বছর তিনেক আগে এক জলসায় গিয়েছিলাম। সেদিন ছিল, ‘ভ্যালেনটাইনস্ ডে’।
হঠাৎ দেখি, এক উর্বশী যুবতী রমণী ধূমকেতুর মতো আর্বিভূত হয়েই তার ডাগর চোখের অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে কাকে যেন খুঁজছে। তার চেহারা আর চটকদারী বেশভূষায় মনে হয়েছিল যেন এক স্বপ্নপরী স্প্যানিশ কন্যা। তারপরই দেখি, চোখেমুখের বিচিত্র ইশারায় কাকে যেন কী একটা সংকেত প্রেরণ করতে করতে গ্লাসে বিয়ার ঢালছে। ঢেলে গ্লাসটা হাতে নিয়ে ফিল্মি হিরোইনদের মতো প্রাণবন্ত চঞ্চলতায় রহস্যাবৃত চোখের চাউনি মেলে ইউরোপিয় স্টাইলে ছোট্ট-ছোট্ট চুমুকে পান করতে করতে একটা সোফার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। দাঁড়াতেই দেখি, ভিড়ের মধ্যে থেকে পাগড়ি পরিহিত লম্বাটে সুঠাম, উজ্জ্বল সুদর্শন চেহারার এক তরুণ যুবক সহাস্যে দ্রত এগিয়ে এসে ওর গা-ঘেঁষে দাঁড়ায়। সেও উচ্ছ্বাসে একেবারে উতল। ৫৫৫ সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে পুরুষালি ভঙ্গিতে লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে তার মুগ্ধচোখের দৃষ্টি মেলে আস্বাদন করতে থাকে, হৃদয়াকর্ষক সৌন্দর্যের পারিজাত ঐ উর্বশী রমণীর বাঁধ ভাঙ্গা উত্তাল যৌবনের চমকপ্রদ রঙ আর রূপ।
ততদিনে সন্দীপের কাঙ্ক্ষিত বাসনাগুলিও একে একে সব পূরণ হতে লাগল। মর্যাদাসম্পন্ন উচ্চপদস্থ চাকুরি, দেশিয় স্টাইলে আলিশান বাড়ি, গাড়ি, বিলাসবহুল আসবাবপত্র, অর্থ-বিত্ত-ঐশ্বর্য, দামি শাড়ি-গহনা, সব পরিপূর্ণ। স্বর্গসুখ ছিল সুলোচনার হাতের মুঠোয়। ইতোমধ্যে সুযোগ্য পুত্রের আশাতীত সাফল্যের সুখবরে মনের ক্ষোভ, মান-অভিমান, অভিযোগ সব অপসারিত করে সন্দীপের মা-বাবা ভিজিট করতে চলে আসেন কানাডায়। যা আগে স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবা যায়নি
ইতোমধ্যে হারানো দিনের একটি গান দিয়ে শুরু হয় জলসার প্রথম পর্ব। তার পরই সমগ্র উপস্থিত মণ্ডলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেই উর্বশী রমণীর মনোমুগ্ধকর একটি নৃত্য পরিবেশনায়। সেটি ছিল একটি বাংলা ছায়াছবির গান। ‘গা ছমছম কী হয় কী হয়…থমথমে রাত যতই বাড়ে…ম্যায় হুঁ পায়রা পায়রা বিবি…পায়রা বিবি হাম’।
ক্ষীণ আবছা অন্ধকারে সুবর্ণ ঝিকিমিকি আলোর কণায় মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, নৃত্যটি যেন রঙিন পর্দায় প্রদর্শিত হচ্ছে। উৎসুক্য হয়ে সমগ্র উপস্থিত মণ্ডলী সবাই মুগ্ধ দৃষ্টিতে একেবারে উন্মত্ত চিত্তে নৃত্যটি উপভোগ করতে থাকে। কিন্তু জোরালো করতালিসহ একরাশ প্রশংসা কুড়িয়ে মন্ত্রের মতো হঠাৎ চোখের পলকে দুজনে কোথায় যে উধাও হয়ে গেল, সেই রাতে ওদের আর দর্শনই পাওয়া যায়নি।
তার মাস ছয়েক পরের ঘটনা। সেদিন আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। চারদিক নিঝুম, নিস্তব্ধ। বৃষ্টিও পড়ছিল গুঁড়িগুঁড়ি। তাই দৌড়ে যাচ্ছিলাম বাস ধরব বলে। ইতঃপূর্বে ট্রাফিক সিগনালের গ্রিন লাইটটা জ্বলে উঠতেই বাসটি দ্রুত পাস করে গেল। আর তক্ষুণি মহিলা কণ্ঠস্বর কর্ণগোচর হতেই আমি থমকে দাঁড়াই। ‘আও ব্যাহেন আও, ইধার আও!’
