একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি করেন তিনি। আজ তার ব্যাংকে বেতন জমা হয়েছে।
রফিক সাহেব জানেন, এইভাবে ভাবতে শুরু করলে এক সপ্তাহ কেটে যাবে তাও লিস্ট শেষ হবে না। কিছুক্ষণ ভালো থাকার আশায় থামিয়ে দিলেন চিন্তা-ভাবনার ঢেউ। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন ব্যস্ত রাস্তার দিকে, সবাই শুধু ছুটছে; কিন্তু রফিক সাহেব একটা বিন্দু দাঁড়িয়ে আছেন। চারপাশ দিয়ে রফিক সাহেবকে ঠেলেঠুলে এগিয়ে যায় ব্যস্ত মানুষগুলো। কীসের এতো ব্যস্ততা তাদের এই প্রশ্নের পিছনে কোনোদিন রফিক সাহেব ছোটেননি। কারণ, রফিক সাহেব নিজের কাছে জমে থাকা প্রশ্নের উত্তরই খুঁজে পান না। অন্যের জন্য প্রশ্ন বানানোর কোনো চেষ্টাই তিনি করেন না। বেশি বেশি প্রশ্ন তৈরি করা এক ধরনের খারাপ থাকার লক্ষণ। আর রফিক সাহেব কখনই খারাপ থাকতে চান না।
গত সাত মাস আগে একদিন এশাকে মন ভরে আদর করেছিলো তিনি। এরপর কেটে গেলো গোটা সাত মাস। এশাকে চুমু খাওয়ার জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয় মধ্যরাত পর্যন্ত। এশাকে যখন তিনি আদর করেন দুজনেরই যেনো ‘দম বন্ধ’ করে আদর করতে হয় এবং এক ধরনের ভয়ভীতির মধ্য দিয়ে তাদের ওই পর্বটি শেষ করতে হয়। কারণ, তাদের রুমে কোনো দরজা নেই। তার ঠিক পাশের রুমেই বাবা-মা থাকেন এবং তার দরজার সোজাসোজি ড্রয়িং রুমে ঘুমান তার ছোটবোন। গতমাস থেকেই তার বোনের জন্য পাত্র আসবে আসবে করছে। তাদের দাওয়াতও করা হচ্ছে না টাকার অভাবে। রফিক সাহেবের মা বলেন, ‘বাবা এই মাসে বেতন পেলে কিছু ভালো-মন্দ বাজার করবি, ছেলে পক্ষের লোক আসতে চায় রজনীকে দেখতে। আমি ওদের বলেছি তোর বাবা অসুস্থ একটু সুস্থ হলেই আসতে বলবো’।
তার মানে রফিক সাহেবের এই মাসে ভালো-মন্দ বাজারও করতে হবে। খরচের তালিকায় এটা বাদ পড়ে গিয়েছিলো। ঘরের ভিতরে এই ঘনবসতি রফিক সাহেবকে ভালো থাকতে দেয় না। ছোটবেলা থেকেই একা একটা রুমে দরজা বন্ধ করে ঘুমানোর শখ ছিলো তার। কোনোদিন যে পূরণ হয়নি তা ঠিক নয়। যখন সবাই কোথাও বেড়াতে যেতো তিনি যেতেন না। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মা’র সাথে তিনি তাদের আত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে যেতেন না। সবাই যখন বেড়াতে যেতো তখন রফিক একা বাসায় তার সম্পূর্ণ প্রাইভেসি নিয়ে বসবাস করতেন। যদিও ওইদিনগুলোতে তার এক বেলা খেয়ে, অন্য বেলা না খেয়ে থাকতে হতো। তাতে তার কোনো অসুবিধা হতো না। কারণ, রফিক সাহেবের ভালো থাকার ধরনই ওই রকম।
তার বিয়ের পরে খুব একটা বেড়াতে যায়নি রফিক সাহেবের বাবা-মা। তারপরও যে কয়েকবার গিয়েছে ওই কয়েকটা দিনই তার কাছে হানিমুন। এশাকে এতো বছরে একবারও সমুদ্র অথবা পাহাড় দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়নি তার। এশার অনেক অভিযোগ ছিলো এই নিয়ে। আস্তে অস্তে অভিযোগগুলো অন্য আরেকটা চাহিদা দিয়ে ঢেকে দিয়েছে এশা। কখনও সমুদ্র দেখার বদলে একটা ব্যাগ অথবা পাহাড় দেখার বদলে পছন্দের একটা জুতা। কিন্তু বছর শেষে আর যাওয়া হয়নি কোথাও।
ছেলেপক্ষ পছন্দ করলে রজনীর বিয়ে দিতে হবে। বিয়ের খরচের টাকার জোগাড়ও তার করতে হবে। কিন্তু কোথায় পাবেন এতো টাকা। এইসব নিয়ে কখনই ভাবেন না রফিক সাহেব। কারণ, এই ভাবনাগুলো তার সুখে থাকাকে বাধাগ্রস্ত করে। তিনি উত্তেজিত হয়ে যান। আবার ফিরে আসেন নিজের কাছে যেখানে তিনি খুঁজতে থাকেন ভালো থাকার উপায়।
