ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

একই দিনে দুই বাংলায় দুটি নক্ষত্রের পতন

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪২ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০২০
একই দিনে দুই বাংলায় দুটি নক্ষত্রের পতন

কলকাতা: একই দিনে, মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দুই বাংলা হারালো দুই বিশিষ্ট সাহিত্যিককে। বৃহস্পতিবার (১৪ মে) জীবনাবসান হলো বিশিষ্ট সাহিত্যিক আনিসুজ্জামান এবং ঔপন্যাসিক দেবেশ রায়ের। প্রায় অর্ধ শতকের বেশি সময় ধরে বাঙালিকে সমৃদ্ধ করে যাওয়া অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের পথচলা শেষ হলো নজিরবিহীন এক সঙ্কটের কালে। করোনার প্রকোপে যখন ধুঁকছে গোটা দুনিয়া, সেই সময় করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিরবিদায় নিলেন ৮৩ বছরের বরেণ্য এই লেখক-অধ্যাপক।

সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার আনিসুজ্জামানের হাত ধরেই এসেছে বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা সংস্করণ। যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন আনিসুজ্জামান।

স্বনামধন্য এই সাহিত্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। আমৃত্যু তিনি বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।

অপরদিকে ওইদিনেই বাংলা সাহিত্য হারালো প্রকৃত ছকভাঙা ঔপন্যাসিক দেবেশ রায়কে। বুধবার (১৩ মে) দেবেশ রা‌য়কে তেঘরিয়া অঞ্চলে এক নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়। শারীরিক অবস্থা সঙ্কটজনক হওয়ায় তাকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছিল। বৃহস্পতিবার (১৪ মে) স্থানীয় সময় রাত ১০টা ৫০ মিনিট নাগাদ তার মৃত্যু হয়। যেহেতু তার শ্বাসকষ্ট ছিল তাই তার নমুনা পাঠানো হয়েছে করোনা পরীক্ষার জন্য। তবে দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন এই সাহিত্যিক। তার বেড়ে ওঠা উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়িতে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সময় থেকেই প্রত্যক্ষ বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন দেবেশ রায়। রাজনীতির সূত্রেই চষে ফেলেন গোটা উত্তরবঙ্গ। এমনকী রাজনীতির স্বার্থে শিখেছিলেন রাজবংশী ভাষাও। এরপর শহর কলকাতা শ্রমজীবিদের সার্থে চুটিয়ে করেছিলেন বামপন্থি ট্রেড ইউনিয়ন।

তারই পাশাপাশি আহ্নিক গতি ও মাঝখানের দরজা, দুপুর, পা, কলকাতা ও গোপাল, পশ্চাৎভূমি, ইচ্ছামতী, নিরস্ত্রীকরণ কেন, উদ্বাস্তু মিলিয়ে আটটি গল্প নিয়ে দেবেশ রায়ের প্রথম গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছিল। তার প্রথম উপন্যাস যযাতি। তার রাজনৈতিক আদর্শের ছাপ পড়ে সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’তে। উত্তরবঙ্গের জীবনের বহতা ধরা আছে এই উপন্যাসে। দেবেশ রায় বাস্তববাদী উপন্যাসের প্রচলিত ছক থেকে সরে গিয়ে বহুস্বরকে নিয়ে আসেন।

১৯৯০ সালে এই উপন্যাসের জন্যেই দেবেশ রায় সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার পান। এছাড়া তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে হলো- মানুষ খুন করে কেন (১৯৭৬), মফস্বলী বৃত্তান্ত (১৯৮০), তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত (১৯৮৮), সময় অসময়ের বৃত্তান্ত (১৯৯৩), লগন গান্ধার (১৯৯৫) ইত্যাদি।

এই দুই নক্ষত্রের পতনে পশ্চিমবাংলার সাহিত্যপ্রেমীদের মধ্যে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