পেছন ফিরে দেখি, একজন অচেনা মহিলা। আশেপাশে কেউ নেই। কাচের তৈরি বাসস্টপেজের ছোট্ট শেল্টারে বসে আছে। বৃষ্টির ঝাপটায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। কে ঐ মহিলা? খানিকটা বিস্ময় নিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেলাম। চোখে চোখ পড়তেই ঠোঁটের কোণে অস্ফুট একটা বিষণ্ণ হাসি ফুটিয়ে মহিলাটি মৃদু স্বরে বলে ওঠে, ‘হায়, হাউ আর ইউ? পহেচানা? ম্যায় সুলোচনা! পায়রা বিবিকো এয়াদ হ্যায়?’
পায়রা বিবি? এ আবার কেমন নাম! এ নামে তো কাউকে চিনি না! কে এই মহিলা? ভাবতে ভাবতে ওর আপাদমস্তক নজর বুলাতেই আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই বিস্ময়ে,—এ কি! এ তো সেই উর্বশী রমণী। এ কী হাল হয়েছে ওর! জরাজীর্ণের মতো নিথর, নিস্তেজ শরীর। চোখমুখ শুকিয়ে একেবারে গর্তে ঢুকে গিয়েছে। ওকে কঙ্কালের মতো দেখাচ্ছে। কোনো বিকার নেই। উচ্ছ্বাস নেই। সাজ-সজ্জার বালাই নেই। কেশ-বিন্যাশ এলোমেলো। প্রসাধনের অবস্থাও তদ্রূপ। পরনের পোশাকটি দামি হলেও মলিনতার ছাপ প্রকট।
ইতোমধ্যে নাকের ডগা দিয়ে তীব্রবেগে চলে গেল আরো দুটো বাস। অথচ বাড়ি ফেরার কোনো তাগিদই বোধ করছে না সুলোচনা। মনে হচ্ছিল, প্রবল ঝড়ের মুখে উড়ে আসা মুমূর্ষু পাখির মতো নির্জনে চুপটি করে বসে আছে। সংসারে কেউ নেই ওর। বাড়ি ফেরার কোনো তাড়া নেই। আর সময় মতো না ফিরলে বাড়ির লোকেরা চিন্তা ভাবনা করবে, সেদিকেও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই ওর! ব্যাপারটা কী! কিছু ঘটেনি তো!
