মূল: অগাস্ট কুবিজেক
অনুবাদ: আদনান সৈয়দ
[লেখক অগাস্ট কুবিজেক ছিলেন কুখ্যাত নাজি বাহিনীর জনক অ্যাডলফ হিটলারের ছেলেবেলার বন্ধু। তার জনপ্রিয় গ্রন্থ ‘দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ’ থেকে জানা যায়, হিটলার তার প্রথম যৌবনে গান গাইতেন, ধ্রুপদী সঙ্গীতের সমঝদার ছিলেন, ছিলেন একজন প্রেমিক ও ছবি আঁকায় তার ছিলো আজন্ম ঝোঁক।
পর্ব ১০
চতুর্থ অধ্যায়
অ্যাডলফ হিটলারের মায়ের প্রতিকৃতি
তাকে (অ্যাডলফ হিটলারের মা) প্রথম যখন আমি দেখি তখন ক্লারা হিটলারের বয়স ছিলো পয়তাল্লিশ বছর এবং মাত্র বছর দুই হলো তিনি বিধবা হয়েছেন। তিনি ছবিতে দেখতে যেমন, বাস্তবে তারচেয়েও অনেক বেশি সুন্দর। শারীরিক সমস্যার ছাপ তার চোখে-মুখে স্পষ্ট। চুল ধূসর হওয়ার পথে। তবে ক্লারা হিটলার তার মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত দেখতে সুন্দর ছিলেন। যখনই আমি তাকে দেখতে যেতাম কেন জানি না তার প্রতি এক ধরনের মমতায় আমি আচ্ছন্ন হয়ে থাকতাম এবং তার জন্য কিছু একটা করতে চাইতাম। তিনি এটা ভেবে খুশি হতেন, অ্যাডলফ একজন যথাযথ বন্ধু খুঁজে পেয়েছে যাকে সে বিশ্বাস করে ও ভালোবাসে। এ কারণে তিনিও আমাকে খুব পছন্দ করতেন। তিনি মাঝে মধ্যেই আমাকে অ্যাডলফের দেওয়া অনেক যন্ত্রণার কথা শোনাতেন এবং তিনি মনে প্রাণে চাইতেন, আমি যেনো তার ছেলেকে বোঝাই তার বাবা তাকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন এর বাস্তবায়ন যেনো হতে পারে। আমি সম্ভবত তাকে এ বিষয়ে হতাশ করে থাকবো, কেননা তিনি নিজেও জানতেন, তার ছেলে আমার কথা শোনার পাত্র নয়।
অ্যাডলফ যেভাবে প্রায়সময়ই আমাদের বাড়িতে গিয়ে আমার বাবা-মায়ের আতিথেয়তা গ্রহণ করতো, সেই একইভাবে আমিও তার মাকে দেখতে যেতাম। তাদের বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার সময় তারা আমাকে আবার আসার আমন্ত্রণ জানাতেন। আমি সেসময় তাদের বাড়ির একজন সদস্য হিসেবেই নিজেকে ভাবতে ভালোবাসতাম।
প্রায়ই দেখা যেতো, আমি কাজ থেকে আগে বাড়ি ফিরতে পারলে একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে আবার হামবোল্ডস্ট্রেসের দিকে পা বাড়াতাম। সেখানকার ৩১ নম্বর তিনতলা দালানটি দেখতে মন্দ ছিলো না। অ্যাডলফ তিনতলায় বাস করতো। আমি সিড়ি ভেঙে উপরে উঠেই কলিং বেলে চাপ দিতাম। ক্লারা হিটলার দরজা খুলে দিতেন এবং আমাকে উষ্ণ সম্ভাষণ জানিয়ে ভেতরে ঢুকতে দিতেন। আমাদের এই অপরিসীম বন্ধুত্ব দেখে তিনি (হিটলারের মা) যেনো অনেক দুঃখের মধ্যেও প্রশান্তি খুঁজে পেতেন। তার প্রতিটি হাসি আমার জন্য বাড়তি আনন্দ বয়ে নিয়ে আসতো।
সেই গুরুগম্ভীর চেহারায় দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাপার্টমেন্টটার কথা আমার এখনও মনে আছে। রান্নাঘরটির আসবাবপত্র ছিলো সবুজ রঙের এবং পাশের একমাত্র বড় জানালা দিয়ে বাড়ির পেছনের আঙিনা পুরোটা দেখা যেতো। শোবার ঘরে ছিলো দু’টো খাট। একটিতে থাকতেন অ্যাডলফের মা এবং আরেকটিতে বোন পাওলা। দেয়ালে ঝোলানো থাকতো তার বাবার একটি উজ্জ্বল ও মুখে হাসি ফুটিয়ে উদ্ভাসিত আইসিএস কমকর্তার প্রতিকৃতি যা সম্রাট ফানজ জোসেফের প্রতিকৃতির সঙ্গে অনেকটা মিলে যায়। অ্যাডলফ রান্না ঘরসংলগ্ন বাইরে ছোট একটি ঘরে থাকতো এবং তার পড়াশুনা সে সেখানেই চালিয়ে যেতো।
