসা বাদ দিয়ে এই সব শত শত সমাবেশের খবর ছাপাবে পত্রিকাওয়ালার এতটা বোকা নন।

নীরব প্রতিবাদ জাতীয় কিছু হলে এত কষ্ট লাগত না। একসময় মৌন মিছিল নামে এক ধরনের বিষয় ছিল। ঢাকা হলো বিচিত্র শব্দ আর চিৎকারের শহর। এখন আর নীরব প্রতিবাদ চলে না। তাই তো সারা দিন চলে বেজায় চেঁচামেচি।

এখন মনে হচ্ছে প্রেসক্লাবটাই হয়তো যত নষ্টের মূল! এটা ঢাকায় না হয়ে সাভার কিংবা জয়দেবপুরে হলে এইসব ভাষণ আর দাবি-দাওয়ার চিৎকার চেঁচামেচি আমাদের বিরক্ত করত না। কবির সাহেব শোনেন আর ভাবেন।

কবির সাহেব মনে মনে ভাবেন, আজকাল মানুষ সব জায়গায়ই ব্যবসা খোঁজে। তার বাল্যবন্ধু রহমান সাহেব একজন শিক্ষক। কলেজে চাকরি করেন। তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় ব্যবসা কি জানো বন্ধু?
কবির সাহেব না জানার ভাব করেন।
জানি না তো। তবে শুনেছি গার্মেন্টস নাকি সবচেয়ে বড়।
আরে ওটা তো সবচেয়ে বড় রপ্তানিমুখী শিল্প। জেনে রাখো, সবচেয়ে বড় ব্যবসা হলো রাজনীতি। অনেক লাভের ব্যবসা এটা। দেখো না, লোকজন কেমন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে এই ব্যবসায়।
অন্য সবাই মাইন্ড করতে পারেন। কিন্তু যারা প্রেসক্লাবের সামনের ভবনগুলোতে কাজ করেন তারা নিশ্চয়ই তার কথায় একমত হবেন। প্রেসক্লাবটা সরিয়ে নিলে এই মুহূর্তে কবির সাহেব খুব খুশি হতেন।

প্রতিদিন কিলবিল করে মানুষ ছুটে চলে তোপখানা রোডের ওপর দিয়ে। গায়ে গা লেগে যায়। পায়ে পায়ে ঠোকাঠুকি হয়ে যায়। পথে এতটুকু জায়গা ফাঁকা নেই। খালি মানুষ আর মানুষ। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে মানুষ। আর কমে যাচ্ছে মানবতা। মানুষের মনে এখন আর মায়া-মমতা নেই। সবাই যেন পাথর হয়ে গেছে। পাথরের বুকেও মাঝে মাঝে পানি দেখা যায়। মানুষের মায়ার কোনো আভাস পাওয়া আজকাল কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে।

আজ অফিসে প্রবেশ করার সময় দেখা গেল মহিলাটি বাচ্চাটিকে শুইয়ে দিয়ে পাশে বসে আছে। কয়েকটি মাঝি ভনভন করছে। বাচ্চাটিকে দেখলেই মনে হয় খুবই দুর্বল। বোধহয় ঠিকমতো খাবার দেয় না। আর খাবার দেবেই বা কিভাবে? সারা দিনে কয় টাকা পায় সে।

আজকাল মানুষ খুব একটা দান খয়রাতও করে না। আর যদিও করে, তারা তো আর এই অফিসরে গেটে এসে দান করবে না। এই অফিসে যারা বড় বড় পোস্টে আছেন তারা কেউই পায়ে হেঁটে পথ চলেন না। তারা গাড়ি হাঁকিয়ে অফিসে আসেন। পথের পাশে কে বাচ্চা নিয়ে বসে আছে তা কেউ দেখেন না।

যারা তার মতো মাছিমারা কেরানী তারাই কেবল পায়ে হেঁটে যাতায়াত করেন। ১০ টাকার রিক্সার পথ অনায়াশে পায়ে হেঁটে মেরে দেন। দান-খয়রাত করার মতো এত টাকা তারা পাবেন কই। যাদের দান করার সামর্থ্য আছেন দরিদ্র ব্যক্তিরা তাদের ধারে কাছেও যেতে পারে না। পথে তারা থাকেন গাড়ির ভেতর। আর তারা যখন বাড়িতে থাকেন তখন বাড়িতে বিশাল গেট। সেই গেটে আবার দারোয়ান পাহারা থাকে। আর থাকে বিদেশি কুকুর।

