হাসপাতাল, হজপিস ও হজপিস আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
সুইজারল্যান্ড দেশটি শতকরা নব্বই ভাগ পাহাড়-পর্বতে ঘেরা। এ দেশটিতে কোনো সমুদ্র নেই।
হজপিসের মূল উদ্দেশ্যটি হলো, মৃত্যুর জন্য শেষযাত্রার যাত্রীকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা। মৃত্যুভয়কে জয় করা মোটেই কোনো সহজ কাজ নয়। তবে রোগীকে সঙ্গ দিয়ে কর্মী যদি তার বিশ্বাস অর্জন করতে পারে তাহলে অনেক সময়ই দেখা গেছে, আসার প্রথমদিন যে যাত্রী মৃত্যুভয়ে মুখ শুকনো করে সবসময় চুপচাপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে, কর্মীর সহৃদয় বন্ধুত্বে দুই-তিনদিন পরই সে হেসে হেসে কথা বলেছে এবং মুত্যুকে অন্য একটি শহরে বেড়াতে যাওয়ার মতো সহজ করে শেষবিদায় নিয়ে রস-রসিকতাও করেছে। এখানেই হজপিসকর্মীর সফলতা। ‘মুত্যুর পর জীবন’-এ যার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে, সে আর তার আসন্ন মৃত্যুকে ভয় করে না। মুলত এ মৃত্যুভয়টি, শেষযাত্রায় যে রওনা হয়ে গেছে, হজপিসকর্মী তার মন থেকে দূর করার আন্তরিক প্রচেষ্টা করে। অভিজ্ঞ কর্মীর স্মৃতিতে অনেক শেষসঙ্গের কাহিনি জমা থাকে। সেসব থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে সে তার বর্তমান রোগীকে উৎসাহ যোগায়। চিন্তা আর কথা শোনা দু’টি সম্পুর্ণ আলাদা জিনিস। চিন্তা ব্যক্তিগত ও সাধারণত বদ্ধমুল। দু’পক্ষের আলোচনায় দ্বিতীয়-তৃতীয় মত শুনে মূল ধারণাটি শিথিল হয়ে যায়। দৃষ্টি হয় সম্প্রসারিত। রোগী বিশ্বাস করে, জীবন ও মৃত্যু নিয়ে নতুন যেসব কথা সে শুনছে, তা সবই বাস্তবের আলোতে উদ্ভাসিত।
আপাতদৃষ্টিতে হাসপাতালে নার্সরা, সেবাকর্মীরা দিনরাত রোগীর জন্য উপস্থিত থেকে তার অসুবিধা, সমস্যায় যা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, তা নেওয়ার চেষ্টা করে। মনে হয়, রোগীদের জন্য তাদের উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগ আন্তরিক ও অকৃত্রিম। কিন্ত রোগীর শারীরিক চিকিৎসা সংক্রান্ত আনুসঙ্গিক ব্যাপারগুলো এবং তার আত্মিক সঙ্গের একটা বড় অংশই অচেনা ব্যক্তিদের উপর নির্ভর। যাদের অধিকাংশই হলেন নার্সরা। প্রায় সব সময়ের জন্য এরাই দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের সঙ্গে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ও নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে থাকেন। তাদের সচেতন ও সহৃদয় যত্ন নেওয়া রোগীর শারীরিক ও আত্মিক সুস্থতার জন্য অপরিহার্য।