আমি যখন প্রথম অ্যাডলফের পরিবারের সঙ্গে দেখা করি তখন তার ছোটবোন পাওলার বয়স ছিলো নয় বছর। সে দেখতে ছিলো সুন্দরী, শান্ত ও কিছুটা আত্মকেন্দ্রিক স্বভাবের। দেখতে সে তার মা অথবা অ্যাডলফ কারোর মতোই ছিলো না। আমি তাকে কখনই খিক খিক করে হাসতে দেখিনি। আমরা একে অপরের সঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবে মিশলেও অ্যাডলফ কখনও তার সঙ্গে বন্ধুবাৎসল ছিলো না। সম্ভবত এটা হয়েছিলো তাদের বয়সের ব্যবধানের কারণেই। সে সবসময় তার বোনকে বলতো, ‘ছোট পিচ্চি’।
হিটলারের পরিবারের আরেকজন বিস্ময়ঘেরা এক নারীকে আমি আবিষ্কার করেছিলাম যার বয়স ছিলো বিশের মতো এবং সে পাওলার মতোই অ্যাডলফের মা ক্লারা হিটলারকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করতো। তার নাম ছিলো, অ্যাঞ্জেলা। পরবর্তীতে আমি এই রহস্যময়ী নারীর জট খুলতে পেরেছিলাম। অ্যাঞ্জেলার জন্ম জুলাই ২৮, ১৮৮৩ অর্থাৎ অ্যাডলফের ছয় বছর আগে তার জন্ম। সে ছিলো তার বাবার আগের ঘরের সন্তান। তার মা ফ্রানজিস্কা মেজেলসবার্গার তাকে জন্ম দেওয়ার এক বছর পর মারা গিয়েছিলেন। পাঁচ মাস পর তার বাবা ক্লারা পলকে বিয়ে করেন। অ্যাঞ্জেলা তার নিজের মাকে দেখেনি কিন্তু ক্লারাকেই সে তার নিজের মায়ের মতো দেখতে শিখেছে। ১৯০৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমার সঙ্গে যখন হিটলারের পরিচয় ঘটে অ্যাঞ্জেলা তখন একজন শুল্ক কর্মকর্তা বর রাওবালকে বিয়ে করে সংসারী হয়েছিলেন। সে তার স্বামীর সঙ্গে জুম ওয়ালর্ধনে থাকতো এবং মাঝে মধ্যেই তার সৎমাকে দেখতে আসতো। অবশ্য সে কখনও তার স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে আসতো না। আমি কখনই তার স্বামীকে দেখিনি। অ্যাঞ্জেলা ছিলো ক্লারা হিটলারের ঠিক বিপরীত। খুবই প্রাণবন্ত, হাসতে ভালোবাসতো ও পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখতো। সে দেখতে ছিলো কেতাদুরস্ত। তার চুলগুলো হিটলারের মতোই সুন্দর ও পেছন দিকে ঝুলে থাকতো।
অ্যাডলফের দেওয়া কিছু তথ্য এবং তার মার কাছ থেকেও জেনেছিলাম, রাওবাল (অ্যাঞ্জেলার স্বামী) ছিলো একজন মদ্যপ। অ্যাডলফ তাকে অপছন্দ করতো। একটা মানুষকে যে যে কারণে ঘৃণা করা যায় তার সবকিছুই সে ওই লোকটার চরিত্রের মধ্যে দেখতে পেতো। সে সারারাত বারে মদ খেতো, জুয়া খেলতো, সিগারেট খেতো এবং সর্বপরি সে ছিলো একজন সিভিল সার্ভেন্ট কর্মকর্তা। শুধু তাই নয়, রাওবালের ধারণা ছিলো, এটি তার দায়িত্ব অ্যাডলফের বাবাকে এই বলে আশ্বস্ত করা যে, সে অ্যাডলফকে একজন সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে গড়ে তুলবে। রাওবালকে ঘৃণা করার জন্য অ্যাডলফের এটাই যথেষ্ট কারণ ছিলো। যখনই সে রাওবালের বিষয় নিয়ে কথা বলতো স্পষ্টতই তার চোখ-মুখে ঘৃণা ফুটে উঠতো। সম্ভবত এ কারণেই হিটলারের সৎবোন তার স্বামীকে এই বাড়ি থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখতো। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই রাওবালের মৃত্যু হয় এবং ততোদিনে তার সঙ্গে অ্যাডলফের সম্পর্ক পুরোপুরিভাবেই ছিন্ন হয়েছিলো। অ্যাঞ্জেলা আবার ড্রেসডেনের একজন স্থপতিকে বিয়ে করে সংসারী হন এবং ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে তিনি মারা যান।