তাদের অফিসের গেটের বাইরে শুধু মহিলাটি নয়। আরো অনেকেই বসে আছে। কেউ বসে আছে ফলের ঝুড়ি নিয়ে। এখানে দোকান ভাড়া দেবার ব্যাপার নেই বলে তারা একটু কম দামে বিক্রি করতে পারে। অফিসের চাকুরেরা এটা জানে। তবে অফিসের গেটে পাহারারত পুলিশরা মনে হয় মাঝে মাঝে দোকানীদের কাছ থেকে অন্য ধরনের সুবিধাও নেয়া। কবির সাহেব নিজে দেখেছেন। দেখেও না দেখার ভান করেছেন। ঢাকা শহরের ফুটপাতের প্রতি ইঞ্চি জায়গার জন্য ভাড়া দিতে হয়। এই ভাড়া সরকারি কোনো খাতে যায় না। যাদের ট্যাকে যায় তারা অনেক শক্তিশালী। তারা কাউকে পরোয়া করেন না। কে জানে হয়তো এই মহিলাটিকেও কর দিতে হয় এখানে বসার জন্য। প্রতিদিন ১০০ টাকা। কিংবা প্রতিদিন যা কামাই হবে তার অর্ধেক।

এখানে অনেক ফলের বিক্রেতা, জামা-কাপড়ের পসারীরাও বসেছে। একটা ভালো দিক হলো এখানে দাম তুলনামূলকভাবে অনেক কম। তবে না বুঝলে ঠকতে হয়। কবির সাহেব বেশিরভাগ সময়ই ঠকেন। এই তো সেদিন এক দোকানীর কাছ থেকে লিচু কিনলেন। দেখতে ভালোই মনে হলো। দোকানী ২২০ টাকা ১শ’ দরে বিক্রি করতে রাজি হয়ে গেল। কবির সাহেব মনে মনে খুব খুশি হলেন। কেননা, অন্য জায়গায় এই সময় এই লিচু এই দামে কেনার আশা করা যায় না। দোকানী বলল, স্যার, গোনা, আছে ১শ’টা। তারপরও পাঁচটা বেশি দিয়ে দিলাম।

অনেক খুশী মনে কবির সাহেব বাসায় এলেন। কৌতূহল বশত লিচু গুনতে বসলেন। গোনার পর সত্যি সত্যি তার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। দেখলেন সেখানে ৯৩টি লিচু আছে। পাঁচটা বেশি দেয়ার পরও সাতটি লিচু কম হয়ে গেল। মন খারাপ হবার মতো কথাই।

আলেয়া বেগম বললেন, তোমার কি ধারণা দোকানীরা গুনে গুনে লিচুর আঁটি বাঁধে? তারা মুঠো করে ধরে আন্দাজ মতো আঁটি বানায়। তারা এমন করে আঁটি বাঁধে যাতে ১শ’র কম লিচু হয়। বেশি তো হবেই না। কারণ দুয়েকটা খসেও পড়ে যায়।

আরেকবার এক দোকানী আম কেটে খাইয়ে পাঁচ কেজি আম তাকে গছিয়ে দিল। বাসায় এনে দেখে ভয়ানক টক। এত টক যে দুধে দিলে তা জমে যাবে।

কবির সাহেব বারবার ঠকেন। যেন ঠকাটাই তার প্রাপ্য।

এই এলাকায় দোকানী, ভিক্ষুক কিংবা পুলিশ থাকার পরও প্রায়ই ছিনতাই হয়। সেইদিন আলম সাহেব সামনের ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অফিসে ফিরছিলেন। মূল গেটে আসার আগেই দুই যুবক এসে অস্ত্র দেখিয়ে নিয়ে নিল। অস্ত্র থাকলে কিছু করার থাকে না। জানের ভয় সবারই আছে। তাই সারা মাসের বেতনের টাকা এক মিনিটের আগেই খরচ হয়ে যায়। ঘটনা ঘটে যাবার পর নানা জনে নানা পরামর্শ দেয়। তাদের পরামর্শ আগে পেলে ছিনতাইকারী তো ধারে কাছেই আসতে পারত না।

