‘এই নেন’—হাতের সেল্যুলার ফোনটা এগিয়ে দেয় মুরাদ ভাই, ‘দেশে ফোন করেন’। আমি একটু থতমত খেয়ে যাই।
গত সপ্তায় রাসেল স্কোয়ারের কাছে আমাদের বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট ডর্মিটরির ব্রিটিশ টেলিফোনের কয়েন বক্স দেশে সামান্য ‘কেমন আছো-ভালো আছি’র বদলে কয়েকটা চকচকে কয়েন গিলে ফেলল।
রানীর দেশের একটা সোনালি পাউন্ডের পেছনে সারাক্ষণ কত্তগুলি দেশি টাকা মোহিনী বেশে ঘুরঘুর করে। চাকরি থেকে পড়তে আসা হলেও আমার স্কলারশিপের পরিমাণ খুব স্বাস্থ্যকর না, সবকিছুতে সুতরাং অনিচ্ছাতেও হিসাব চলে আসে। সে কারণেই কম ভাড়ায় বাড়ি খুঁজতে আসা।
ঘটনা নাকি তুচ্ছ না। ফারিহা তার বাড়ির ফ্রিজারে দু’প্যাকেট পেপারোনি আর সালামি এনে রেখেছে। মুরাদভাই কৌতূহলী হয়ে ইনগ্রেডিয়েন্ট লেবেল পড়েছেন, অন্যান্য সবকিছুর সঙ্গে গরু আর শুকরের মাংস সমান মাপে মিশিয়ে তৈরি। ভাবা যায়! মুরাদ ভাইয়ের বাসায় শুকরের মাংস প্রবেশ করেছে! কী মনে করেছে ফারিহা! ভাড়া দিয়ে থাকে বলে কি এ বাড়ির পবিত্রতা নষ্ট করার অধিকার তার আছে? কখনো না। আজকেই তাকে এ বাড়ি ছাড়তে হবে
ডাইনিং কাম রান্নাঘরটায় বিশাল এক জানালা। সিংক আর চুলার পাশে লম্বা কাউন্টার, সিলিং ঘেষা কাবার্ড। ঝকঝকে নতুন ফ্রিজ, একপাশে দেয়াল ঘেঁষে মাঝারি সাইজের ফ্রিজার।
মুরাদ ভাই বললেন, হ্যাঁ, অনেক পুরানা বাড়ি, ভাঙ্গাচোরা ছিল। মেরামত করাতে বেশ ক’দিন লাগল। রান্নাঘর সারাই উপলক্ষ্যে তার স্ত্রী আর সন্তানেরা কভেন্ট গার্ডেনের কাছে কোথাও তার ভাইয়ের বাড়িতে সাময়িকভাবে থাকতে গেছে। রান্নাঘরের পাশে লিভিং রুমের একদিকের নিচু ছাদ, ঢুকে মাথা ঝুঁকিয়ে ফেলতে হয়। বড় বড় সোফার গাদাগাদি, দেখে আমার অত ভালো লাগল না।
রান্নাঘরের তাকের ওপর বড় বড় কাচের বৈয়ামে চাল, ডাল, ঘি আর মশলা।
মুরাদ ভাই উদাস-দরাজ গলায় বলে—‘ইচ্ছা করলে এইগুলি রান্না করে খেতে পারেন’।
দেশে লং ডিস্টেন্স ফোন করতে দিচ্ছেন, চাল ডালের সাপ্লাই! হবুচন্দ্রের রাজত্বে এসে গেলাম নাকি! ভদ্রলোক দেখতেও কিছুটা ঐ রাজার সেনাপতি মার্কা। বড় চোখ, স্বাস্থ্য ফেটে পড়ছে। ভুঁড়ির আভাস স্পষ্ট, মাথায় বাবড়ি চুল, গোঁফ আছে। বেশিদিন হয়নি প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পালিয়ে বেড়ানো সেনাপতির ভূমিকায় তাকে দিয়ে অভিনয় করালে মেকআপ লাগবে না।
ক্লাসের এক বাঙালি ছাত্রের দৌলতে এঁর সঙ্গে যোগাযোগ।
বাড়িটা একটু দূরে, ক্লাসে যেতে হলে বেশ ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হবে। তবু রাজি হয়ে গেলাম। ঘরে ফিরে একটু ঘুমাতে পারা দিয়ে কথা। তা নইলে তো সারাদিন ক্লাশ, লাইব্রেরি এসব নিয়ে থাকব।
