সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার মিশেলে এই জীবন। একগুচ্ছ মুহূর্তের কোলাজ।
৪
মামুদ সোবহানকে নিয়ে বের হয়। কিছুদূর হেঁটে একটা সাদা রঙের বাড়ি। বাড়ির সামনে গিয়ে দরজায় টোকা দিতেই ভেতর থেকে দুটি ছেলে বাইরে আসে। একজন বেশ লম্বা, সবুজ রঙের টি-শার্ট পরা, অন্য ছেলেটির একটু স্বাস্থ্য ভালো, গায়ে কালো শার্ট। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার, টিমটিমে একটা আলো জ্বলছে। নানা রকম শিশি, বোতল ছড়ানো মেঝেতে। এক পাশে দুটো কাঠের চেয়ার। ওখানেই সব কথাবার্তা হয়, লেনদেন হয়। ছেলে দুটো ওদের কথাবার্তার সময় বাইরে চলে যায়, কিছুক্ষণ পর দু’ বোতল ঠাণ্ডা কোকাকোলা নিয়ে ফিরে আসে। এবারের চালানে কিছু মাল কম এসেছে তাই নিয়ে সোবাহান একটু রাগ করে।
মামুদ এইটা কেমন হইলো? চুক্তি করলাম যে মালের তার চেয়ে কম মাল আইলো!
কী করবো ভাই গোলমাল, মাল আসার পর ধরা পড়ছে।
কিন্তু কীভাবে এমন হলো? তুমি হিসাব করে মাল রাখবা না?
ওরাতো বিশ্বাসী লোক, শুধু ডেলিভারি দেয়, গুনতে গিয়া দেখি কিছু কম।
এখন থেকে সব হিসাব রাখবা মামুদ। এই লাইনটা খুব খারাপ, সরল মনে কাউরে বিশ্বাস করা যায় না। কে কোন দিক দিয়ে ছুরি দিবে, ফাঁসাইবে, টের পাবা না। সাবধান হয়ে যাও। আমারে এখন অন্যখান থেকে মাল জোগাড় করতে হবে। সব হিসাব করা।
মামুদ মাথা নিচু করে রাখে, সে চায় না সোবাহান তাকে অবিশ্বাস করুক, এই কাজে বিশ্বাসটাই বড়। বিশ্বাস হারিয়ে গেলে কিছুই থাকবে না। তখন সব শত্রু হয়ে যাবে। মাল কম এসেছে এই খবরটা মামুদ সোবাহানকে জানায় নাই, ভেবেছে যদি কোনো গণ্ডগোল হয়, সামনা-সামনি কথা বলতে চেয়েছে। বাইরে গিয়ে মামুদ গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে আসে। কাজের জন্য আলাদা গাড়ি ঠিক করা আছে তার বাইরে অন্য গাড়ি নেয় না। ভাড়া অনেক বেশি, কিছু করার নাই। কিছু পেতে হলে কিছু ছাড়তে হয়।
মালগুলো সিটের নিচে রেখে সিটটাকে আবার বসানো হয়েছে। সাবধানে সব করতে হয়, একটু উনিশ-বিশ হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। সোবাহান মাল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে, আরেকবার শাবানের মুখটা দেখতে ইচ্ছে করে কিন্তু সেটা সম্ভব না। কাজের সময় অন্য চিন্তা করা মানা।
ঝুঁকির কাজ, রাস্তায় ট্রাফিক ধরলে অনেক বিপদ। বড় ভাইদের খবর দিতে হবে, টাকা পয়সার জোগাড় করতে হবে, আইন-পুলিশ সব সামলাও, অনেক ফ্যাসাদ। গাড়িতে উঠে সোবাহান সিগারেটের প্যাকেট খুলে দেখে সিগারেট নাই। গাড়িটা চলছে মিরপুর রোড দিয়ে। রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম। গাড়ি চলছে পিঁপড়ার গতিতে, সামনে একটা পুলিশের গাড়ি, একটু চিন্তা হচ্ছে। সোবাহান গাড়ি-চালক ছেলেটাকে বলে গাড়ি রাস্তার পাশে একটু দাঁড় করাতে সিগারেট কেনার জন্য।
এইখানে গাড়ি সাইড করা যাবে না, তাহলে অনেক পিছাইয়া পড়তে হবে।
পড়তে হলে পড়বো, পুলিশের গাড়িটা আগে যাক।
এতো ডরান কেন? আমি থাকতে কারও বাপের সাধ্য নাই গাড়ি ধরে।
হ তুমিতো রাজা-বাদশা, কেউ তোমারে ধরবে না।
জ্বি ভাই, ঢাকার রাস্তায় আমরাই রাজা-বাদশা একটা মানুষ মাইরা ফালাইলেও কেউ ছুঁইতে পারে না।
গাড়ি-চালক ছেলেটি হা হা করে হাসতে থাকে, পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে সোবাহানকে দেয়।