জীবনের এতো সব প্রেক্ষাপট নিয়ে রফিক সাহেব একটা সিএনজিচালিত অটোরিকশা করে আজকে বাসায় ফেরেন। লোকাল বাস তার কাছে আজ বিষাক্ত মনে হয়। অটোরিকশা নিয়ে গলির ভেতরে না ঢুকে মেইন রোডে একটা হোটেলে গিয়ে গ্রিলচিকেনসহ নানরুটি খান। খাওয়া শেষে বিশটাকার একটা নোট তিনি ওয়েটারকে দিয়ে বেরিয়ে আসেন। তারপরে একটা ডানহিল সিগারেট কিনে টানতে টানতে বাসার দিকে হাঁটতে থাকেন। বাড়ির কাছাকাছি আসতে থাকেন আর তার ঘাড়ে ওজন বাড়তে থাকে। মনে হয়, তিনি কুরিয়ার সার্ভিসের কুলি, ট্রাক থেকে মাল নামিয়ে অফিসে তুলছেন। তার হাঁটতে কষ্ট হয়। তাও তিনি হাঁটতে থাকেন। গলির মোড় থেকে একটা বডি স্প্রে কিনে ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে নেন।
বাসার সামনের দোকানদারকে এড়িয়ে চুপিচুপি বাসার ভিতরে ঢুকে যান। দরজায় নক করতে গিয়ে দেখেন ভিতরে সবাই জেগে আছে। থেমে যান তিনি। দরজায় টোকা না দিয়ে। ছাদে চলে যান। সারাদিন কাজ করার পরে যদিও একটা বিছানা তার খুব দরকার ছিলো, তাও ঘরের ভিতরে যে দুর্ভিক্ষ চলছে, ওইখানে তিনি ঢুকবেন না। রাত বাড়তেই থাকে। যখন মধ্যরাতের কাছাকাছি, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে এশাকে ফোন করে দরজা খুলে দিতে বলেন রফিক সাহেব। ঘরে ঢুকেই রুমের মধ্যে ঢুকে যান তিনি। এশা একটু অবাক হয় তার আচরণে। একটু আওয়াজ করে কথা বলতেই রফিক সাহেব আঙুল দিয়ে চেপে ধরেন এশার ঠোঁট। তখন তিনি বুঝতে পারেন ফেটে চৌচির হয়ে গেছে তার ঠোঁট। এই শীতে তার জন্য একটা লিপজেলও কিনতে পারেননি রফিক সাহেব। তড়িঘড়ি করে আঙুল সরিয়ে নিয়ে হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে যান এশাকে।
এশা প্রশ্ন করে, ‘এমন পাগলামি করতেছো কেন? কী হয়েছে তোমার’।
রফিক সাহেব কোনো প্রশ্নের উত্তর দেন না। এশার দিকে তাকিয়ে হাঁপাতে থাকেন। প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও রফিক সাহেব ঘামতে থাকেন। টপটপ করে শরীর থেকে ঝরে পড়ে পানি।
এশা বলে, ‘বলতে হবে না কিছুই। জীবনে তো কিছুই বলোনি। আর আমি আশাও করি না তুমি এসে কোনোদিন তোমার কোনো কথা আমাকে বলবে। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি চলো খাবে’।
এই কথা বলে এশা ঘরের মধ্যে ঢুকতে যায়। রফিক সাহেব তাকে ঘরে ঢুকতে দেন না। তাকে বারান্দায় বসে থাকতে বলে। এশা বিরক্ত মুখ নিয়ে রফিক সাহেবের পাশে বসে থাকে। অসম্ভব সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে আকাশে। হঠাৎ খেয়াল করে এশা। মনে মনে ভাবে, সে মনে হয় আমাকে নিয়ে চাঁদ দেখবে তাই এখানে বসিয়েছে। এশার মনের মধ্যে ভালোলাগার দোলা লাগতে থাকে। কিন্তু রফিক সাহেব একদমই খেয়াল করেনি আকাশে যে, সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে। অবশ্য রফিক সাহেবের চাঁদ তেমনটা পছন্দ না। চাঁদের জোছনার প্রতি তার তেমন কোনো আগ্রহ নেই।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে রফিক সাহেব বলেন, ‘বাসায় আমাদের একটা বড় ব্যাগ ছিলো না, ওইটা কোথায় এখন? আমার একটু ব্যাগটা লাগবে’।
এশা বলে, ‘এতো রাতে তুমি ব্যাগ দিয়ে কী করবে’?