কয়েকদিনের ডর্মের জীবন স্যুটকেসবন্দি করে টানতে টানতে প্রিমরোজ হিলের তিনতলা বাড়ির দোতলায় এসে উঠলাম।
বাড়ি দেখতে এসে অত খেয়াল করিনি, নর্থ ওয়েস্ট লন্ডনে এই এলাকা সত্যি নয়নাভিরাম। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে রাস্তা আর তার দু’পাশে বাড়ি। কয়েক মিনিট হাঁটলে বিখ্যাত রিজেন্টস পার্ক, গোলাপ ফুলের কারখানা রাজকীয় এই পার্ক। রীতিমত অভিজাত এলাকা।
আমার ঘরটা বেশ ছোট। কোনোমতে সিঙ্গেল বিছানার পায়ের কাছে পড়ার ছোট্ট টেবিল বাদ দিলে একচিলতে জায়গা, জুতা আর বড়জোর ক্লাসে যাওয়া আসার ব্যাকপ্যাক রাখা যায়। মাথার কাছে মহার্ঘ জানালা আর লাগোয়া তাক জুড়ে বইপত্র রাখতে পেরে তবু কৃতার্থ হই। রাস্তার সঙ্গে, পাহাড়ের কোলে নেমে আসা আকাশের সঙ্গে যোগাযোগের সাঁকো কেবল জানালাটা। জানালা খুলে ভালো করে কান পাতলে মধ্য জুনের নিস্তব্ধতায় হরেক পাখির ডাক আর বিচিত্র শব্দ ভেসে আসে।
হুট হাট দু’একটা ছাড়া এ রাস্তায় গাড়িঘোড়াও ভদ্র, সংযত। একদিন শুধু লাল রঙের হুডখোলা জিপ সাঁ করে ছুটে গেল, চালকের পাশের আসনে স্বর্ণকেশী মেয়েটির মিনিস্কার্ট উন্মুক্ত শাদা উরুর ঝলক দেখিয়ে পাহাড়ের ওপরে কোন রাস্তা দিয়ে যেন মহাকাশের দিকে ছুটে গেল। খুব বেশি লোক চলাচলও দেখি না, অথচ সারি সারি বাড়ি, সাজানো। বন্ধ দরজাগুলির একই রকম গড়ন দেখে মনে হয় আলিবাবা’র চল্লিশ দস্যু এলে আবারো ঠিক বাড়িটি চিনে নিতে গোলমাল পাকিয়ে ফেলবে।
***
পরেরদিন বাড়ি ফেরার সময় টিউব স্টেশন থেকে বেরিয়ে অনতি দূরে সরু কাঠের ব্রিজের নিচে ততোধিক সরু খালের পানিতে হলুদ কদমফুলের মতো ভেসে থাকা বাচ্চা হাঁসেদের দিকে তাকিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকা শালোয়ার কামিজ পরা মহিলাটিকে দেখে খটকা লাগল। সঙ্গে তিনটি বাচ্চাও। তবু না থেমে হনহনিয়ে পার হয়ে এলাম।
আমি ঢোকার মিনিট দশেক পরেই ওই মহিলা এলেন। খটকায় ভুল ছিল না। মুরাদ ভাইয়ের স্ত্রী তাদের তিন সন্তান নিয়ে ফিরে এসেছে। ফুটফুটে সুন্দরী, একটু চৌকোনা মুখ, ছোটখাট, রোগার দিকে গড়ন, আর মাথায় চুল যেন কেউ কালো ছাতা মুড়ে দিয়েছে। হেসে ফেললে আপন আপন লাগল মহিলাকে।
‘আমাকে আপা বলেই ডাকো’,— মনসুর, মিনহাজ আর বুশরা নামের তিন পাঁচ আর সাত বৎসর বয়সী বাচ্চাদের মাকে ভাবী ডাকা বদলে দিলাম।
আপার কথায় ময়মসিংহের আঞ্চলিক টান। ইংরেজি শব্দের অকারণ প্রয়োগ প্রথমে কানে ধাক্কা দিলেও পরে বুঝলাম সে কথ্য ইংরেজি এভাবে বিদেশে থাকতে এসে শিখে গেছে। আমাকে নির্বিবাদে তুমি বলতে শুরু করায় বুঝলাম বাচ্চাদের মতো ‘ইউ’ শব্দের বাংলা করছে। ছেলেমেয়ে সবাই সারাক্ষণ ইংরেজিভাষী। মা’র বাংলা ওদের কাছে খাবি খেতে খেতে টিকে আছে।