এটা বোঝা অত্যন্ত প্রয়োজন, তারা এসব কর্তব্যপালন কীভাবে করে থাকেন? তারা কি একক ক্রিয়াকর্মের নেপথ্যে শুধুই একটি পেশাদারী রুটিনমাফিক দায়িত্ব সম্পাদন করে থাকেন নাকি তাতে স্নেহশীল ও ব্যক্তিগত উদ্বেগও বিদ্যমান? দীর্ঘদিন হাসপাতালে যারা থেকেছেন তারা কিন্ত এ সম্পর্কে কোনো মতামত দিতে দ্বিধাবোধ করেন। হাসপাতালের ডাক্তার নার্স ও অন্য কর্মীদের প্রতি তাদের একধরনের কুতজ্ঞতাবোধ জন্ম নেয়। আত্বীয়স্বজন না হয়েও এই অজানা অচেনা ব্যক্তিরা যে তাদের দিনরাত্রি দেখাশুনা করেছেন ও সেবা যত্ন করছেন তার প্রভাবেই তারা আচ্ছন্ন হয়ে তাদের কর্তব্যপালনে রুটিন না হৃদয়, কোনটি মূল কারণ- এ নিয়ে অধিকাংশ রোগীই আর পরে ভাবেন না।
কানাডার একটি সাধারণ সরকারি হাসপাতালের হসপিজ বিভাগের উপর একটি ডকুমেন্টারি ছবি নির্মাণ করা হয়। এতে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের এবং মৃত্যুশয্যায় শায়িত শেষযাত্রার যাত্রীদের সঙ্গে হজপিসকর্মীদের সহৃদয় এবং মমতাময় ব্যবহারের কিছু সময়চিত্র ধারণ করা হয়েছিলো। এ ছবিটির প্রদর্শন আমাদের প্রশিক্ষণ কোর্সের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। দেখানোর আগে প্রশিক্ষক একটি সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে এটার বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করলেন। তিনি বললেন, যে সমস্ত রোগীদের এ ছবিতে দেখানো হবে তারা সবাই দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। তাদের হাসপাতালে একটি বিশেষ বিভাগে স্থানান্তরিত করা হয়েছে, যেখানে তাদের জীবনের শেষ সময়ের আশা, ইচ্ছা ও প্রয়োজনগুলো যথাসম্ভব পুরণ করার চেষ্টা করা হয়। শুধু শারীরিক নয় তাদের আত্মিক অভাব-অভিযোগগুলোর দিকেও বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হয়ে থাকে। যারা চান, তাদের জন্য আধ্যাত্মিকসঙ্গেরও ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। এজন্য ডাক্তার নার্স ও হজপিসকর্মী ছাড়াও সঙ্গীত থেরাপিস্ট, ধর্মযাজক, সাইকোলজিস্ট, সমাজকর্মী এবং স্বেচ্ছাসেবীরাও রোগীদের প্রয়োজনে উপস্থিত হন। ডাক্তাররা এ ব্যাপারে একমত যে, এখানে যেভাবেই হোক বিভিন্ন ওষুধপত্র বা নানাবিধ যন্ত্রপাতি প্রয়োগ করে আয়ু বাড়ানো নয় বরং রোগীর মাত্র যে কয়েকটি দিন বাকি রয়েছে, তা যথাসম্ভব সন্তুষ্টি আর সান্ত্বনায় ভরিয়ে দেওয়া। সাইকোথেরাপিস্টও রোগটি সারানোর চেষ্টা করেন না বরং মানসিকভাবে রোগীকে উৎসাহিত করেন, যেসব কর্মীরা তার জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো সঙ্গ দিয়ে তাকে সজীব আর উৎফুল্ল রাখার চেষ্টা করেছেন তাদের প্রচেষ্টা যেনো মোটামুটি সফল হয়। শরীরের অসহ্য ব্যথাবেদনা মাঝে মধ্যে হিপনোটাইজের মাধ্যমে দূর করারও চেষ্টা করেন তারা। যার লক্ষ্য রোগ সারানো নয় (এ রোগটি আর সারবেও না) বরং মানসিকভাবে ব্যথার দংশনটির পাশ কাটিয়ে অন্যকিছুতে তার মনোনিবেশ করতে সাহায্য করা। অন্যদিকে রোগীর জন্য এটাও আনন্দের ব্যাপার, যে সামান্য