১. নাট্য-দৃশ্য
কিছু রক্ত সঞ্চয় করে রাখছি
পরবর্তী দৃশ্যের জন্যে...
এইসব স্থূল ঝড় থেমে যাবার পর
এক শান্ত ম্লান মাস্তুল-নোয়ানো সন্ধ্যায়
আমাদের দেখা হবে
মাঝখানে কালো গহ্বরের স্থলে
একটা নদী থাকলে ভাল হয়
এতকাল আত্ম-দহনে যদি তোমার মুখখানা পুড়ে যায়;
মুছে যায় চিবুকের অপার্থিব জ্যোতির্ময় রেখাগুলো
একখানা মশাল বরং জ্বালিয়ে রাখতে পারো
মুখের কাছে
পরের দৃশ্যে
একটা লুপ্ত ভ্রূণ ডুকরে কাঁদবে
ধূপের সব আগুন নিভে যাওয়া অব্দি;
এত লোভী আর এত প্রবঞ্চক না হয়ে উঠলে এই দৃশ্যে
তোমার চোখও ঝাপসা হয়ে যাবার কথা, ক্রমে...
কিছু রক্ত সঞ্চয় করে রাখছি
এমন অমোঘ মঞ্চে
বক্ষ খুলে কাঁদতে পারি বলে
২. ক্রান্তিকাল
রত্না নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছি
জগতের অন্যান্য নদীর মত রত্নাও এখন বিলুপ্ত-প্রায়
ভরা শ্রাবণ মাসে বৃষ্টির একটু ক্ষীণ ধারা বয়ে যায় শুধু
রাখালেরা কথায় কথায়- এই নদী ঘিরে যে মিথগুলি
যে উপকথাগুলি আমরা শুনে এসেছি শৈশবে-
গরু চরাতে চরাতে সেই গল্পগুলো জাবর কাটে
একে অন্যকে শোনায়
এই নদীতীরেই আমাদের শুরু
কোনো না কোনো নদীতীরেই তো আমরা আসলে শুরু করি
তীরের কোনো বাঁকে দাঁড়িয়েই প্রথম আকাশ দেখে আমরা আঁতকে উঠেছিলাম
নদীকূলেই তো আমরা সঞ্চয় করেছি জীবন, বিত্ত আর বিবিধ বৈভব
তীরবর্তী বিস্তীর্ণ মাঠে মেষ চরাতে চরাতে আমরা কেউ ত্রাতা হয়েছি, কেউ প্রেমিক আবার কেউবা প্রবঞ্চক
আমাদের প্রণয়, চুম্বন আর ধ্যানোন্মাদ সঙ্গমের ভেতরও
একটা নাতিশীতোষ্ণ নদীই বয়ে যায়; তীরে রাইখেত, আদিগন্ত ইলামের মাঠ!
শৈশবে শুনেছি রত্না নদীর ঢেউয়ে বাণিজ্যের সব ধন হারিয়ে এক শস্য-সদাগর কেঁদে কেটে সেই যে দক্ষিণের পথে হেঁটে গিয়েছিলেন, কোনোদিনই আর ফিরে আসেননি। হয়ত কেউই ফেরে না।
রত্না নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছি
তারপর কেঁদে কেটে লোকালয়ে ফেরে কেউ...
অন্যসব হাঁটে আরও দক্ষিণের পথে...
কখনও ফেরে না!
৩. একা
স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে দেখি
খুব ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে
কেউ দাঁড়িয়ে নেই কোথাও
বয়স বাড়ছে বলে কিনা জানি না
আজকাল স্টেশনে কার যে দাঁড়িয়ে থাকার কথা
সেও ভুলে যাচ্ছি
ল্যাম্পপোস্টের নিচে উড়ছে, নামছে, কিলবিল করছে
অগণিত স্মৃতি ও বিস্মৃতি
৪. চুম্বন
জ্যোতিষী বলেছে
হাসপাতালে রোগ যন্ত্রণায় নয়
আমার মৃত্যু বরং হবে সাঁড়াশি চুম্বনে; নেশাতুর ওষ্ঠ-অভিসারে
এক জমকালো নিশিথে আমাদের দেখা হবে
অর্থাৎ
আমি ও আমার যম- চতুর্দিকে নিস্তব্ধ নগরী
প্রতিটি চুম্বনের আগেই তাই সযত্নে গ্রহণ করি মৃত্যু প্রস্তুতি
ও সুবল রে...
এরে কি চুম্বন বলে, ক্ষণে ক্ষণে মৃত্যু যেথা যথা উহ্য নাহি?
৫. প্রবঞ্চনা
আজ দেখছি তোমার প্রবঞ্চনাগুলিই ছিল প্রেরণাময়ী
বার বার জেগে উঠেছি নিজেরই ভস্মস্তূপে
নিজের উড়ন্ত ছালিকণা জড়ো করে, ধীরে
ছাই-হাড়, ছাই-বক্ষ ছাইয়েস্য পাঁজর নিয়ে
ছাই-মেঘের ছায়ায় শুয়েছি
এখন দমে দমে যে ছাইকণাগুলি উড়ছে
তাতে মিশে আছে জীবন ও মৃত্যু নিয়ে লক্ষ লক্ষ নিগূঢ় জিজ্ঞাসা
৬. রক্ত
আলো সরোবর থেকে তুমি ছুড়ে দিয়েছো এইসব কনকনে শীত-ফুল আর তুষার প্রবাহ
হৃৎপিণ্ড গলতে শুরু করেছে…
ভোরে সারা শহর ভরে যাবে আমার ছোপ ছোপ রক্তে...