দু’রাতের মাথায় আবিষ্কার করলাম নিচের তিনটি শোবার ঘরের সবকটি এঁরা ভাড়া দিয়ে দিয়েছে। অন্য দু’জন ভাড়াটের একজন বেড়াতে গেছে বার্সেলোনা। দিল্লির মেয়ে ফারিহা, আর্কিটেকচারের ছাত্রী, তার বেডসাইড টেবিলে ফটো (এ বাসায় শোবার ঘরগুলোয় তালা চাবির বন্দোবস্ত নেই)। আর দ্বিতীয়জন গুজরাটি বংশোদ্ভূত পর্তুগিজ, একটা কর্নার স্টোরে কাজ করে। আঠারো উনিশ বছর বয়সী ছেলেটা যেন উদয়াস্ত কাজ করতে জন্মেছে। শুধু ঘুমাবার জন্য ঘর ভাড়া নিয়েছে। আমার সঙ্গে মাত্র একবার দেখা হয়েছে। ভেবেছিলাম আমিই কেবল ভোর ভোর উঠে ক্লাস ধরতে ছুটব। কিন্তু আমার এলার্ম বাজার আগে এই ছেলে জুতার মশ মশ শব্দ তুলে সিঁড়ি ভেঙ্গে বেড়িয়ে যায়। রাতের বেলা টেইক এওয়ে রেস্তোরাঁর খাবার এনে ঘরে বসে খায়। প্রায়দিন ওর ঘরের মেঝেতে সেসবের ভুক্তাবশেষ আর কাগজের প্লেট ছড়িয়ে থাকতে দেখি।
আপা দু’কাপ চা বানিয়ে আমাকে ডেকে গল্প করে, ভাড়াটেদের খবরাখবর দেয়। সুপারমার্কেট থেকে কেনা আমার বাজার সদাই দেখে কোথায় গেলে মাত্র আড়াই পাউন্ডে একবস্তা পেঁয়াজ কিনতে পাব—তার ঠিকানা বলতে বলতে টেবিলে পড়ে থাকা নোটপ্যাডে নখ দিয়ে আকিবুকি কাটে। কার্ডফোন, আরো সস্তায় ব্রিকলেইন থেকে দেশে ফোন করার দোকানের খোঁজ পাই।
‘সবগুলি ঘর ভাড়া দিলেন, আপনাদের থাকতে কষ্ট হচ্ছে না?’
তিন বাচ্চা সামলিয়ে আপা বাইরে কাজকর্ম করতে পারে না। ঘরভাড়া তার আয়। চুপ করে যাই।
মুরাদভাই তো আয় করে! এই বাসা তো কাউন্সিলের ফ্ল্যাট, মাসে মাসে ভাড়া গুনতে হয় না। আমি এসব ভাবি, কিন্তু না বলা শোভন মনে হয়।
স্বামীকে সমীহ করে কথা বলে আপা।
তার স্বামী প্রতিবছর একবার আজমীর শরীফ যান—ভক্ত মুরীদান হিসেবে গরু জবাই করে ওরশ করে আসে। তাদের লিভিং রুমের দেয়ালে আজমীর শরীফ ভিজিটের বড় বড় ফটোগ্রাফ টাঙানো আছে।
এমনিতেও মুরাদ ভাই বাড়িতে থাকে না। একশ’ বিশ মাইল দূরের বার্মিংহামের বাঙালি রেস্টুরেন্টের প্রধান বাবুর্চি উনি। শুক্র শনিবারে তাকে ইয়াবড় ডেকচিতে মনোযোগ দিয়ে ল্যাম্ব কারি বানাতে হয়। রবিবারের বিকেলে বাড়ি ফিরে সোমবার ছুটি কাটিয়ে আবার ফিরে যান। যখন থাকেন, বাড়িতে প্রবেশ পথের দেয়ালে গাঁথা পেরেকে ঝোলানো তার টুপি জ্যাকেট থেকে গরম মশলা কষানো তরকারির গন্ধ পাই। ভদ্রলোক জাত বাবুর্চি, রান্না করতে ক্লান্ত হয় না। সোমবার সকালে আপা তার তিন ছেলেমেয়েকে ধোপদুরস্ত করে ট্যাক্সি ডেকে ইস্ট লন্ডনের দিকে কোন স্কুলে চলে যায়। সেখানে তার দেবর ভাসুরদের কেউ কেউ বসবাস করে। অন্যান্য দিনে ছেলেমেয়ে স্কুলে দিয়ে জা’য়েদের সঙ্গে কিটি পার্টি করে, বাজার ঘাট সেরে একবারে বিকেল বেলায় তিনজনের ব্যাগ বোচকাসহ বাড়ি ফেরে, ফেরার পথে কাঠের ব্রিজের ওপরে বসে, বাচ্চাদেরকে নিয়ে পানিতে ক্রীড়ারত হাঁস দেখতে খুব ভালো লাগে তার।