আমি অ্যাডলফের কাছ থেকে জেনেছিলাম, তার বাবার দ্বিতীয় ঘরে তাদের আরেকটি ভাই ছিলো। সে তার শৈশব তাদের সঙ্গেই কাটিয়েছিলো এবং পরবর্তীতে তার বাবা যখন লেমবেচ ত্যাগ করেন তখন সেও সেখান থেকে অন্যত্র চলে যায়। তার এই সৎ ভাইটির জন্ম হয় ডিসেম্বর ১৩, ১৮৮১ সালে ব্রুনাওয়ে। সে ছিলো অ্যাডলফের চেয়ে সাত বছরের বড়। তার বাবা যখন জীবিত ছিলেন তখন সে বারকয়েক লিয়োনডিংয়ে বাবাকে দেখতে এসেছিলো কিন্তু যতদূর আমি জানি, সে কখনই হামবোল্ডস্ট্রেসে অ্যাডলফদের বাড়িতে আসতো না। তার বাবার জীবনের কোনোকিছুর সঙ্গেই তার কোনো ভুমিকা ছিলো না এমনকি সে অ্যাডলফের রাজনৈতিক ভাবনা নিয়েও কখনও মাথা ঘামাতো না। তাকে দেখা যেতো কখনও প্যারিসে, কখনও ভিয়েনা আবার কখনও বার্লিনে। সে প্রথম একজন ডাচ নারীকে বিয়ে করেছিলো এবং তার একটি ছেলে সন্তান হয়। তার নাম ছিলো উইলিয়াম পেটরিক হিটলার, যে ১৯৩৯ সালে ‘আমার চাচা অ্যাডলফ’ এই নামে একটি পুস্তিকাও প্রকাশ করেছিলো। দ্বিতীয় ঘরের ছেলে হেইনজ হিটলার ইস্টার্ন ফ্রন্টে সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলো।
ক্লারা হিটলার নিজের সম্পর্কে কথা বলতে পছন্দ করতেন না। কিন্তু তিনি অ্যাডলফকে নিয়ে বেশি ভাবতেন এবং সেই ভাবনার কথাটা আমাকেও বলতেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই চারুকলার প্রতি শখের কারণে তিনি অ্যাডলফের অন্ধকার ভবিষ্যৎ দেখে সারাক্ষণ উদ্বিগ্ন হয়ে থাকতেন। তার ছেলের এই অন্ধকার ভবিষ্যত দেখে তিনি সবসময় বিষণ্নতায় ভুগতেন। প্রায়সময়ই আমি অ্যাডলফ ও তার মায়ের সঙ্গে তাদের রান্নাঘরে সময় কাটাতাম। তার মা অ্যাডলফকে বলতেন, ‘তোমার অবস্থা দেখে তোমার বাবা কবরে শুয়েও শান্তি পাবেন না’। তার মা আরও বলতেন, ‘তুমি যা করছো তা কোনোভাবেই তোমার বাবা চাইতেন না। বাধ্য ছেলে কাকে বলে তুমি তা জানো না অথবা সম্ভবত তুমি এই শব্দের মানেটাই বোঝো না। সে কারণেই তুমি স্কুলে খুব খারাপ করেছো এবং এখন তোমার জীবনের সবরকম রাস্তাই বন্ধ হয়ে গেছে’।
আমি বুঝতে পারি, এই নারী কী অসহনীয় কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি কখনই কোনো অভিযোগ করতেন না। শুধু একবার আমাকে বলেছিলেন, তার যৌবন বয়সে তিনি কতো কঠিন সময় পার করেছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪১ ঘণ্টা, মে ০৫, ২০১৬
এসএনএস
আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন-
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-১)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-২)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৩)
**দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৪)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৫)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৬)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৭)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৮)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৯)