৭. হস্ত-বিবৃতি
অতঃপর জিহবা খসিয়া পড়িল। টানা গদ্যে কাশিয়া উঠিল হাত। অনন্তর আঙুল কহিল, প্রভু, আরাধনা-মগ্ন গাছেদের গায়ে আগুন ধরাইয়াছি। ধ্যান-বিভোর যত ঘুম-সরোবর রক্তে ভাসাইয়াছি। আর লোহার শাবল দিয়ে সেইসব মন্দির ভাঙিয়াছি যা সযত্নে লুকানো ছিল মানুষের গোপনতম গুহায়।
বায়ু ধীরে বহিল। বজ্র-নিনাদে প্রশ্ন উঠিল- আর কেন তুমি তা পালন করিয়াছ নির্বিকার, একের পর এক?
হস্ত কাঁপিতে কাঁপিতে কহিল, ঘুমে ও জাগরণে আমাকে তো মস্তিষ্কের অধীন করিয়া দিয়াছিলে, প্রভু।
মস্তিষ্কে প্রাণ সঞ্চারিত হইল। দূরে জলদ গম্ভীর কণ্ঠ বাজিয়া উঠিল, তোমাকে মন্ত্র দিয়াছিলাম আর কেন তুমি তা ছিটাইয়া দিয়াছ ধ্বংসে, ক্ষয়ে, সমূহ সংহারে?
মস্তিষ্ক আড়মোড় ভাঙিয়া কহিল, প্রভূ! আমি তো মুহূর্তে মুহূর্তে শুধু তোমারই আদেশ পালন করিয়াছি।
এমন বৃক্ষও কি আছে যার একটি পাতাও নড়িতে পারে, যদি না থাকে তাতে তোমার গূঢ় ইশারা?
টি এম আহমেদ কায়সার
কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও বাংলা অপেরা বা পালাগানের বিনির্মাণবাদী শিল্পোদ্যোগের নির্দেশকও। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক, পরে যুক্তরাজ্যের বেডফোর্ডশায়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসা প্রশাসনে স্নাতকোত্তর শেষে গত প্রায় দেড়যুগ ধরে লিডসের স্থানীয় সরকারে কাজ করছেন! নব্বইয়ের প্রথমদিকে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চোখ ফিল্ম সোসাইটি, সিনেমা নিয়ে দার্শনিক চিন্তার এক বিকল্প প্ল্যাটফর্ম! নব্বইয়ের শুরু থেকেই কবিতা, গল্প এবং নানা বিষয় নিয়ে মুক্তগদ্য লিখেছেন দুই বাংলার অন্যতম প্রধান ছোট কাগজ সমূহে।
এখন যুক্তরাজ্যে মূলধারার শীর্ষস্থানীয় শাস্ত্রীয় সংগীত ইনস্টিটিউশন সৌধ, সোসাইটি অব পোয়েট্রি অ্যান্ড ইন্ডিয়ান মিউজিকের পরিচালক! ব্রিটেনে রাধারমণ ফোক ফ্যাস্টিভাল, বাউল অ্যান্ড বৈষ্ণব মিউজিক ফ্যাস্টিভাল, গ্রন্থী ইন্টারন্যাশনাল পোয়েট্রি ফ্যাস্টিভাল, ইন্টারন্যাশনাল ডান্স ফ্যাস্টিভাল, বাংলা মিউজিক ফ্যাস্টিভাল, গজল ঠুমরি অ্যান্ড খেয়াল ফ্যাস্টিভাল, ওয়ার্ল্ড পোয়েট্রি অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল মিউজিক ফ্যাস্টিভাল ইত্যাদি ব্যাপক, প্রাতিস্বিক এবং নিয়মিত উৎসবের প্রবর্তক এবং কিউরেটর। বাংলা ভাষার পাশাপাশি ব্রিটেনের মূলধারার বিভিন্ন সংকলনে ইংরেজী ভাষায় কবিতা, সিনেমা এবং সংগীত নিয়ে লিখছেন এবং নানাবিধ বিষয় নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করছেন।
‘ভাইবে রাধারমণ বলে’ শীর্ষক সংগীত আলেখ্য ব্রিটেনের মূলধারার অন্যতম প্রধান শিল্প-উৎসব আলকেমি ফ্যাস্টিভালে ব্যাপকভাবে দর্শক-নন্দিত হয়। সৌধ প্রযোজিত বিশ্ব-কবিতা, ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সংগীতের সমবায়ধর্মী নতুন এবং নিরীক্ষাধর্মী পরিবেশনা; ‘মেলডি অব লাভ অ্যান্ড শাডৌস’ ও ‘লিরিক্স অব সলিচিউড’ নিয়ে অংশগ্রহণ করেছেন এডিনবারা ফ্যাস্টিভালে ও সাউথ ব্যাংক সেন্টারে। তাঁর পরিচালিত অপেরা ‘ক্লাস কনফ্লিক্ট’ (বেদের মেয়ে জোসনা) ও ‘দ্যা বালাড অব এ রিভারাইন ল্যান্ড’ (মহুয়ার পালা) ব্রিটেনের মূলধারার থিয়েটার দর্শকদের কাছে বিপুলভাবে সমাদৃত হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৮, ২০২০
টিএ