ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

লালবাগ (পর্ব-১১)

নভেরা হোসেন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২০
লালবাগ (পর্ব-১১) নভেরা হোসেন

সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার মিশেলে এই জীবন। একগুচ্ছ মুহূর্তের কোলাজ।

গল্প-উপন্যাস সেই মুহূর্তগুলো ধরে রাখার উৎকৃষ্ট মাধ্যম। পুরান ঢাকার লালবাগকে যেমন সময়ের ফ্রেমে বেঁধেছেন লেখক নভেরা হোসেন। ‘লালবাগ’ একটি নভেলা। এটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে বাংলানিউজের শিল্প-সাহিত্য পাতায়। নভেলাটি পড়তে পাঠক বাংলানিউজে চোখ রাখুন প্রতি শুক্রবার ও মঙ্গলবার।

১১
লাইলী গরমের মধ্যে গায়ে মাটির মটকায় ভর্তি ঠাণ্ডা পানি ঢালে। একটু একটু করে গা থেকে সব পোশাক খোলে, নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে ভিন্ন এক অনুভূতি হয় লাইলীর। এই শরীর নিয়ে কত ভয়, লজ্জা, চারদিকের মানুষজনের থেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা। লাইলী নিজের শরীরের প্রতিটা ইঞ্চি হাত দিয়ে ধরে দেখে। কী আছে এই শরীরে? কেন এর জন্য মানুষ লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করছে? কেন এই শরীর নিয়ে খুনাখুনি, কামড়াকামড়ি? এইটুকু বয়সেই লাইলীর ওপরে যেন বয়সের ভার চেপে বসেছে। কলঘরে ঝুলানো গামছা দিয়ে শরীরের পানি মুছে ফেলে লাইলী। বাম হাতের উল্টো পাশে একটা গভীর দাগে চোখ আটকে যায়। ছোটবেলায় বাবার সাথে লঞ্চে ওঠার সময় টিন লেগে কেটেছিল, এখনও কেমন কালো চিহ্ন হয়ে তাকিয়ে আছে।

অতীত হয়তো এমন করেই মানুষের জীবনে চুপচাপ বসে থাকে। তাকে নিয়েই মানুষ চলে-ফেরে সারা জীবন। কখনও মিলিয়ে যায় সে স্মৃতি, কখনও জেগে ওঠে পুরানো দিনের সব বার্তা নিয়ে। বাবলুর দেওয়া নীল পাথর লাগানো একটা নাক ফুল ওর নাকে জ্বলজ্বল করছে। লাইলী নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে। ওর চোখের জল স্নানের জলের সাথে মিলে-মিশে একাকার হয়ে যায়।

গোসল শেষ করে লাইলী বাবার জন্য গরুর মাংস কষিয়ে রান্না করে। নানারকম মসলা দেয়। জয়ফল, জয়ত্রী বাটার গন্ধে রান্না ঘর ভরে ওঠে।

লালু শেখ খাটের ওপর বসে থেকে বলে, লাইলী যা বাসনা বাইর হইছে, একবারে তোর মায়ের লাহান। আসলে মাইয়া লোক জাতটা না থাকলে সংসার হইতো না। তুই কী সুন্দর সংসারটারে ধইরা রাখার চেষ্টা করতাছস। কত কষ্ট করতাছস। আমি জানি না তোর মনের মধ্যে কী হইতাছে? মা মরলো এক বছরও হয় নাই। সোবাহান কোনোদিন কিছু ভাবছে? যা ইচ্ছা করছে, আমাগো জীবনটারে বিপদের মধ্যে ফেলছে, নিজের জীবনেরও কোনো দাম নাই আজ তার কাছে। যা এখন জেলে পইচা মর।

লালবাগের ছোটঘরে টিমটিমে আলোতে লালু শেখ গরুর মাংসের সুঘ্রাণে আরও ক্ষুধার্ত হয়ে ওঠে। লাইলী খুব যত্ন করে রান্না করে। গোসল করার পরেও জানালাহীন রান্নাঘরে দরদর করে ঘামতে থাকে। ওর শরীরের লোনা জল চুলার রান্নার সাথে মিশে যায়। লাইলী তা জানতে পারে না। গরমের মধ্যে ঘাম মিশ্রিত রান্না লালু শেখের কাছে অমৃতের মতো লাগে।