অফিসের পেছনে কম খরচে খাওয়ার জন্য একটি ভাতের দোকান আছে। সেখানে কম খরচে ভাত খাবার ব্যবস্থা আছে। দোকানের সামনে একটি হাতে লেখা সাইন বোর্ড ঝুলছে। সোহাগ মিয়ার ভাতের হোটেল। ডাল ফ্রি। তার মতো কম আয়ের লোকেরা এখানে এসে আয়েশ করে দুপুরের খাবার খায়। ভাতের সাথে এরা যে জিনিসটা বানায় তা হলো চা। সোহাগ মিয়ার চায়ের কোনো তুলনা হয় না। একবার সচিবালয় থেকে বড় সচিব সাহেব ফ্লাস্ক পাঠিয়ে চা নিয়ে গেছেন। ভাতের চেয়ে চা-ই বেশি চলে। তবে দুপুরে ভাত খাবার জন্য অন্যান্য অফিস থেকেও অনেক লোকজন চলে আসে। সবাই কিভাবে যেন জেনে গেছে সোহাগ মিয়ার হোটেলে কম খরচে আরাম করে ভাত খাওয়া যায়। সাথে পান আর বিড়ির বিক্রিও কম নয়।

একটা জিনিস সোহাগ মিয়া করে তা হলো এই অফিসে যারা ছোট ছোট চাকরি করে তাদের অনেকেকে বাকিতে খাবার দেয়। কথায় বলে বাকির কাম ফাঁকি। কিন্তু সে বেশ কয়েকজনকে জানে। তারা ফাঁকিবাজ নয়। মাস শেষে বেতন পেয়ে প্রথমেই তারা তার টাকা দিয়ে দেয় এবং বেশ বিনয় সহকারে এটা করে। এই জিনিসটা দেখতে তার খুব ভালো লাগে। এই তৃপ্তি তো আর নগদ বিক্রি করে পেত না। এই জগতে মানুষ নানান ধরনের তৃপ্তি পেতে চায়। তার তৃপ্তি অন্য রকম। বাকি কারো সাথে তা মেলে না।

তবে কারো হাতে টাকা পয়সা বেশি থাকলে চলে যায় তোপখানা রোডের বড় বড় হোটেলে। সেখানকার খাবার ছাড়া তখন আর আসর জমে না।

সে দিন দুপরে ভাত খেতে গেছেন। পাশে আছেন তারই কলিগ খয়ের সাহেব। খাবার শেষে চা নিয়ে তিনি খয়ের সাহেবকে বললেন, খয়ের ভাই একটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন।
কী জিনিস?
মেইন গেটে প্রবেশ করার সময় দেখবেন একটা মহিলা একটা বাচ্চা নিয়ে বসে থাকে।
হা হা আমি দেখেছি। এরকম তো কতই দেখি।
আমার কাছে দৃশ্যটা কষ্টদায়ক মনে হয়।
কেন বলেন তো।
একবার ভাবুন তো। ছোট্ট একটা বাচ্চা। রাস্তায় পড়ে থাকে। অথচ এখন তার কত যত্ন পাবার কথা। দাদা-দাদী, নানা-নানী, খালা-ফুপুর আদর যত্নে থাকার কথা। অথচ সে কিনা পড়ে থাকে পথের ধুলাবালিতে।
বাদ দেন তো। এইসব ভেবে লাভ কী? যার যার সংসার তার তার। সে কেন বাচ্চা নিয়ে পথে বসে থাকে। বাড়িতে থাকতে পারে না।
হয়তো বাড়ি নেই। ঘরও হয়তো নেই। এই পৃথিবীতে সবার ঘর হয় না।
ঘর না থাকুক। মহিলাটির কি স্বামীও নেই। স্বামী না থাকলে বাচ্চা এলো কী করে।
হয়তো বা দেখা যাবে তার স্বামীও নেই। আর বাচ্চা হবার জন্য স্বামী থাকা কি খুব জরুরি। হয়তো বিয়ে হয়েছিল। যৌতুক দিতে পারে নাই। তালাক দিয়ে স্বামী ভেগেছে। মহিলাটি বাচ্চা নিয়ে পড়েছে বিপাকে।

কবির সাহেব ভাবেন। মাঝে মাঝে তার মনে হয় সংসারের এই বিষয়টাতে অনেক পুরুষই দেখা যায় চরম পাষাণ। আরে ব্যাটা, বাচ্চাটাকে দেখবি না। জন্ম দিয়েই দায়িত্ব শেষ। তাকে পেলে পুষে বড় করতে হবে না?

