ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

এভিয়াট্যুর

খান জাহান আলী বিমানবন্দর নির্মাণে গতি আসেনি ২৭ বছরেও

গৌতম ঘোষ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৩
খান জাহান আলী বিমানবন্দর নির্মাণে গতি আসেনি ২৭ বছরেও

ঢাকা: মোংলা বন্দরের অদূরে খুলনা-মোংলা সড়কের পাশে রামপালের ফয়লায় খান জাহান আলী বিমানবন্দরের নির্মাণ কাজে প্রায় ২৭ বছরেও গতি আসেনি।  

পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) না রাজস্ব খাতে হবে এটা নিয়ে জটিলতা ও পদ্মা সেতু হওয়ার পর বিমানবন্দরের সাম্ভব্য কার্যকারিতা নিয়ে সংস্বয়সহ নানা কারণে থমকে আছে নির্মাণ কাজ।

কবে নাগাদ এ বিমানবন্দরের নির্মাণকাজ শুরু হবে তা জানেন না কেউ। তবে বিমানবন্দরটি নির্মিত হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা যেমন সমৃদ্ধ হবে তেমনি বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, জমি অধিগ্রহণ, মাটি ভরাট ও সীমানা প্রাচীর নির্মাণ ছাড়া কোনো কাজই হয়নি। প্রকল্প এলাকায় একটি সাইনবোর্ড থাকায় কেবল এটির অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। কবে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে, এটি দিয়ে বিমান ওঠানামা করবে কবে—সেই খবর কেউ দিতে পারছেন না। ফলে পদ্মা সেতু হয়ে যাওয়ার পর এ বিমানবন্দরের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। একই সঙ্গে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) না রাজস্ব খাতে হবে এটা নিয়ে জটিলতা আছে। ফলে এ মুহূর্তে এটিকে সম্ভাব্য কার্যকর একটি বিমানবন্দর হিসেবে দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, হয়তো এটি কার্যকারিতার পর্যায়ে যেতে কিছুটা সময় লাগবে। যে কারণে খান জাহান আলী বিমানবন্দর নির্মাণের কাজ কিছুটা ধীরগতিতে হচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, বাগেরহাট শহর, মোংলা বন্দর ও বিভাগীয় শহর খুলনার সঙ্গে প্রায় ২৫ মিনিটের দূরত্বে নির্মিত হচ্ছে এই বিমান বন্দরটি। বিমান বন্দরটি বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের ইকো ট্যুরিজম, হযরত খান জাহান আলীর মাজার ও বিশ্ব ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদ কেন্দ্রিক পর্যটন শিল্পের দ্রুত বিকাশ, মংলা সমুদ্র বন্দর, মংলা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা, প্রক্রিয়াধীন মংলা-ঢাকা ও মংলা-খুলনা রেলপথ, চিংড়ি শিল্পসহ বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে। ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পাবে।

বাগেরহাট জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বাগেরহাটে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর মধ্যে খান জাহান আলী বিমানবন্দর অন্যতম। বিমানবন্দরের জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে। মূল মালিকদের ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রায় ৮০ ভাগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিমানবন্দরের প্রাচীরের কাজও শেষ পর্যায়ে। কিন্তু এটা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) না রাজস্ব খাতে হবে এটা নিয়ে জটিলতা আছে।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বাংলানিউজকে জানান, খান জাহান আলী বিমানবন্দর পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি) করার প্রস্তাব রয়েছে। এটা নিয়ে অনেক ঝামেলা আছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সময়ে এ নিয়ে অনেক বৈঠক হয়েছে। এ নিয়ে জটিলতাও রয়েছে। এখনতো পদ্মা সেতু হয়ে গেছে। ফলে মানুষের যাতায়াত সহজ হয়ে গেছে। এজন্য বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসছেন না। কারণ এখানে বিনিয়োগ করলে কতটা লাভজনক হবে সেটা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছেন বিনিয়োগকারীরা।  

জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে বাগেরহাটের রামপালে সর্ট টেক অব ল্যান্ডিং বিমানবন্দর চালু করতে ৯৮ একর জমি অধিগ্রহণ করে সরকার। এরপর থেকে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকে এই বিমানবন্দরের উন্নয়নের কাজ। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর বিমানবন্দরটির উন্নয়ন কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর পুনরায় উদ্যোগ নেয় বিমানবন্দর নির্মাণের।

২০১১ সালে খান জাহান আলী নামে একটি পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর করার প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ২০১৫ সালে বিমানবন্দর নির্মাণ প্রকল্প একনেকে অনুমোদিত হয়। খুলনা-মোংলা মহাসড়কের পাশে রামপালের ফয়লাহাট এলাকায় নতুন করে অধিগ্রহণ করা হয় ৫৩৭ একর জমি। একই বছরের জুলাইয়ে ফের শুরু হয় প্রকল্পটির কাজ।  

সর্বশেষ জেলা প্রশাসন জমি অধিগ্রহণের কাজ সম্পন্ন করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কাছে অধিগ্রহণকৃত জমির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হস্তান্তর করে। এরপর ন্যাশনাল ট্রেডার্স ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ২০১৮ সালের মে মাস থেকে বিমানবন্দরের সীমানা প্রাচীরের নির্মাণকাজ শুরু করে। কাজ শুরু হওয়ায় এলাকাবাসী ও মোংলা বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীদের মধ্যে নতুন করে আশার সঞ্চার হলেও অজ্ঞাত কারণে নির্মাণকাজ আবারও থমকে গেছে।