সোবাহান সিগারেট ধরিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কী একটা ঝুঁকির কাজ সোবাহানের, মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। রাস্তায় বের হওয়া মানেই পুলিশের গাড়ির সামনে পড়া। এতো ঝুঁকির কাজ মাঝে মাঝে ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে, কিন্তু আর কী কাজ করা যায় মাথায় আসে না সোবাহানের। আর এখন এক গোলকধাঁধার মধ্যে ঢুকে পড়েছে, এ থেকে বের হওয়া যাবে না। বড় ভাইরা মেনে নেবে না। দরকার হলে ওকে সরিয়ে দেবে। টেকনিক্যাল থেকে আজিমপুর পৌঁছাতে দেড় ঘণ্টা লেগে গেলো। সোবাহান মাল নিয়ে আখড়ায় যায়। সেখানে বড় রানা, ফেন্সি জুয়েল, মামুন সবাই অপেক্ষা করছিল। সবাইকে মাল বুঝিয়ে দিয়ে ঝাড়া হাত-পা। এখন কিছুদিন আর চিন্তা নাই। মাল বিভিন্ন জায়গায় চলে যাবে। খদ্দেররা সেখান থেকে দালালদের মাধ্যমে মাল কিনে নিয়ে যায়।
লোকজন এই ফেন্সির মধ্যে কী মজা পায়? সোবাহান বোঝে না। এক শিশি কাশির সিরাপ গলায় ঢালে, তরপর তিন-চার চামচ চিনি দিয়ে চা খায়, খেয়ে একেকজন চোখ বন্ধ করে ঝিমাতে থাকে। আধো-ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে ভাসতে থাকে। ভাসমান মানুষ, যার কোনো দুঃখ নাই, কষ্ট নাই, একটা ফুরফুরা আনন্দ চারপাশে, শরীরে একটা আরাম। কিন্তু কতক্ষণ এই নেশা? কেটে গেলেই আবার বাস্তবের দুনিয়া। ফিরে আসতে হবে লালবাগের ঘুপচি ঘরে। সেই একই মানুষ, একই ভাত একই কাপড়। এদের ছেড়ে আর কী কোনো দুনিয়া আছে? জেনে শুনে মানুষের ক্ষতি করছে, কিন্তু এছাড়া উপায় নাই। লেখাপড়া শিখতে পারে নাই ভালো করে। ক্লাস এইটে স্কুল ছেড়ে দেয়, ছোট পরিশ্রমের কাজ করতে সম্মানে লাগে, এইটাই একমাত্র সহজ পথ টাকা রোজগারের।
একবার সোবাহান পেথেডিন নিয়েছিল বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে। বন্ধুরা বললো চল নদীতে যাই খুব মজা হবে।
সোবাহান ভেবেছিল মাছ ধরা হবে। বুড়িগঙ্গায় নৌকায় উঠে দেখে ভিন্ন ব্যাপার।
জুয়েল বলে দোস্ত শুধু একবার, শুধু একবার নিয়ে দেখ কেমন লাগে।
সোবাহান রেগে যায়। আমি বলছিনা আমাকে কোনোদিন এইসব নেশার মধ্যে আনবি না, পছন্দ করি না।
তুমি একবার নাও না। আমি সুই ফোটাই তোমার হাতে, দেখো কেমন লাগে আর কোনোদিন বলবো না।
সোবাহান অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাতে সুই ফোটাতে দেয়।
সাথে সাথে একটা ঝাঁজালো গন্ধ এসে নাকে লাগে। বমি চলে আসে, একটু পরেই মনে হয় শূন্যে ভাসছে। শরীরে কোনো ওজন নাই। শরীরটাকে মনে হয় নৌকা থেকে অনেক উঁচুতে। আর ক্রমাগত আরও উঁচুতে উঠে যাচ্ছে। সোবাহান শক্ত করে নৌকা ধরে রাখে। জুয়েল, রানা ওর কাণ্ড দেখে খুব মজা পায়। সোবাহান নৌকায় ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে অনেক স্বপ্ন দেখে। জাহাজে করে যাচ্ছে, চারপাশে নানা লোক সবাই বিদেশি, কারও কথা বুঝতে পারছিল না সোবাহান। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল মনে নাই, ঘুম ভেঙে দেখে বিকাল হয়ে গেছে, নৌকা মুন্সিগঞ্জের ঘাটে ভেড়ানো।