কিন্তু সোমবারে অন্য দৃশ্য। কর্মক্লান্ত ক্লান্ত মুরাদ ভাই ঘুমে থাকে, ছেলেমেয়েরা ফিসফিস করে কথাবার্তা বলে, পা টিপে হাঁটে। প্রায় নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়। আপা একই ট্যাক্সিতে আবার ফিরে আসে। মুরাদ ভাই ততক্ষণে ঘুম থেকে জেগে রান্নাঘর ধুয়ে মুছে চুলায় গরুর মাংসের চাপ রান্না চাপিয়েছে। এই একটা জিনিস আপা রাঁধতে পারে না। তার না কি ভালো লাগে না, যদিও মুখে ওড়না চেপে মুরাদ ভাইয়ের আশপাশে খাড়া থাকতে হয় তাকে। রান্নার সময় স্বামী যা যা চাইবে যোগান দিতে হবে। রেস্টুরেন্টের শেফ বলে কথা!
***
দু’ সপ্তাহ ছুটি নিয়ে আজমীর যাওয়ার আগে মুরাদ ভাই ফারিহাকে ঘর ছেড়ে দিতে বলে গেছে। ফারিহা খুব মিশুক স্বভাবের মেয়ে, পরিচয়ের প্রথম দিনেই আমার বিছানায় আসন পেতে বসে রাজ্যের গল্প করে গেছে। কিন্তু কিংস কলেজে হেলথ সায়েন্স পড়তে এসে নাভিশ্বাস উঠছে বেচারীর। রান্নাবাড়ার ধারে কাছে যায় না। ফ্রিজারে তৈরি খাবার কিনে ভরে রাখে। আর সকাল থেকে রাত অব্ধি ল্যাব আর লাইব্রেরি। ছুটির দিনে ঘুমায়, পারলে সারাদিন।
রান্নাঘরের ফ্রিজে আমাদের তাক ভাগ করা থাকলেও ফ্রিজারে সব একসঙ্গে, সবাই নিজের খাবার দাবার চিনি, অসুবিধা হয় না।
ঝামেলা বাঁধলো গত রোববার। মুরাদ ভাই ফ্রিজারে কী একটা খুঁজতে গিয়ে ফারিহার খাবার দাবার দেখে রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল। নিচতলা থেকে আমি হম্বিতম্বি শুনে উপরে উঠে এলাম।
রান্নাঘরের এক কোণে আপা দেয়ালের সঙ্গে মিশে আছে, ভয় পাওয়া চোখ। মুরাদ ভাইয়ের কোমরে এপ্রোন বাঁধা। সম্ভবত ভ্রমণের আগে পরিবারের জন্য কাবাব ইত্যাদি বানিয়ে রেখে যাবে।
ঘরের মেঝেতে যাবতীয় হিমায়িত মাছ মাংস আর সব্জি। স্ত্রীকে হুংকার দিয়ে ময়লা ফেলার প্লাস্টিক ব্যাগ আনতে বলছে।
ঘটনা নাকি তুচ্ছ না। ফারিহা তার বাড়ির ফ্রিজারে দু’প্যাকেট পেপারোনি আর সালামি এনে রেখেছে। মুরাদভাই কৌতূহলী হয়ে ইনগ্রেডিয়েন্ট লেবেল পড়েছেন, অন্যান্য সবকিছুর সঙ্গে গরু আর শুকরের মাংস সমান মাপে মিশিয়ে তৈরি।
ভাবা যায়! মুরাদ ভাইয়ের বাসায় শুকরের মাংস প্রবেশ করেছে! কী মনে করেছে ফারিহা! ভাড়া দিয়ে থাকে বলে কি এ বাড়ির পবিত্রতা নষ্ট করার অধিকার তার আছে? কখনো না। আজকেই তাকে এ বাড়ি ছাড়তে হবে।
‘কিন্তু মুরাদ ভাই’,—আমি বিনীত হয়ে বলি—‘ও তো আর আপনাকে খেতে বলেনি এসব। মেয়েটা হঠাৎ করে কোথায় বাসা খুঁজে পাবে?’