এ বিষয়ে বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী বাংলানিউজকে বলেন, খান জাহান আলী বিমানবন্দরের জন্য জমি অধিগ্রহণ করে সীমানা দেয়াল নির্মাণ করে রাখা হয়েছে। সবকিছু আমাদের দখলে আছে। এখন শুধু করার অপেক্ষা। সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল এ সমস্ত প্রকল্প যাতে পিপিপিতে করা হয়। এর মধ্যে দরপত্র আহ্বানও করা হয়েছে। একজন অংশগ্রহণও করেছেন। কিন্তু তাদের দেওয়া শর্তাবলী আমরা ভায়াবল (কার্যকর) মনে করিনি। তারা যাত্রীপ্রতি অতিরিক্ত এক হাজার টাকা করে দাবি করেছেন। যা বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হবে না। এখন যদি দুই হাজার টাকা হয় টিকিটের দাম, আর বিমানবন্দরের জন্য এক হাজার টাকা আলাদা করে দিতে হয়, তখন সেটা চাপ হয়ে যাবে। যে কারণে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি।

তাহলে কি সিদ্ধান্ত না নেওয়ার কারণে আটকে আছে এমন প্রশ্নের জবাবে মাহবুব আলী বলেন, পরবর্তী সিদ্ধান্ত কীভাবে নেওয়া হবে; তা নিয়ে ভাবা হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। পিপিপিতে করার সিদ্ধান্ত থাকলেও সেই সময়ে তা বাণিজ্যিকভাবে ফলপ্রসূ মনে করা হয়নি। ফলে এটি বাস্তবায়ন করা যায়নি। এরপর করোনা আসার কারণে সংকট দেখা দিয়েছে।

বিমানবন্দরটি বাস্তবায়নে কোনো অনিশ্চয়তা আছে কিনা, জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের সবকিছু প্রস্তুত। এরপর করোনা মহামারি এলো; তারপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। কিন্তু তাই বলে এটি নিয়ে অনিশ্চয়তার কিছু নেই। বর্তমান পরিস্থিতি তো আপনারাই দেখছেন। বড় বড় প্রকল্প নির্বাচনের আগে কতটুকু নেওয়া যাবে, তা বুঝতেই পারছেন।

বিশ্বজুড়ে যে অর্থনৈতিক সংকট রয়েছে, এ প্রকল্প বাস্তবায়নে তার কোনো প্রভাব পড়বে কিনা জানতে চাইলে মাহবুব আলী বলেন, ‘তা বলা যাবে না। সরকারের নীতিগত যে সিদ্ধান্ত, আপাতত বড় বড় প্রকল্পগুলো এ মুহূর্তে বাস্তবায়ন না করার বিষয়ে ভাবতে হচ্ছে। আবার এ বছর বৈশ্বিক সংকটের একটি পূর্বাভাসও রয়েছে জাতিসংঘ থেকে। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলার সংকট রয়েছে ইউক্রেনযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। এসব বিবেচনায় নিয়ে হয়তো আগামী বছর যখন সংকট কেটে যাবে, তখন চিন্তাভাবনা করা হবে।

এবিষয়ে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, খুলনা থেকে প্রায় আড়াই-তিন ঘণ্টা সড়ক পথ পাড়ি দিয়ে যশোর বিমানবন্দর দিয়ে যাত্রা করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে যান ব্যবসায়ীরা। ফলে বিদেশি ব্যবসায়ীরা খুলনা-বাগেরহাট এলাকায় আসতে চান না, কারণ এই এলাকায় কোনো বিমানবন্দর নেই। বিমানবন্দর না থাকায় সুন্দরবনে বিদেশি পর্যটকও কম আসছেন। বিমানবন্দর হলে এ অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের আমূল পরিবর্তন ঘটবে। মোংলাবন্দর এলাকায় বিনিয়োগ বাড়বে। এছাড়া খুলনা ও বাগেরহাটসহ কয়েকটি জেলার সঙ্গে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের যোগাযোগ বাড়বে। আকৃষ্ট হবেন সুন্দরবন ও ষাটগম্বুজ কেন্দ্রিক পর্যটকর। এজন্য বিমানবন্দরটি দ্রুত চালু করার দাবি স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের।

বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) এক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে জানান, বিমানবন্দরটি পিপিপিতে হওয়ার কথা। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ে কর্তৃপক্ষ আছেন। পিপিপিতে পার্টি নিয়োগ দিতে ওরা কয়েকবার দরপত্র আহ্বান করেছে। কিন্তু পার্টি পাওয়া যায় না। তারা এটিকে লাভজনক বিবেচনা করছেন না। সম্ভাব্যতা যাচাই করেও দেখা গেছে, আসলে পিপিপিতে এটি নির্মাণ করা সম্ভব হবে না।  

তিনি জানান, সর্বোপরি এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিড অ্যানালাইসিস (প্রয়োজনীয়তা বিশ্লেষণ) করতে হবে। কারণ পদ্মা সেতু হওয়ার পর বরিশাল বিমানবন্দরের যাত্রী কমে গেছে। এ পরিস্থিতিতে খান জাহান আলী বিমানবন্দর কতটা লাভজনক বা কার্যকর হবে, তা ভেবে দেখতে হবে।  

এদিকে ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নির্মাণাধীন বিমানবন্দরটি পরিদর্শনকালে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, এ বিমানবন্দরটি বাণিজ্যিকভাবে অত্যন্ত লাভজনক হবে। কারণ রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে; পাশে মোংলা বন্দর ও খুলনা রয়েছে। এখানে বিমানবন্দর হওয়াটা যৌক্তিক বলেই এটির অনুমোদন হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০২৩
জিসিজি/এসআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।