সোবাহান লালবাগের মোড় থেকে একটা রিকশা নিয়ে ঢাকা মেডিক্যালে যায়। ওখানে মহিলা ওয়ার্ডে ওর মা ভর্তি আছে। পেটে একটা টিউমার হয়েছে অনেক বড়, ডাক্তার বলেছে অপারেশন করতে হবে। সোবাহানের মা এই টিউমার নিয়ে অনেকদিন যাবত ভুগছে। প্রথমে সবাই বলতো পেটে পাথর হয়েছে। পড়া পানি, তাবিজ- কবজ, ঝার-ফুঁক অনেককিছু করা হয়েছে, শেষে এক হোমিওপ্যাথি ডাক্তারকে দেখানো হয় জনসন রোডে। তার হাত-যশ খুব ভালো, কিছুদিনের মধ্যে পেটের ব্যথা কমে যায়। এভাবে কয়েক বছর চলে। অসুখটাকে দমিয়ে রাখা হয়। কিন্তু আবার ব্যথা বেড়ে যায়। তখন হোমিও ডাক্তার বলেন, টিউমারটা পেকে গেছে, কাটাতে হবে। ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যেতে বলেন। অপারেশনের জন্য বেশ কিছু টাকার দরকার। একেকদিন একেক পরীক্ষা দিচ্ছে। সব করতে হয় দালালদের ঘুষ দিয়ে, নাহলে লম্বা সিরিয়াল, অনেকদিন লেগে যাবে। হাসপাতালে এলে সোবাহানের বমি আসে, কেমন ফিনাইল আর ন্যাপথলিনের গন্ধ, গা গুলিয়ে ওঠে। তবে ইন্টার্ন ডাক্তারদের খুব ভালো লাগে সোবাহানের। কী সুন্দর করে কথা বলে, সবকিছু বুঝিয়ে দেয়, কখন কী করতে হবে। কিন্তু নার্সগুলা হারামি! কোনো কথা শোনে না। সোবাহানের মা ডাকতে ডাকতে গলা ফুলিয়ে ফেলে কেউ কাছে আসে না। একদিন সোবাহান এক নার্সের সাথে চোটপাট করে, পরদিন ওই নার্স সোবাহানের মাকে বারান্দায় মেঝেতে পাঠিয়ে দেয়। সোবাহানের কত ক্ষমতা নিজের এলাকায়। কিন্তু ভদ্রলোকদের পরিবেশে আসলে নিজেকে মেনি বিড়ালের মতো মনে হয়। মায়ের শীর্ণ চেহারা, ধুকতে থাকা শরীর, নিজের চওড়া জুতো, ফুলেল শার্ট সব সোবাহানের কাছে হাস্যকর লাগে। ভদ্দরলোকদের জাতটাই আলাদা। ওরা আর আমরা কি একই ধাতু দিয়া তৈরি? ওদের সাথে আমাদের এতো ফারাক কেন? কেমন যেন অচেনা, ওদের কথা শুনলে খালি মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। ওদের সামনে নিজেকে একটা ছোটলোকের বাচ্চা মনে হয় সোবাহানের। সোবাহান মায়ের বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় হাতে একডজন কমলালেবু নিয়ে।
কীরে সোবাহান আইছস? তোদের পাত্তাই নাইক্যা, সেই কাইল সকালে গেলি আর কোনো খবর নাইক্যা। তোদের কি আমি জন্ম দেই নাই? লাইলী হারামি কই?
মা আস্তে কথা কও, এইডা তোমার লালবাগ না ঢাকা মেডিক্যাল।
আরে থুইয়া দে তোর মেডিক্যাল। এইডারে মেডিক্যাল কয়? সকাল থেকে পেটে একটা দানা পড়ে নাই, নার্সগো কি ধর্মঘট চলতাছে, সব বন্ধ। শেষে পাশের বেডের এক পোলারে দিয়া পাউরুটি কলা আনাইয়া খাইছি।
সোবাহান মায়ের রাগত চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে। কেমন শুকিয়ে গেছে, কণ্ঠার হাড়গুলো বেরিয়ে আছে, চুল রুক্ষ, একটা সোনার চেন পুরানো তামার মতো গলায় লটকে আছে।
সোবাহান ডাক্তারের সাথে কথা বলে অপারেশনের তারিখ ঠিক করে। বৃহস্পতিবার দুপুরে অপারেশন। ডাক্তার বলেছে, দু ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা রাখতে। সোবাহানের একটু দুশ্চিন্তা হয়, এতো টাকা লাগবে মার অপারেশনে। হোমিও চিকিৎসাতো ভালোই ছিল। মেডিক্যালে ভর্তি হয়ে বেদনা বেড়ে গেলো।
নভেরা হোসেন
জন্ম ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫, মাদারীপুর শহরে নানাবাড়িতে। শৈশব থেকেই ঢাকায় বেড়ে ওঠা। তিনি লেখাপড়া করেছেন ধানমন্ডির কাকলি উচ্চ বিদ্যালয়, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ এবং নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। লিটল ম্যাগাজিনে লেখা শুরু করেছেন ২০০০ সালের পর থেকে। বিশেষত কবিতা, গল্প ও নৃবৈজ্ঞানিক লেখালেখি করেন। e-mail: [email protected]
আরও পড়ুন>> লালবাগ (পর্ব-৩)
বাংলাদেশ সময়: ১০০৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০১, ২০২০
টিএ