রফিক কোনো কথা না বাড়িয়ে; ব্যাগ নিয়ে আসার নির্দেশ দেন। এশা ঘরের মধ্যে ঢুকে ব্যাগটা নিয়ে আসে। একটা একটা করে রফিক এবং এশার জামা-কাপড় ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে খুব সকালে আজান হওয়ার সাথে সাথে দু’জনে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। যাওয়ার আগে একটা চিরকুট লিখে যায়।
প্রিয় আম্মা,
আমরা দু’জনে জরুরি কাজে এক সপ্তাহের জন্য একটু ঢাকার বাইরে যাচ্ছি। তুমি ঘরটা সামলে নিও। আমাদের জন্য দোয়া করো। বাজারের জন্য কিছু টাকা রেখে গেলাম।
রফিক।
সকালে বাসের টিকেট করে। এশা এবং রফিক সমুদ্র দেখতে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে রওনা হয়। এশাকে কোনো কথা বলার সুযোগ দেন না রফিক সাহেব। কথা বললেই মুখ চেপে ধরেন তিনি।
বিকেলের দিকে কক্সবাজারে নেমে এশার জন্য কেনাকাটা করেন রফিক। নতুন জামাকাপড়ের সাথে তিনটা নতুন ব্রা। তারপরে কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিনের দিকে রওনা হন তারা। এতোটা পথে কোনো কথা বলার সুযোগ পায় না এশা। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে রফিক সাহেবের দিকে।
তিনদিন পরে তারা দু’জনে ফিরে আসে বাসায়। তাদের ঠিক মনে নেই ওই তিন দিন ঠিক কী কী ঘটেছিলো। অবশ্য তারা ওইগুলো ভুলে যাওয়ার জন্য নানান ধরনের খেলা খেলেছে। সেইগুলো আবার প্রকাশযোগ্য না। তবে তারা একটা গল্প গুছিয়েছে, বাসায় ফিরে কী কী বলা যায়। এশা একবার বলে, ‘বাড়িতে গিয়ে বলবো, আমার বাবা অসুস্থ ছিলো হঠাৎ তাকে দেখতে গিয়েছি’। রফিক সাহেব রাজি হন না। তিনি বলেন, ‘এটা বললে তোমার উপরে রাগ হবে সবাই। আবার ধরা পড়ারও একটা সুযোগ আছে’। এশা বলে, ‘তাহলে কী বলবো, একটা বুদ্ধি তো বের করতে হবে তো আমাদের’। দু’জনেই চেষ্টা করে। কিন্তু ফেরার পুরোটা পথে কেউ কোনো বুদ্ধি খুঁজে পায় না। যেটা বললে সবাই বিশ্বাস করবে এবং আর কোনো ধরনের প্রশ্ন করবে না। দু’জনেই ভয়ে ভয়ে বাসায় ঢুকলো। অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
কেউ কোনো প্রশ্ন করছে না। অবাক হচ্ছে দু’জনেই। কেউ প্রশ্ন করছে না আর রফিক সাহেব এবং এশাকেও কোনো উত্তর দিতে হচ্ছে না। তাড়াহুড়া করে গোসল শেষ করে রফিক সাহেব অফিসের দিকে রওনা হলেন। আর এশা ঘরের কাজ করতে শুরু করলো। অফিসে গিয়ে তিনি সবার কাছে একই প্রশ্নের মুখোমুখি হন। ‘কি ব্যাপার আপনি হঠাৎ, কোনো কাজ আছে নাকি?’ তার ডেস্কে নতুন লোক বসা। তিনি কিছুটা ভড়কে যান। প্রশ্ন করেন, ‘আমি তিন দিন অফিসে আসি নাই আর সব কিছু বদলে গেলো? অদ্ভুত বেপার তো’! তিনি ফ্রন্টডেস্কের মেয়েটাকে প্রশ্ন করেন, ‘কোনো সমস্যা হয়েছে, স্যার কিছু বলেছে আমি কেন আসিনি এই তিন দিন; এই নিয়ে’।
মেয়েটা কিছুটা অবাক হয়। ‘স্যার, আপনার তো তিন আগেই চাকরি চলে গেলো। আপনি সবার থেকে বিদায় নিয়ে নিলেন। আমরা সবাই আপনাকে বিদায় দিলাম। আমাদের বিকালের নাস্তা করালেন আপনি। তারপর আপনি চলে গেলেন। আপনি কি ভুলে গেছেন?’
গত তিনদিন আগে রফিক সাহেবকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তিনি চাকরি চলে যাওয়ার কষ্ট ভুলে যাওয়ার জন্য অনেক ফন্দি খুঁজতে খুঁজতে কখন যে সত্যিই ভুলে গেছেন যে, তিনি এখন একজন চাকরিহীন বেকার মানুষ।
অফিস থেকে বেরিয়ে আসেন রফিক সাহেব। হাঁটতে থাকেন। পথ শেষ হয় না। সরকার অসংখ্য রাস্তা বানিয়েছে এবং রাস্তার উপরে কিছু উড়ন্ত রাস্তাও বানিয়েছে। সবটুকু রাস্তা হাঁটতে কতোদিন সময় লাগতে পারে এমন একটা অদ্ভুত প্রশ্ন নিয়ে রফিক সাহেব হাঁটছেন। এই হাঁটার মধ্যে তিনি আনন্দ খুঁজে পেয়েছেন। যে আনন্দ শেষ হওয়ার নয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৭
এসএনএস