কেন যেন তার মনটা উসখুস করতে থাকে। সারাদিনই যেন ওই ছবি তার চোখে ভাসতে থাকে। হাজার হাজার পথচারী হেঁটে চলেছে। তারই মাঝে একটি নারী তার বাচ্চাকে শুইয়ে দিয়ে বসে আছে। দেখতে খুবই খারাপ লাগে। এখন তার ভাবতেই খারাপ লাগে।

একবার ঠিক করল অফিস ছুটির সময় কথা বলবে মহিলাটির সাথে। সামান্য খোঁজ নেবে। বাড়ি কই, কোথায় থাকে। বিশেষ করে বাচ্চাটির বাবা কোথায় এইসব। একটি শিশু যার আদরে আদরে বেড়ে ওঠার কথা সে কেন পথে অবহেলায় পড়ে থাকবে। এটা তো তার একার নয় সবারই জানার উচিত। সমাজের সবার। রাষ্ট্রের সবার। একটি শিশু তো আর পথে পড়ে থাকার জন্য পৃথিবীতে আসেনি। সে পৃথিবীর অতিথি। তাকে যথাযোগ্য সমাদরে রাখতে হবে। তাকে কেন কষ্ট দেয়া হবে। তার মনটা কেন যেন বিদ্রোহী হয়ে যেতে চায়। বিকেল চারটায় অফিস ছুটি হলেও তার বের হতে হতে পাঁচটা পার হয়ে গেল। সে ঠিক করে রাখল যাবার সময় একবার মহিলাটির সাথে কথা বলে যাবেই। জানতেই হবে সব রহস্য। কিন্তু মেইন গেটের বাইরে এসে দেখল মহিলাটি নেই। অন্য দিন সে না থাকলেও দেখা যেত বাচ্চাটি শুয়ে আছে। আজ দু’জনের কেউই নেই।

মসজিদ থেকে ফিরে আর তিনি ঘুমালেন না। ঘরের মধ্যেই হাঁটাহাঁটি করলেন। চারদিকে আলো ফুটতেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। রাস্তায় হাঁটতে বেরুলেন। তাদের এলাকায় কোনো পার্ক নেই। তাই রাস্তায় হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। তিনি খেয়াল করে দেখলেন অনেকেই তার মতো হাঁটতে বের হয়েছেন। ডায়াবেটিক আর প্রেসারের জন্য হাঁটাহাঁটি না করে আর উপায় নেই।

শুক্রবারের অফিস তাদের অন্যরকম। কারণ অনেকেই যারা গ্রামের মানুষ তারা ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যান। তাই দেখা যায় ১২টার পর অনেক সহকর্মীই আর অফিসে থাকেন না। সকাল সকাল বাস ধরতে পারলে তাড়াতাড়ি বাড়ি যাওয়া যাবে। ফলে অফিস ফাঁকা থাকায় যারা থাকে তাদের ওপর দিয়ে চাপ যায়। বসরা কারণে অকারেণ তাদের ডাকে। এই করো, সেই করো।

তবে আজ তার ভাগ্য ভালো বলতে হবে। কারণ, বস আজ ছুটি নিয়ে গেছেন। তাই সে খুবই খুশি। চিন্তা করল, লাঞ্চের সময় বেশ খানিকটা সময় নিয়ে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করবেন। গুলিস্তানে যাবেন। ফুটপাতের জিনিসপত্র নেড়ে চেড়ে দেখবেন। তাই তিনি অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লেন। ঢাকার রাস্তায় দেখার মতো জিনিসের আকাল নেই। কেবল দেখার মতো মন থাকতে হয়। তিনি সারাটা সময় শহরের আজব জিনিস দেখে কাটালেন।

কবির সাহেব বাসায় ফেরার অনেক আগেই গৃহিণী বাসায় ফেরেন। বাসায় এসে সব কাজকর্ম গুছিয়ে গৃহকর্তার জন্য অপেক্ষা করেন। বাসায় আসার পর দু’জনের সারা দিনে জমানো সব কথা বিনিময়। আজ কবির সাহেব ঠিক করলেন মহিলাটি আর তার বাচ্চাটির কথা বৌকে বলবেন। আবার চিন্তা করলেন এই গল্প শুনে গিন্নি যদি আবার রেগে যায়। তাহলে সামলাবেন কী করে।