অনুমান মিথ্যে নয়। সামনে গিয়ে দাঁড়তেই আমায় জড়িয়ে ধরে সুলোচনা হু হু করে কেঁদে ওঠে। তারপর ধীরে ধীরে সাশ্রুনয়নে উন্মোচিত হতে লাগল ওর প্রতারিত জীবনের করুণ কাহিনি।
আজ থেকে প্রায় পনের বছর আগে নব-পরিণীতা সুলোচনা ইমিগ্র্যান্ট হয়ে কানাডায় পাড়ি দিয়েছিল প্রিয়তম স্বামী সন্দীপের হাত ধরে। জাতিতে ওরা দুজনেই মারাঠি। কলকাতায় একই কলেজে পড়ত দু’জনে। সন্দীপের বাবা ছিলেন একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। তৎকালীন কলকাতা শহরের পলিটিক্যাল পার্টির একজন বিশিষ্ট নেতা। উচ্চবিত্ত, সম্ভ্রান্ত ও ব্রাহ্মণ পরিবারের বংশধর। তারই সুপুত্র সন্দীপ যোগলেকর। কিন্তু সন্দীপ ছিল পিতার সম্পূর্ণ বিপরীত। রাজনীতির অঙ্গন থেকে একেবারে আলাদা। ও পড়াশোনার পাশাপাশি যন্ত্র সঙ্গীতে খুব পারর্দশী ছিল। গিটার প্লে করত। স্টেজে পারফর্ম করত। যেটাতে ওর পিতার একেবারেই অমত ছিল। আর সে কারণেই পিতার সাথে সম্পর্ক ভালো ছিল না। ইকোনমিক্সে মাস্টার্স করে বাবা-মার অজ্ঞাতসারে সুলোচনার সাথে কোর্ট ম্যারেজ করে পাড়ি জমায় কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে। তখন কচি বয়স সুলোচনার। আবেগে, উচ্ছ্বাসে একেবারে উতলা। আকস্মিক নিজস্ব গণ্ডি ছেড়ে বাইরের রঙিন পৃথিবীতে এসে ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিল। ভেবেছিল আকাশের চাঁদটাই বুঝি পেয়ে গিয়েছে ওর হাতে। আর নাগাল পায় কে! খুশির পাল তুলে মুক্ত-বিহঙ্গের মতো জীবন জোয়ারে ভাসতে থাকে। বিদেশি পর্যটকের মতো প্রচণ্ড বিস্ময় ও ঔৎসুক্য নিয়ে শহরের নানাবিধ মনোহরা দর্শনীয় স্থানগুলি একে একে ঘুরে দেখতে লাগল। যখন রামধনুর মতো ওর হ্রদয় আকাশে আবির্ভূত হয়েছিল চিরঞ্জিত সিং।
ততদিনে সন্দীপের কাঙ্ক্ষিত বাসনাগুলিও একে একে সব পূরণ হতে লাগল। মর্যাদাসম্পন্ন উচ্চপদস্থ চাকুরি, দেশিয় স্টাইলে আলিশান বাড়ি, গাড়ি, বিলাসবহুল আসবাবপত্র, অর্থ-বিত্ত-ঐশ্বর্য, দামি শাড়ি-গহনা, সব পরিপূর্ণ। স্বর্গসুখ ছিল সুলোচনার হাতের মুঠোয়।
ইতোমধ্যে সুযোগ্য পুত্রের আশাতীত সাফল্যের সুখবরে মনের ক্ষোভ, মান-অভিমান, অভিযোগ সব অপসারিত করে সন্দীপের মা-বাবা ভিজিট করতে চলে আসেন কানাডায়। যা আগে স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবা যায়নি।
কিন্তু বিধিই বাম! খণ্ডাবে কে! যোগলেকর পরিবারে অপ্রত্যাশিত এত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আনন্দ মঞ্জুর হলো না বিধাতার। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো একদিন হঠাৎ মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় সন্দীপের অপমৃত্যুতে নিভে গেল সুলোচনার ভালোবাসার প্রদীপ। ভেঙে চুরমার হয়ে গেল ওর সোনার সংসার, ভালোবাসার রাজপ্রাসাদ। অচিরেই জীবনে ঘনিয়ে আসে অন্ধকার। জীবন-নদীর খেয়া ওকে নিয়ে চলে অনিশ্চিত মোহনার দিকে। যেখানে কূল নেই, কিনারা নেই, নেই বেঁচে থাকার কোনো উপাদান। যা কোনদিন কল্পনা করতে পারেনি সুলোচনা, তাই ঘটে গেল ওর জীবনে।
সদ্য স্বামী হারানোর শোকে কাতর মুহ্যমান সুলোচনার ওপরে অমানবিকভাবে শুরু হয় শ্বশুর-শাশুড়ির শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, দুর্ব্যবহার, মিথ্যে কলঙ্ক-অপবাদ লেপন। নিষ্ঠুর নির্দয়ের মতো তাঁরা প্রতিনিয়ত শুধু বলতেন, ‘ডাইনি, পোড়ামুখী, রাক্ষসী, কুলাঙ্গার! দূর হ এখান থেকে। তোর কোনো অধিকার নেই এখানে থাকবার!’