ইচ্ছাশক্তিটুকু তার তখনও অবশিষ্ট রয়েছে তা দিয়ে কষ্ট সহ্য করা নয় বরং জীবনটাকে উপভোগ করার জন্য সেটার পূর্ণ সদ্ব্যাবহার করা। এ বিভাগে অবস্থানরত অধিকাংশ রোগীকেই নানাধরনের অষুধপত্র দিয়ে স্নায়বিক ও শারীরিক ব্যথা আর অস্থিরতা কমানোর ব্যবস্থা করা হয়। কিন্ত ওষুধগুলোর পরিমাণ এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় যে, তাতে রোগীর স্বাভাবিক চেতনায় কোনো অবস্থাতেই যেনো কোনো প্রভাব না পড়ে। হজপিসে রোগীদের সামগ্রিক সুখ-স্বাচ্ছন্দের জন্য যে ব্যবস্থা রোগীর শারীরিক বা মানসিক অবস্থার উন্নয়নে সাহায্য করে, তা তৎক্ষণাৎ নেওয়া হয়ে থাকে। তার বিছানায় কী ধরনের তোষক দেওয়া হলে তার শুয়ে বেশী আরাম হবে, এ জাতীয় ব্যাপারেও বিশেষভাবে যত্ন নেওয়া হয়ে থাকে। বসার জন্য সোফা কোনটি উপযোগী বা অর্ধাঙ্গ অবশ রোগীদের জন্য কোন হুইলচেয়ারটি বেশী আরামদায়ক, এসবও হজপিসকর্মী রোগীর বসার ভঙ্গি বা চলাফেরা থেকে বোঝার চেষ্টা করেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন। কর্মী আর স্বেচ্ছাসেবীরা অসীম ধৈর্য আর বুকভরা স্নেহ নিয়ে মৃত্যুশয়্যায় শায়িত এসব রোগীদের তাদের আত্বীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব আর সন্তানদের বিকল্প হয়ে সেবা আর আদর-যত্নে তাদের শেষ দিনগুলোতে সঙ্গ আর সান্ত্বনার প্রলেপ দিয়ে মৃত্যুরভয়কে উত্তীর্ণ করে অন্যলোকে যাত্রায় তাকে প্রস্তুত করেন। বিশেষ করে রোগীর জন্মদিনে, কোনো ছুটি বা উৎসবের দিনে কর্মী দীর্ঘদিনের পরিচিত গৃহ আর পরিবার থেকে দূরে হজপিস ভবনে মৃত্যুশয্যায় শায়িত রোগীকে আপনজনের মতো সঙ্গ দিয়ে এসব দিনের ব্যথা আর বেদনাকে ভুলে বর্তমান পরিস্থিতিতেই তাকে আনন্দিত হতে উৎসাহিত করেন। এ কর্তব্যগুলো মোটেই সহজ নয়। এতে তাৎক্ষণিক বুদ্ধি ও অনেক কল্পনাশক্তির প্রয়োজন।
যার মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে তার এ খবরটি অন্য রোগীদের কাছে কখনও গোপন করে রাখা হয় না। সরাসরিভাবে এসব মৃত্যুর বিবরণ অন্যদের কাছে বলা হয়ে থাকে যেনো তারা জানেন, আসন্ন মৃত্যুটি তাদের একার জন্য নয়। এতে মৃত্যুভয় কমে যায়। বলা হয়ে থাকে সুখে মানুষের ঐক্য হয় না। কিন্ত একই ধরনের দুঃখ, বিরূপ পরিস্থিতি ও সমান প্রেক্ষাপটে একটা দলীয় বোধের জন্ম দেয়। রোগী মনে করে, দুঃখটি আমার একার নয়, আমি একাই মরছি না, ওইতো গতকাল আমার পাশের ঘরের অমুক মারা গেলেন, আমিও আজকালই যাত্রা শুরু করবো। পরে বাকিরাও আমার সঙ্গে যোগ দেবেন। সম্পূর্ণ একা বাড়িতে মৃত্যুশয্যায় শায়িতের এ ধরনের সহানুভূতির উদ্রেক হয় না। এজন্যও হজপিস ভবনে এসে শেষযাত্রার প্রস্তুতিটি নিতে আজকাল অনেকেই আগ্রহী। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ওই বিশেষ বিভাগে উপস্থিত একজন রোগী এই ছবি নির্মাণকারী দলকে বলেন, ‘এটি একটি সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা যে, এখানে দিনরাত কর্মীরা আমার খোঁজখবর নেন। সবারই আমার অবস্থা নিয়ে আন্তরিক। শুরুতে এখানে বদলি হয়ে এসে, সত্যি বলতে কী আমার ভীষণ ভয় হতো। কারণ, আমি মনে করেছিলাম ওখানে যাওয়া মানেই মরে যাওয়া। এখন আর সে ভাবনাটি নেই। আমি এখানে একজন স্বাভাবিক মানুষের মতোই থাকছি। বাড়িতে যেমন একা একা সবসময় মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা করতাম, সেরকম নয়। ’
যখন একজন ডাক্তার পুরোপুরি নিশ্চিত হন যে, এ রোগের আর কোনো চিকিৎসা নেই, তখন তিনি ভাবেন তাকে এখন অন্য একটা ব্যবস্থা অবশ্যই নিতে হবে! এবং এ যাবত নেওয়া যাবতীয় ব্যবস্থার চেয়ে সেটি অবশ্যই আরও বেশী কার্যকরী হতে হবে। এ ধরনের চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতার আলোকে এবং বিশেষ করে এ সত্যটি মনে রেখে, বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আনীত প্রতি দু’জন মুমূর্ষুদের মধ্যে একজন মারা যান, সেখানে হাসপাতালে মুমূর্ষুদের বাস্তবিকপক্ষেই কি কোনো কার্যকরী সাহায্য বা সঙ্গ দেওয়া সম্ভব? ওষুধপত্র দিয়ে (বা নানাবিধ আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে) যেখানে আর কোনো চিকিৎসা সম্ভব নয়, সেখানে একমাত্র একটি জিজ্ঞাসাই আসে, মৃত্যুপথযাত্রীর এ শেষ সময়ে, মৃত্যু যেখানে অনিবার্য, তার জন্য কোনো আধ্যাত্মিক গুণগতজীবনের (কোয়ালিটি অব লাইফ) কার্যকরি কোনো ব্যবস্থা কী এখন নেওয়া সম্ভব নয়? কিন্ত অপ্রিয় হলেও এটা সত্য যে, মুত্যুপথযাত্রী যখন তার শেষ কয়েকটি সপ্তাহ বা দিনগুলো ‘সত্যিকার অর্থে বেঁচে থাকার দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করে’ সে বাসনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত পরিবেশ হাসপাতালের মূলত আমলাতান্ত্রিক আর যান্ত্রিক আবহাওয়ায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। যারা পরিস্থিতির শিকার হয়ে বাড়িতে আত্বীয়স্বজনের সঙ্গে জীবনের শেষ কয়েকটি দিন কাটানোর সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত এবং যারা হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুধু নিয়মিত অষুধ খাওয়া আর রুটিনমাফিক ডাক্তার-নার্সদের দেখাশুনার বাইরে একটু কিছু বেশী আশা করেন, তাদের জন্য হজপিস ভবন একটি কার্যকরী বিকল্প। এ ধরনের আশ্রয়স্থলগুলো এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া-কানাডার মতো ধনী রাষ্ট্রগুলোতেই রয়েছে। লন্ডনের সেন্ট ক্রিস্টোফার হাসপাতালের হজপিস বিভাগের একটি প্রচারমূলক টিভি সম্প্র্রচারে যখন দেখানো হলো, তারা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের অসহ্য ও ক্রনিক শারীরিক ব্যথার জন্য একটি স্বস্তিদায়ক পদ্ধতি (রোগীর দেহে ইঞ্জেকশন দিয়ে নিয়ন্ত্রিতভাবে তরল মরফিন দেওয়া) বের করে অসংখ্য রোগীর যন্ত্রণার উপশম করেছেন, অনেক আত্মীয়-স্বজন হাসপাতালে থাকা তাদের এ ধরনের রোগীদের তখন সেন্ট ক্রিস্টোফার হাসপাতালে বদলি করার জন্য চেষ্টা করেন।