শাবানরা অনেকদিন ধরে পল্লবীতে মামার বাসায়। মামুদকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর ওদের পরিবারেও অভাব-অভিযোগ দেখা দেয়। মামুদের রোজগারেই এতদিন সংসার চলেছে। মিরপুর এগারো নম্বর বাজারে একটা দোকান ঘর ভাড়া দেওয়া আছে। সেই টাকাও ওরা এখন ঠিকমতো পায় না। মামুদের বাবা মোহাম্মদ অসুস্থ শরীর নিয়ে জেল হাজতে ছেলেকে দেখতে যায় কিন্তু জামিনের কোনো ব্যবস্থা করতে পারে না। সোবাহানের সাথে ফেন্সির ব্যবসা করার কারণে ওকেও কঠিন মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। শাবান আর বোনদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। শাবানের মামা ওর জন্য একটা বিয়ে ঠিক করে বিহারি সম্প্রদায়ের মধ্যে। ছেলের ভালো টাকা-পয়সা আছে। মোহাম্মদপুরে  জেনেভা ক্যাম্পে তিনটা কাবাবের দোকান। এছাড়াও নানারকম ব্যবসা আছে। শাবানের বিয়ে হয়ে যায় জানুয়ারি মাসের তীব্র শীতে। বিয়ের রাতে শাবান খুব কান্নাকাটি করে। সবাই বলাবলি করে ভাইয়ের জন্য শাবান এমন কান্নাকাটি করছে। কিন্তু কেউ জানতে পারে না শাবানের মনে সোবাহানের জন্য যে তীব্র আবেগের জন্ম হয়েছে। তার জন্য বিক্ষুব্ধ এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

শাবান জানে কোনোদিন সোবাহান তার হবে না, সে কি আর কোনো দিন সোবহানকে ফেরত পাবে? এমন আশা করতে পারে না। কিন্তু তাও মন মানে না। একটা দুরাশা করতে করতে শাবান বিয়ের কনে সাজে। তাকে লাল বেনারসি শাড়ি পরানো হয়। হাতে মায়ের হাতের বাউটি বালা, কানে ঝুমকা। সারা মুখজুড়ে নকশা কাটা। কেউ জানতে পারে না শাবানের মনের অলি-গলির খোঁজ। ওদেরকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর এক রাতও শাবান ঘুমাতে পারে নাই। সারারাত জেগে নামাজ পড়ে, দোয়া করে মামুদ আর সোবাহানের মুক্তির জন্য কান্নাকাটি করেছে। তার সেই নীরব প্রার্থনা বিহারি পল্লীর ঘুপচি ঘরে গোল হয়ে ঘুরে বেড়ায়, কেউ শুনতে পায় না। বিয়ের পর শাবান মোহাম্মদপুরে জহুরি মহল্লায় চলে যায় শ্বশুর বাড়ি, ওখানে শাবানের শ্বশুরের চারতলা পাকা দালান, বাড়িতে স্বচ্ছল অবস্থা। মহররম আর রোজাকে নিয়ে মোহাম্মদ ছেলের ফিরে আসার জন্য ক্যাম্পের ছোট্ট ঘরে অপেক্ষা করতে থাকে।

এক বছর মামলা চলার পর রায়ে সোবাহানের পাঁচ বছরের জেল হয়। মামুদের তিন বছর। সোবাহানের পক্ষে বড় ভাই মতিন একজন উকিল দেয়। লাইলী উকিলের সব টাকা পরিশোধ করে।  লাইলীকে প্রায়ই মোস্তাকের সাথে গাজীপুরে গেস্ট হাউসে যেতে হয়। ওখানে সব ব্যবস্থা নিখুঁত। গেটে দুজন দারোয়ান, বাবুর্চি, কেয়ারটেকার। লাইলী যখন ওখানে যায় খুব আরাম-আয়েশে কাটায়। মোস্তাক ওকে নিয়ে চার-পাঁচ দিন কাটায় তারপর শহরে ফিরে আসে। এখন আর লাইলী নাসিমার ডেরায় কাজ করে না। পনেরো দিন পর পর মোস্তাকের গাড়ি এসে লাইলীকে গাজীপুর নিয়ে যায়।

লাইলী নাসিমাকে বলে আপা আমি আর আপনার এখানে কাজ করব না।
কেন? কাজ করবে না কেন?
আমার অন্য একটা ভালো চাকরি হইছে, ওখানে কাজ করব।
নাসিমা লাইলীর কথা শুনে অবাক হয়ে যায়।
কী চাকরি হলো? আমার থেকেও বেশি টাকা দেবে? আমি তোমার টাকা বাড়িয়ে দেব, দ্বিগুণ করব।
লাইলী বলে না আপা আমি আর এই কাজ করব না, আমার আব্বার কাছে কসম কাটছি, অন্য ভালো কাজ করব।
নাসিমা ওর কথায় খুব ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। বোঝে এসব মোস্তাকের কাজ, মোস্তাকের প্রতি রেগে যায়, কিন্তু নাসিমা জানে মোস্তাকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করা যাবে না। মোস্তাক অনেক ক্ষমতাবান। লাইলীকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে ওকে বিপদে ফেলবে, নাসিমার ব্যবসা বন্ধ করে দিতে পারে। এতো বছরের বাঁধা খদ্দের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। কোন দুঃখে যে লাইলীকে কাজে ঢুকিয়েছিল, রাগে নাসিমা হাত কামড়াতে থাকে।