‘ওইটা আমার জানার কথা না’। মুরাদ ভাই ফ্রিজের মাছ মাংসের প্যাকেটগুলি তুলে তুলে কালো বড় গার্বেজ ব্যাগে ভরছেন, তার হাতেও গ্লাভস। চোখমুখ কঠিন, কপাল কুচকে আছে।
আমি হায় হায় করে উঠি। ইলিশমাছ, রুই মাছ, কাচকি মাছ, গরুর মাংস কী নেই? সব ফেলছেন কেন? রেখে দেন, রেখে দেন। আমি রান্না করে খাব।
‘না, আমি এসব হারাম জিনিসের সঙ্গে ছোঁয়া লাগছে, আমি যেসব খানা খাব না, সেসব আপনাকে খেতে দিতে পারি না’,—মুরাদভাই দৃঢ় সংকল্প।
আপা আমাকে চোখে ইশারা করে আর কথা না বাড়াতে বলে।
মুরাদ ভাইয়ের সীমানা ছাড়া ক্রোধের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পেরে আপার বিষণ্ণ মুখে পলকা তৃপ্তি দেখি।
সেদিন বিকেলে রান্নাঘর পরিশুদ্ধ করতে মুরাদভাই টুপি পাঞ্জাবি পরে চেয়ারে বসে সুরা পড়েন। ডাইনিং টেবিলের মধ্যখানে গতবছর আজমীর শরীফ থেকে আনা আগরবাতি জ্বলে জ্বলে ঘ্রাণ ছড়ায়। মুরাদভাইয়ের আনা স্কার্ফে কপাল ঢাকা ঘোমটা দিয়ে আপা রাতের খাবার বেড়ে দেয় ছেলেমেয়েসহ মুরাদ ভাইকে। একমাত্র ভাড়াটে বাড়িতে থাকায় আমিও নিমন্ত্রণ পাই।
***
সারা সপ্তা সকাল ছ’টায় ঘুম থেকে উঠতে হয়। শনি রবিবারের সকালে তাই ঘুমানোর সুযোগ থাকলেও ‘ঘি হজম হয় না’ স্টাইলে আমার ঘুম ভেঙে যায়। খালি পেটে পানি খাওয়া অভ্যাস আমার। এক গ্লাস পানি নিয়ে জানালার ব্লাইন্ডস টেনে সরিয়ে দিই। জুন মাসের বাতাসে একটু হেঁটে আসা যায়। খুব সাবধানে আমি জানালার পাল্লা উপরে ঠেলে তুলে দিই। ক্যাচর ক্যাচর শব্দ করে। সামান্য শব্দ, কিন্তু আমার মতো মানুষের পাতলা ঘুম নস্যাৎ করার পক্ষে যথেষ্ট, অন্য কারো যদি আমার মতো থেকে থাকে। আমি আপার কথা ভেবে আরো সতর্ক হই। ভদ্রমহিলা রাতে কম ঘুমায়, টের পাই। প্রায়ই রান্নাঘরের লাইট জ্বলে, মুরাদ ভাই তার সেল্যুলার ফোন রেখে গেছে, হয়তো তার সঙ্গে ফোনে কথা বলে। এই একটা জায়গা ছাড়া রাতে তার হাঁটাচলা বড় সীমিত।
সকালের নাস্তা নিয়ে বসেছি এমন সময় আপা আসে। তার মুখে স্নিগ্ধ বিষণ্ণতা। চুল খোলা। আমি উৎসাহ নিয়ে বলি—‘আপা আপনার চুলে স্টেপকাট দিয়ে আনি চলেন। খুব সুন্দর লাগবে’।
‘না না,না ভুল করেও না। তোমাদের ভাইয়া আমার চুল কাটা পছন্দ করে না’।
‘এখন তো মুরাদ ভাই কাছে নাই, চলেন যাই, আপনের নিজের জন্য কাটেন’।
আপা কাছের মানুষকে প্রশ্রয় দেয়ার হাসি হাসে।
‘আপনি দেশে যান না আপা?’