হজপিস একটি পরিবারের মতো, এ বাক্যটি থেকেই সেখানকার পরিবেশটির চরিত্র অনুধাবন করা যায়। এটাও সত্য, বাড়িতে যেসব দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীরা আত্মীয়-স্বজনদের সেবাযত্নে থাকেন, তাদের শারীরিক ব্যথা উপশমের কার্যকরী ব্যবস্থাও খুবই সীমিত। আত্মীয়-স্বজনরা ব্যথা নিরসনের জন্য নতুন ওষুধ দিতে ইতস্তত করেন, ভয়ও পান। যেখানে হাসপাতালে এসবের ব্যবস্থাপত্র বিনা দ্বিধায় দেওয়া হয়। আবার সঙ্গে সঙ্গে এটাও ভুললে চলবে না, যৌথভাবে রোগীর ও তার আত্মীয়-স্বজনদের জন্য আত্মিক, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক সমস্যার বিষয়গুলো হাসপাতালের রুটিনমাফিক চিকিৎসায় মোটেই বিবেচিত হয় না। এটা আত্মীয়-স্বজনের জন্য একটা অতিরিক্ত উৎকণ্ঠা। হাসপাতালে শুধুমাত্র রোগের চিকিৎসা করা হয়। রোগীর অন্য মানসিক সমস্যাগুলো দেখার জন্য এখানে প্রয়োজনীয় পেশাদারী বা কর্মীদের বেতন দিয়ে রাখার ব্যবস্থাও কোনো হাসপাতালের বাজেটে রাখা হয় না। আত্মীয়-স্বজনরা প্রায়ই আরও অভিযোগ করেন, ডাক্তাররা রোগীদের ব্যাপারে কোনো বিস্তৃত আলোচনা বা প্রয়োজনীয় তথ্যাবলি দিয়ে তাদের সঙ্গে বেশী সময নিয়ে কার্যকরী কোনো আলোচনাই করতে চান না। এর কারণ, একটাই, অতোটা সময় হাসপাতালে কর্মরত কোনো ডাক্তারের কাছে নেই।
একজন অসন্তুষ্ট আত্মীয়ের ক্রুদ্ধ উক্তি, ‘আমার প্রশ্ন, মা হয়ে হয়ে আমাকে কেন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত সন্তানের আসল খবরটি জানার জন্য ডাক্তারের পেছনে নিয়মিত ধরনা দিতে হবে এবং কেনই বা ভিক্ষুকের মতো তাকে অনুনয়বিনয় করতে হবে আসল কথাটি বলার জন্য? এতোকিছুর পরেও ডাক্তার সাহেবের সময়ই হয় না দু‘দণ্ড আমার সঙ্গে কথা বলার! অন্য ডাক্তারদেরও আমি একই প্রশ্ন বারবার করেছি। কারও সময় নেই। আমাকে বাধ্য হয়ে বইপুস্তক পড়ে বা পরিচিত যারা এ রোগ সম্পর্র্কে অবগত তাদের সঙ্গে কথা বলে তথ্য যোগাড় করতে হয়েছে। কিছু বন্ধুস্থানীয় ডাক্তার যারা এ হাসপাতালে কাজ করেন না, তারা আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। অন্য ক্লিনিকেও আমি গিয়েছি এ সম্পর্কে জানতে। এসব জানার পর আমি আমার মেয়ের যিনি চিকিৎসা করছেন, হাসপাতালের সেই ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে তাকে বলেছি, কেন তিনি আমাকে এতোদিন সত্য কথাটি বলেননি? বরং সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রোগটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আমাকে মিথ্যা কথা বলেছেন। এবারেই তিনি আমার সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করতে রাজি হলেন। কিন্ত তার কাছ থেকে সত্য কথাটি জানার জন্য আমার এর ওর কাছে কতোদিন যে ঘুরতে হলো! এর কি সত্যিই কোনো প্রয়োজন ছিলো, যদি তিনি প্রথমদিনই সত্যি কথাটি আমাকে বলতেন? ডাক্তারদের সরাসরি হ্যাঁ বা না বলার অপারগতা বা তাদের বিশেষজ্ঞসুলভ দুর্বোধ্য আলোচনায় আমি সবসময়ই রিবক্ত বোধ করি। সেসব কথার একাধিক অর্থ হয় বা যার কোনো মানেই বের করা যায় না। কিছু সরাসরি মন্তব্য বা সহজ সূত্র আমার জন্য অনেক স্বস্তিদায়ক হতো। তার তথাকথিত বিশদ আলোচনায় আমি বুঝতেই পারলাম না, আমার মেয়ের শারীরিক কষ্টের চাইতে মানসিক যন্ত্রণাই বেশী কিনা!’
এছাড়াও অসুস্থতার জন্য বা অন্য কোনো পরামর্শের জন্য দেখা করতে গিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করাটাও আত্মিক বোঝা হয়ে নিতান্তই একটা মহাবিরক্তিকর ব্যাপার হয়ে যায়। তারপরও দেখা যায়, অনেক সময় অপেক্ষার পর ডাক্তারের ঘরে ঢোকার সময়টি যখন এলো, তা নিতান্তই কম। কারণ, আরও অনেকেই বাইরে বসে রয়েছেন।
এ ধরনের দুঃখজনক ব্যাপারগুলো বেশী ঘটে হাসপাতালে ডাক্তারের ভিজিটিং আওয়ারে। বাইরের ডাক্তারের চাইতে সঙ্গত কারনেই হাসপাতালে ডাক্তারদের সময় অনেক কম। হাসপাতালের বিভিন্ন দুর্বোধ্য ও আপাতদৃষ্টিতে বেশকিছু অপ্রয়োজনীয় বিধি-নির্দেশে আত্মীয়-স্বজনরা সর্বদা অসহায় বোধ করেন। এই বিধি-নিষেধগুলো ও সময়সূচি মূলত যান্ত্রিকভাবে হাসপাতালের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড সঠিকভাবে পালনের জন্য। কিন্ত রোগীর বা তার আত্মীয়দের সঙ্গে নিকট, মানবিক বা সহৃদয় ব্যবহারের মোটেই অনুকূলে নয়। মানুষ যে কোনো যন্ত্র নয়, তা এই সব নিয়ম যারা বানান, তাদের বিবেচনায় থাকে না। সেবা-শুশ্রুষা, বন্ধুত্ব, মানবতা এসব নিষ্পাপ ও স্বতঃস্ফূর্ত হৃদয়বৃত্তি। নিয়মের শাসনে কি এসব বেঁধে দেওয়া যায়? কর্মক্ষম অবস্থায় যে সবসময় সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়েছে, তাকে যখন হাসপাতালে দুরারোগ্য ব্যাধির রোগী হয়ে চিকিৎসক, সেবিকা আর কর্মকর্তাদের দয়ার পাত্র হয়ে জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো কাটাতে হয়, এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য তার আর কি হতে পারে?
বাংলাদেশ সময়: ১৩২১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৬
এসএনএস
** আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে (পর্ব-২)
**আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে (পর্ব-১)
**মৃত্যু নিয়ে আবদুল্লাহ আল-হারুনের ধারাবাহিক বাংলানিউজে