একবারও ভেবে দেখলেন না, অকাল বৈধব্যে তারুণ্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে উনত্রিশ বছরের যুবতী একা কোথায় যাবে! কোথায় থাকবে! কিভাবে জীবনযাপন করবে! দূরদেশে যার কেউ নেই, কোন সাহারায় সে বেঁচে থাকবে! আর তখনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে চিরঞ্জিত সিং। যাকে মনে-প্রাণে ভালোবেসে ও বিশ্বাস করে সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছিল সুলোচনা। আর কৌশলে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে, মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে সুলোচনার অন্ধকার জীবনে আলোর পথ দেখাতে চিরঞ্জিতই ভ্যাঙ্কুভার থেকে ওকে নিয়ে এসেছিল টরন্টো শহরে। যদিও অন্তরাত্মা সাড়া দিচ্ছিল না, তবে বিবেকের দংশনের বিপরীতে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে সেদিন সুলোচনা মনে-মনে ভেবেছিল, দিনকাল বদলে গিয়েছে-বদলে গিয়েছে মানুষের রুচি, ধ্যান-ধারণা। সতীদাহ প্রথাও উচ্ছেদ করে দিয়েছেন রাজা রামমোহন রায়। তারুণ্যে বিধবার পুনর্বিবাহের রেওয়াজও বহুকাল থেকেই প্রচলিত। পাপ-পুণ্যের দোহাই দিয়ে, নিজের সাধ-আহ্লাদ, কামনা-বাসনাগুলিকে বিসর্জন দেবার চেয়ে জীবনকে নতুন রঙে নতুন ঢঙে সাজিয়ে তোলাই ঢের ভালো!
কিন্তু নারীর মন বড়ই নাদান। মতলবি পুরুষমানুষের ভণ্ডামী, সহসাই নারীর মনের আয়নায় ধরা পড়ে না। উপরন্তু, সে আবেগের বশীভূত হয়ে, দৃঢ় বিশ্বাসে ভর করে ভালো-মন্দ যাচাই না করেই অন্ধের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ভালোবাসার গহীন সমুদ্রে। যার কূল নেই, কিনারা নেই, নেই গন্তব্যর কোনো ঠিকানা।
সুলোচনা মনস্থির করে, টরোন্টো ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া শুরু করবে। স্বাবলম্বী হবে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে। শুনে খুব খুশি হয় চিরঞ্জিত। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ও যে কী মতলব আঁটছিল, তা ঘূণাক্ষরেও টের পায়নি সুলোচনা।
প্রতিদিন আর্লি মর্নিংয়ে দু’জনে একসাথে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেত। আবার বিকেলের দিকে একসাথেই বাড়ি ফিরত। সেদিন যথারীতি সুলোচনা বাড়ি ফিরে এসে দেখে, ঘরের দরজাটা আলতোভাবে খোলা। ভাবল, চিরঞ্জিত এসে পড়েছে। এখুনি চা-জলখাবার তৈরি করতে হবে। এইভেবে দ্রুত ঘরের ভিতরে ঢুকেই মাথায় যেন ওর বজ্রাঘাত পড়ে। এ কি! ঘর-দুয়োরের এ অবস্থা কেন? ঘরের জিনিসপত্র সব এলোমেলো! চারদিকে ছড়ানো। কোথায় চিরঞ্জিত? ও তো এখনো আসেনি! তবে কি বাইরের কেউ ঘরের ভিতর ঢুকেছিল? সর্বনাশ!