ভাষা ও চেতনার পক্ষ থেকে অধ্যাপক ইমানুল হক বলেন, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ মুক্তচিন্তার পৃথিবীর অন্যতম লেখক ছিলেন আনিসুজ্জামান ও দেবেশ রায়। তাদের চলে যাওয়াটা উপমহাদেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। দুজনেই দেশত্যাগ করতে বাধ্য হওয়া মানুষ। দেবেশ রায় চলে এসেছেন তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতে, অপরদিকে আনিসুজ্জামানের পরিবার বাধ্য হয়েছিলেন ভারত থেকে পূর্ববঙ্গে যেতে। কিন্তু তাদের লেখায়, ভাবনায়, চিন্তায় কোথাও সামান্যতম বিদ্বেষের ছায়াপাত ঘটেনি। আনিসুজ্জামানের এমন বড় মাপের গবেষক যাকে নিয়ে সারাবিশ্ব গর্ববোধ করতে পারে। আর দেবেশ রায় ছিলেন এক সম্পূর্ণ নতুন ধারার লেখক।

এ বিষয়ে কবি-সাহিত্যিক এম ডি শাদউদ্দিন বলেন, আনিসুজ্জামান নিয়ে আমার বড় গর্ব হলো তিনি হলেন আমার আত্মীয়র সম্পর্কে পড়েন। আনিসুজ্জামানের বাড়ি হচ্ছে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার, বাদুরিয়া থানার মহম্মদপুর গ্রামে। আনিসুজ্জামান চলে আসেন কলকাতার পার্ক সার্কাসের কংগ্রেস একজিবিশন রোডে। এখানেই মানুষ এবং কয়েকবার গ্রামেও গেছেন। যাইহোক, তিনি বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস নিয়ে যে নতুন তথ্য দিয়েছেন, তা আসাধারণ এবং অতুলনীয়। তার প্রয়াণে বাংলার গবেষণা জগতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলো। তিনি ছিলেন দুই বাংলার মিলনের এক অগ্রদূত।

এ ছাড়া দেবেশ রায় নিয়ে তিনি বলেন, পশ্চিমবাংলার সংখ্যালঘুদের এক জাগ্রত বিবেকের নাম দেবেশ রায়। তার মৃত্যুতে ফ্যাসিষ্ট এবং মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন বামপন্থি ধর্মনিরপেক্ষ ব্যাক্তিত্ব। বাংলাদেশের পাবনা জেলার বাগমারা গ্রামেই তার জন্ম। দেশভাগের পরে উদ্বাস্তু হয়ে জলপাইগুড়ি চলে আসেন। ওখানেই লেখাপড়া শেষ করে ওখানেই অধ্যাপন করেন। পরে পাড়ি দেন কলকাতায়। তার মৃত্যুতে বামপন্থি আন্দোলন, ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলন এবং মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। একাধিক সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন তিনি।

তবে ১৯৯৩-৯৪ সালে ভারতে যখন সঙ্ঘ পরিবার (আরএসএস) তসলিমা নাসরিনকে অস্ত্র করছে বাংলাদেশের তৎকালীন বিভিন্ন ঘটনাকে নিয়ে। সেই সময় দেবেশ রায় লিখেছিলেন ‘মুম্বাই দাঙ্গার অসম্পূর্ণ’ নামে প্রতিবেদন মূলক একটা বই এবং সেই বই সঙ্ঘ পরিবারের বিরুদ্ধে চাবুকের মতো কাজ করেছিল। অনেকেরই আজানা এই গ্রন্থ প্রকাশ নিয়ে। আরও অনেক বই আছে যা আজও জনসমক্ষে সেভাবে প্রকাশ পায়নি। এছাড়া এক সময় ‘কালান্তর পত্রিকা’র সম্পাদনা করেছেন এবং ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত তিনি ‘পরিচয়ী’ নামে একটা সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।

কলকাতার উদীয়মান কবি অরিন্দম চ্যটার্জী বলেন, দেবেশ রায়ের লেখা পড়লে এক অন্যরকম অনুভূতি আসে। তা হলো, পশ্চিমবঙ্গ মানে শুধু কলকাতা নয়। পাহাড় থেকে সাগর ছড়িয়ে থাকা গ্রাম এবং সেই গ্রামের মানুষগুলোই আসল পশ্চিমবঙ্গ। আর পশ্চিমবাংলায়, যেসব বাংলাদেশি সাহিত্যিক জনপ্রিয় তারমধ্যে বিশেষভাবে পড়ে অধ্যাপক সাহিত্যিক আনিসুজ্জামানের লেখা। এই দুই নক্ষত্রের পতন অপূরণীয় ক্ষতি।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪২ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০২০
ভিএস/এইচএডি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।