তার আশংকাই সত্য হলো। গৃহিণী রেগে গেলেন। কেবল রাগ নয় অনেক বেশি রাগই করলেন।

তোমার কাণ্ড দেখে আমি সত্যি সত্যি অবাক হলাম। এইসব আজে বাজে জিনিস নিয়ে তুমি কেন ভাববে?
ভাবলে কী এমন দোষ?
দোষ নাই?
না, দোষ নাই। একটা অসহায় মানুষ। রাস্তায় তার সন্তানকে নিয়ে বসে থাকে সাহায্যের আশায় এটা নিয়ে ভাবা যাবে না। ভাবলে কী এমন ক্ষতি।
তুমি এটা নিয়ে কেন ভাববে? এটা নিয়ে ভাবার জন্য অনেক মানুষ আছে। এমপি আছে, মন্ত্রী আছে, সমাজসেবক আছেন। তারা ভাববেন। তোমার এটা নিয়ে ভাবার কোনো দরকার নেই। তোমার কাজ তুমি করো। তুমি তো আর সেই যুগের হাজী মোহাম্মদ মোহসীন হয়ে যাওনি।
ভালো কাজ করতে চাইলে হাজী মোহসীন হওয়া লাগে না। আমার রোজ রোজ বিষয়টা দেখতে খারাপ লাগছিল। তাই তোমাকে বললাম।
না, এধরনের কথা আমি তোমার কাছ থেকে শুনতে চাই না। পথের এইসব মহিলারা ভালো হয় না। তাদের নিয়ে তুমি ভাববে এটা আমি চাই না। তাদের দিকে তাকাবেও না। মহিলাটির চেহারা কেমন?
ঠিক আছে। আর ভাবব না। আর মহিলাটির চেহারা আমি লক্ষ্য করে দেখিনি।
কখনোই লক্ষ্য করবে না। কোনো দরকার নেই। অন্য কোনো নারীর প্রতি তোমার কোনো দুর্বলতা আসুক এটা আমি পছন্দ করতে পারি না।
অন্য কোন নারীর প্রতি আমার কখনো কোনো দুর্বলতা ছিল না। এখনো নাই। আমার যদি কোনো নারীর প্রতি দুর্বলতা বা সবলতা যাই থাকে সেটা হলো তুমি।
কিন্তু গৃহিণীর আচরণে মনে হলো তার রাগ কমেনি।

অনেকটা মন খারাপ নিয়ে রাতে ঘুমোতে গেলেন কবির সাহেব। তবে গভীর রাত পর্যন্ত শুয়ে শুয়ে ব্যাপারটি নিয়ে অনেক ভাবলেন। কিন্তু ভেবে কোনো কুল-কিনারা করতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলেন এই বিষয়টি নিয়ে তিনি আর ভাববেন না। সত্যিই তো। তিনি কেন এটা নিয়ে ভাববেন। এইসব বিষয় নিয়ে ভাবার মতো লোক তো সমাজে অনেক আছেন। তিনি অফিসের সামান্য একটি কেরানী। এইসব নিয়ে ভাবনা তাকে কি মানায়?

অহেতুক টেনশনে ঘুম আসতে চাইছিল না। এপাশ ওপাশ করে যেন রাত পার হয়ে যেতে বসেছে। তবে শেষরাতে কবির সাহেবের ভালো ঘুম হলো। তিনি এত আরাম করে শেষ কবে ঘুমিয়ে ছিলেন মনে করতে পারলেন না। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তিনি যেন একটি দৃশ্য দেখতে পেলেন। সম্ভবত স্বপ্নই হবে।

কবির সাহেব দেখলেন তাদের অফিস ভবনটা যেন একটি রাজবাড়ি। বিশাল এক রাজপুরী। সেই বাড়ির সদর গেটে মহামহিম রানী বসে আছেন। তাঁর সামনে একটি সোনার দোলনা। সেই দোলনায় ছোট্ট রাজকুমারী ঘুমিয়ে আছে। দোল দিচ্ছেন রানী। কবির সাহেব রাজবাড়ির সামনে দিয়ে যেতে ভয় পাচ্ছেন। চারিদিকে সৈন্য সামন্ত। হাতে তাদের নানা রকম তরবারি। বাগানে ফুলের গাছ। নানা ধরনের পাখি ডাকাডাকি করছে। এইসব পেরিয়ে কবির সাহেবের চোখ ঠিকই রাজকন্যার দিকে চলে গেল।

অবাক হয়ে কবির সাহেব দেখলেন রাজকন্যা নয়। রাজকীয় খাটে শুয়ে আছে পথের পাশের সেই মেয়েটি। কি যে সুন্দর আর মায়াময় লাগছে তাকে।

ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তিনি শুনতে পেলেন আজান হচ্ছে মসজিদে। ধরমর করে উঠে পড়লেন তিনি। আজ আর ঘুমাবেন না। পাশের মসজিদে যাবেন নামাজ পড়তে। মনটা শান্ত করা দরকার। বড় জামাতে গিয়ে নামাজ পড়লে তার মন শান্ত হয়।



বাংলাদেশ সময়: ১৬৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১৬
টিকে/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।