‘উমম... দেশে? নাহ, যাওয়া হয় না। ছেলেমেয়ের স্কুল থাকে’।
‘গরমের ছুটিতে তো যেতে পারেন। এই এখন দুই মাস বন্ধ না?’
আপা স্টিলের সিংকে ব্লিচ ঢেলে স্পঞ্জ দিয়ে ঘষতে থাকে। হাতে হলুদ রঙে দস্তানা। নিবিষ্ট মনে ঘষে ঘষে কারি মশলার দাগ তুলছে।
আমি এককাপ চা বানিয়ে আমার ল্যাপ্টপ নিয়ে আবার ডাইনিং টেবিলে বসে। চা খাওয়া হলে একটু কাজ এগিয়ে রাখব। আপাকে দেখে গল্পের মুড চলে আসে। চেয়ারে পা উঠিয়ে আয়েশ করে খাই।
‘শেষ কবে দেশে গেছিলেন আপা?’
এবার কাজ থামিয়ে পরিপূর্ণভাবে আমার দিকে তাকায়। তার কালো কাচের মতো চোখে কেমন মর্মভেদী চাউনি।
‘আমি এখানে আসার পরে আর দেশে যাইনি’।
‘বলেন কী? কত বছর’, আমার আড্ডা জমানোর কায়দায় নিষ্ঠুরতা আছে কি? আপার চোখ মুখ থমথমে।
‘সতের বছর তিন মাস উনিশদিন’।
আমি টোস্ট করা স্ক্র্যাম্পেটের ওপরে বাটার লাগিয়ে মধু ঢেলে কামড় দিই। সকালবেলায় চায়ের সঙ্গে আমার পছন্দের নাস্তা।
‘একদম দিন গুনে রেখেছেন আপা, ও মাই গড!’
‘আমি মনে রাখি না, আমার মা মনে রাখে। ফোন করলে বলে দেয়’।
না ঘন ঘন মা’র সঙ্গে কথা হয় না তার। হঠাৎ হঠাৎ সুযোগ পেলে। এই যে মুরাদ ভাই তার সেলফোন রেখে গেছে, লং ডিস্টেন্স কল অপশন আছে, আপা তার সদ্ব্যবহার করছে।
ফোনের ওপারে অপেক্ষারত, মেয়ের জন্য দিনগোনারত মাকে দেখতে পাই।
আজকে মা’র সঙ্গে কথা বলে আপার মন ভালো। রবিবারে রান্নার আয়োজন করছে সে। শাক সব্জি কাউন্টারে চপিং বোর্ডে কাটাবাছা চলছে। আমি আমার ছোট্ট সিডি প্লেয়ারটা এনে রবীন্দ্র সঙ্গীত চালিয়ে দেই। সুর ঘর ছাড়িয়ে বাইরে যেতে চায়। আপা খুশি মনে মাথা দোলায়। তার ছেলেমেয়েরা ঘরে টিভি দেখছে। এরা তেমন খেলাধুলার ভক্ত না। জানতে চাইলে আপা বলে—‘এই ভালো, বেশি বাইরে গেলে আমি কি নিয়ে থাকব?’