প্রতিবার গেস্ট হাউসে যাওয়ার সময় লাইলীর মনটা খচখচ করতে থাকে। লালু শেখ যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন কে দেখবে তাকে। নূরীর মা দিনে কাজ করে রাতে লালু শেখ একা থাকে। এখন লালু শেখের ঘরে অভাব নাই, রোজ মাছ-মাংস খেতে পারছে। একবার ওয়ারীতে আজগর আলী হাসপাতালে গিয়ে কতরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলো। বুকে তার লাগিয়ে ইসিজি, রক্তের নানা পরীক্ষা। লালু শেখের হৃদযন্ত্রে একটু সমস্যা ধরা পড়েছে। রোজ অনেকগুলো ওষুধ খেতে হয়। দুই মাসে একবার লাইলী বাবাকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে যায়।

লালু শেখ মেয়েকে বলে, পাড়ার অনেকে তোকে নিয়ে নানা কথা বলতেছে। তুই কী কাজ করিস, কী চাকরি করিস, ভালো কাজ করিস না। তোর নামে নানা কথা বলে, আমি কারও কথা কানে তুলি না। কিন্তু এ কথা মনে রাখিস আমরা শেখ বংশের লোক ছোট কাজ আমাগো মানায় না। আর যাই কর ভাইর মতো মুখে চুন-কালি মাখবি না।

লাইলী মাথা নিচু করে লালু শেখের কথা শোনে, ওর যে আর কোনো উপায় নাই। সোবাহানের জন্য মোস্তাক সাহেবের কাছ থেকে অনেক টাকা নেওয়া হয়েছে, মোস্তাকের সাথে গাজীপুরে যেতে হবে। মোস্তাক যেখানে বলে যেতে হবে। এই কাজে ঢুকে পড়েছে, গায়ে সিল পড়ে গেছে। বাবলু ওর জীবন থেকে চলে গেছে সেজন্য এখন আর দুঃখ নাই কিন্তু বাবলুদের কারণে নিজের মায়ের পেটের ভাই জেলে পচে মরবে এটা লাইলী কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। সেজন্য যত টাকা লাগে, যা করা লাগে তা সে করবে।

জীবন আজ লাইলীকে পথের প্রান্তে নিয়ে এসেছে। এখান থেকে পেছনে ফেরা যায় না। ফিরতে চাইলেও আগের জীবন তাকে গ্রহণ করবে না। এখন শুধু সামনের দিকে চলতে হবে। এই চলার শেষ কোথায় কেউ জানে না, লাইলীও জানে না। হয়তো সময়ই ওকে বলে দেবে এখন তুমি থামো, এবার তুমি চলো।

গাজীপুরে গেস্ট হাউসে দিন দিন লাইলী নানা কিছু শিখতে থাকে। মোস্তাক লাইলীকে যখন ওখানে নিয়ে যায় একজন মেয়েকেও সাথে নিয়ে যায়। মেয়েটি লাইলীকে সুন্দর করে শাড়ি পরা, সাজগোজ করা, শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা এসব শেখায়। লাইলীকে ওখানে রেখে মোস্তাক গার্মেন্টসের কাজে চলে গেলে মেয়েটি লাইলীকে সব তালিম দিতে থাকে। একটু একটু করে ওর মধ্যে নানা পরিবর্তন হয়। মোস্তাকের প্রতি ওর এক ধরনের অনুভূতির জন্ম হয়েছে। প্রেম-নির্ভরশীলতা আবার মোস্তাকের খাঁচায় বন্দি হরিণীর মতো অনুভূতি। খাঁচায় বন্দি থাকতে সব সময় ভালো লাগে না ওর। মাঝে মাঝে লাইলী ফোন বন্ধ করে রাখে মোস্তাকের ডাকে সারা দেয় না।

নভেরা হোসেন
জন্ম ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫, মাদারীপুর শহরে নানাবাড়িতে। শৈশব থেকেই ঢাকায় বেড়ে ওঠা। তিনি লেখাপড়া করেছেন ধানমন্ডির কাকলি উচ্চ বিদ্যালয়, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ এবং নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। লিটল ম্যাগাজিনে লেখা শুরু করেছেন ২০০০ সালের পর থেকে। বিশেষত কবিতা, গল্প ও নৃবৈজ্ঞানিক লেখালেখি করেন। e-mail: [email protected]

আরও পড়ুন>> লালবাগ (পর্ব-১০)

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২০
টিএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।