বিচলিত হয়ে পড়ে সুলোচনা। দ্রুত এ-ঘর ও-ঘর নজর বুলিয়ে দেখে, চিরঞ্জিতের পরনের জামা-কাপড়, কোট-টাই, দামি স্যুট কিছু নেই। লেদারের বড় একটা স্যুটকেস ছিল, সেটাও নেই। তার মধ্যেই সযত্নে রাখা ছিলো সুলোচনার কিছু গহনা, টাকা পয়সা, ল্যাডিং পেপার, কানাডিয়ান সিটিজেনশিপ পেপার, পাসপোর্ট সব। শুধুমাত্র পরনের কাপড় আর হাতের বালা দুটিই ছিল ওর একমাত্র সম্বল। একটা সুতা পর্যন্তও অবশিষ্ট ছিল না সুলোচনার। অথচ তখন একবারও মনে হয়নি যে, এসব চিরঞ্জিতের কাজ। ও-ই ওকে পথে বসিয়ে দিয়ে গেছে। আর ওর অপেক্ষাতেই বসে থাকে ও। কিন্তু কোথায় চিরঞ্জিত?
ও যে কখন এসে সব হাতিয়ে নিয়ে গিয়েছে, ঘূণাক্ষরেও টের পেল না সুলোচনা। এমনকি যে বাড়িতে ওরা থাকত, সেটাও অন্যের মালিকাধীনে চুক্তিবদ্ধ করে গচ্ছিত রেখে গিয়েছে। তারপরও বিরহ-কাতর সুলোচনার নিষ্পাপ মন চিরঞ্জিতের অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে ছিল! ওর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, চিরঞ্জিত ফিরে আসবেই! কিন্তু চাকুরির ইন্টারভিউ দেবার বাহানায় ভোরের প্রথম প্রহরে ঘন কুয়াশায় গা-ঢাকা দিয়ে বাড়ি থেকে সেই যে বেরিয়ে গিয়েছিল, আর ফিরে আসেনি চিরঞ্জিত। অথচ মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধান! অন্যান্য দিনের তুলনায় সেদিন নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল চিরঞ্জিত। কিছুদূর গিয়ে পিছন ফিরে বেশ কিছুক্ষণ সুলোচনার মুখের দিকে পলকহীন তাকিয়ে ছিল। তখন মনে হয়েছিল, হয়তো কোনো প্রয়োজনেই বোধহয়! কিন্তু দৃষ্টিটা অন্যদিনের তুলনায় একটু ব্যতিক্রম মনে হতেই ঘর থেকে ছুটে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল সুলোচনা।
এরইমধ্যে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চিরঞ্জিত মুখ ফিরিয়ে মায়া মরীচিকার মতো চোখের নিমেষে মিলিয়ে গেল ঘন কুয়াশার মাঝে। তখন কি একবারও ভাবতে পেরেছিল, চিরদিনের মতো বিদায় নিয়ে চিরঞ্জিত ওর জীবন থেকে একেবারেই অদৃশ্য হয়ে গেল!
সুলোচনা আজ পথের ভিখিরি। অনুতাপ আর অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হতে হতে জীবনের সব চাওয়া-পাওয়া, স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্ক্ষা, বিশ্বাস-ভালোবাসা, ভালোবাসার ইচ্ছা-আবেগ-অনুভূতি, কামনা-বাসনা জ্বলে পুড়ে সব ছাই হয়ে গিয়েছে। মরে গিয়েছে ওর বেঁচে থাকার সাধ। কোনো কিছুতেই আগ্রহ নেই, উৎসাহ নেই। কানাডার মতো দেশে থেকেও শুধু প্রাণটা নিয়েই এতিমের মতো শহরের অখ্যাত অলিতে-গলিতে অপদস্থ, প্রবঞ্চিত, লাঞ্ছিত হয়ে অস্তগামী সূর্যের মতো নিস্তেজ শরীরটা নিয়ে প্রহর গুনছে মৃত্যুর অপেক্ষায়।
বাংলাদেশ সময়: ১১১১ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০১৬
টিকে/