কী অদ্ভুত যুক্তি। আরে, আপনার নিজের জন্য ওদের বেড়ে ওঠার অন্তরায় হবেন? আমি তেড়িয়া তর্ক করি। কী ফুটফুটে ছেলেমেয়ে তিনটা! মেয়েটা একটু মোটার দিকে যাচ্ছে। আট বছরের মেয়েকে দেখায় দশবারোর মতো। নিউট্রিশনের ছাত্রী আমি, খুব বুঝতে পারি যে ওর এখনি ডায়ট চার্ট না বানালে, ঠিকমতো শরীর চর্চা না ধরালে মেয়েটি ভবিষ্যতে মোটা বলে বন্ধুদের মধ্যে হীনমন্যতায় ভুগবে। বলেও ফেলি সে কথা। আপা হঠাৎ অন্যমনস্ক, আমার কথা যেন শুনতে পায়নি। খুব মনযোগে একটা কাঠের বাক্স বের করে, তাতে খোপে খোপে মশলাপাতি।
আমি লাফ দিয়ে উঠে কাছে যাই।
‘এই মশলার বাক্সটা আমার মায়ের। মা যেসব মশলা রাখত সে সব দেশি দোকানে খুঁজে খুঁজে জমিয়ে রেখেছি’। পোস্তদানা, শরিষা, পাঁচফোড়ন, আর ছোট কৌটায় হিং। আর বাকি খোপগুলোয় এলাচ, লং এইসব। ঝিঙ্গে ছিলতে ছিলতে আপা কথা বলে। আজকে সে নিরামিষ রাঁধবে।
***
মাথার কাছে জানালা খুলে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। রাতের হিমে গলার কাছে কফ জমা অনুভূতি টের পাই।
প্রিমরোজ হিলে রাত ফিকে হচ্ছে, এখনি উঠে পড়া ভালো। এ্যাসাইনমেন্টের কাজ কিছুটা এগিয়ে রাখা যায়। এককাপ কফি বানিয়ে এনে বসব নাকি? ওপরে রান্নাঘরে সব সরঞ্জাম। খালি পায়ে পা টিপে টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে উঠলে শব্দ কম হবে। দরজা সামান্য ক্যাচ করে। আমি বেশ সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে উঠি।
রান্নাঘরে আলো জ্বলছে না, তবে খোলা জানালা দিয়ে বাইরের আলো এসে আবছায়া তৈরি করেছে।
জানালার কাছে চেয়ার টেনে আপা বসে আছে। আমার দিকে পিঠ। ফোঁপানোর শব্দ পাচ্ছি আমি।
এক পা পিছিয়ে সিঁড়িতে স্থির হয়ে যাই।
‘মা, তুমি ডাক্তার দেখাইতেছো না কেন মা? দাদারে বলো তোমারে ঢাকায় নিয়া ভালো চোখের ডাক্তার দেখাইতে। চোখের ছানি কাটাইলে একদম ভালো হইয়া যাবা, আর কান্নাকাটি বন্ধ করো মা’।
ওপারের কথা শোনা যায় না।
‘মা তুমি দাদারে বইলো, পূজার আগে আগে আমি টাকা পাঠামু। আর মা আমার কথা বইল না কিন্তু বাবারে একটা পাঞ্জাবি আর দামি ঘড়ি কিনা দিবা। আমি জানি মা, আমার কথা বললে কি আর বাবা ঘড়ি টড়ি নিবে? দেবাশীষরে ভালো করে পড়ালেখা করতে বলো, ও ভর্তি হইয়া আমেরিকা যাইতে পারলে ভালো হইত না? না, এইদেশে আসার দরকার নাই, অরে বইল আমেরিকা, কানাডা নাইলে অস্ট্রেলিয়া যাইতে’।
আপা উঠে ট্যাপ ছেড়ে গ্লাসে ভরে পানি খায়।
দেশে এখন ক’টা বাজে ইত্যাদি কথাবার্তাসহ, ‘আমি বাসার মোবাইল থাইকা ফোন করতেছি’র পরে ‘আমি ভালো আছি মা’, আর আরো দু’বার ‘মা মাগো’ ডাক দিয়ে ডুকরে ওঠা শুনি।
স্থাণু হয়ে মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে থেকে অপরাধী মনে হয়। থাকি। সিঁড়ি বেয়ে বেড়ালের মতো নেমে আসতে পারি। আপা তখনো কথা চালিয়ে যাচ্ছে। ঘরে ফিরে জানালা দিয়ে ফিকে হয়ে আসা ভোর দেখা যায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৭ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০১৬
টিকে/