ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

এভিয়াট্যুর

পর্তুগিজ শহর মালাক্কা

মাজেদুল নয়ন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৩
পর্তুগিজ শহর মালাক্কা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

মালয়েশিয়া থেকে ফিরে: মালয়েশিয়ায় এসেছি বেশ কিছুদিন। সঙ্গে ছিলেন ইশতিয়াক ভাই।

ইশতিয়াক ভাই চলে যাওয়ার পর আবার ‘একলা চলো রে…’।
 
মালয়েশিয়ায় এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি। কোতোরায়ায় ৫০ রিঙ্গিত বাজেটের হোটেল  ‘সেরাই-ইন’ বদলে নতুন হোটেলে উঠেছি। সেরাই-ইনের রুমে ছিল একটা খাট আর ড্রেসিং টেবিল। এ দু’টি আসবাবপত্র ছাড়া খালি স্থানটুকুতে আমার লাগেজ রাখার পর শুধু থাকে দাঁড়ানোর জায়গা।
 
সেরাই-ইনে যে কয়দিন ছিলাম, আমি ছাড়া আর কোনো বাঙালির দেখা মেলেনি। সেগি হোটেলের সামনে একটি গলির ভেতরে এ হোটেলটি আমার মতো খুঁজে বের করেন, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া এবং আমেরিকা মহাদেশ থেকে আসা ব্যাগ-প্যাক ট্যুরিস্টরা।
 
হোটেলে ওঠার দিনই ম্যানেজার ‘চুঁ’ হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করেন, ইন্ডিয়ানরাতো এতো সস্তা হোটেলে ওঠে না। যারা বেড়াতে আসে থ্রি বা ফাইভ স্টারে থাকে। তুমি এটা খুঁজে পেলে কিভাবে? হাসি মুখে জবাব দিলাম, ‘ভালো জায়গা আমি মাটি খুঁড়ে হলেও বের করি। আর যেহেতু আমি অনেকদিন থাকবো তাই এখানে এসেছি। ’ ভদ্রলোক বেশ আন্তরিক।
 
কোতোরায়ায় থেকে চলে আসলাম বুকিত বিনতাংয়ে। এখানে বাংলাদেশি নাগরিক রুবেল ভাইয়ের একটি হোটেল আছে। নামই ‘বাজেট ইন’। রুবেল ভাইয়ের সহধর্মিনী মালয়ী। স্বামী স্ত্রী মিলেই চালাচ্ছেন এ হোটেল।
 
এ হোটেলের রুমগুলো সেরাই ইন থেকে একটু বড়। আমার অনুরোধে জানালা আছে এমন একটি রুমে থাকার জায়গা করে দিলেন রুবেল ভাই। হোটেলের নিচ তলায় একটি ম্যাসাজ বার। এর ওপরের তলায় মেনস সেলুন আর তিনতলায় আমার অবস্থান।
 
হোটেলের সরু সিঁড়ি গলে উপরে ওঠার সময়টায় চায়নিজ আর থাই তরুণীদের অবাঞ্চিত ঘোষণা করেই উঠতে হতো।
Malosia-1 
বুকিত বিনতাং কুয়ালালামপুরের জমকালো এলাকা। এখানে রাস্তার দু’পাশে ম্যাসাজ আর পানীয়ের বার’ই বেশি। চায়নিজদের পর এ এলাকাতে বেশ দাপটের সঙ্গেই বাংলাদেশিদের অবস্থান। এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি ভাল বাঙালি রেঁস্তোরাও। রয়েছে পৃথিবীর বিখ্যাত সব থ্রি স্টার আর ফাইভ স্টার হোটেল।
 
সন্ধ্যার পর বুকিত বিনতাংয়ের চেহারা হয় অন্য ধরনের। ফুটপাথ ধরে হাঁটা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে ম্যাসাজ গার্লদের প্রলোভন এড়িয়ে। আর ক্লাবগুলোর হৈ-হুল্লোড় আর উচ্ছ্বসিত কনসার্ট আপনাকে একাকিত্ব বোধ করতে দেবে না।
 
এখানটা বেশ উন্মুক্ত। ট্যুরিস্টদের জন্যে সব উপকরণই রয়েছে এ জাক-জমক এলাকায়।
 
বুকিত বিনতাংয়ে সকাল হয় বেশ দেরিতে। কারণ এখানে রাতটাই আসল। ক্লাবের গগনবিদারী মিউজিক শেষ রাতের আগে ঘুমোতে দেয় না। বিশেষ করে শুক্র আর শনিবার রাতে যেনো এক আনন্দের নগরী হয়ে ওঠে বুকিত বিনতাং।
 
দুইদিন বুকিত বিনতাংয়ে কাটালাম। এরই মধ্যে এখানকার বাঙালিদের সঙ্গে কথাবার্তা-ঘোরাফেরা হলো।
 
মালয়েশিয়ার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ইউনিভার্সিটি কেবাংসাং মালয়েশিয়া। সেখানকার বাংলাদেশি পিএইচডি শিক্ষার্থী শাহরিয়ার ভাই বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছিলেন, ক্যাম্পাসে একবার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে।
 
১১ তারিখ সকালে ট্যাক্সি চেপে রওনা দিলাম বাঙ্গির উদ্দেশ্যে। বাঙ্গিতে অবস্খিত ইউকেএম। পরিচয় হলো তৌহিদ ভাইয়ের সঙ্গে। তিনিও পিএইচডি করছেন এখানে। বেশ হাসিখুশি মানুষ তিনি।
 
মালাক্কা শহর সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা ছিল না। ইশতিয়াক ভাইয়ের কাছেই শুনে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। শাহরিয়ার ভাইকে বললাম, চলেন ঘুরে আসি। উনিই সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলো। বললেন, ‘আমাগো তৌহিদের বৌ’তো ওখানেই থাকে। ’
Malosia-2 
তৌহিদ ভাই মালয়েশিয়ায় মাস্টার্স করার সময় প্রেম হয় মালয়ী মেয়ে নূর আজলিন বিন্তি বিদিনের সঙ্গে, এরপর বিয়ে পর্যন্ত গড়ায় ২০১২ এর ডিসেম্বরে। ইউনিভার্সিট টেকনিক্যাল মালয়েশিয়া মালাক্কা’র কমিউনিকেশন বিভাগের লেকচারার হিসেব কর্মরত রয়েছেন তিনি। তৌহিদ ভাইও এক কথায় রাজি। এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে, বৌ’য়ের সঙ্গেও দেখা, মালাক্কাও ঘোরা হবে!
 
তবে ১৪ নভেম্বর সকালে শেষতক শাহরিয়ার ভাইয়ের যাওয়া আটকে গেলো। রিসার্চের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। বিবাহিত হলেও, তৌহিদ ভাইয়ের গাড়িটায় ব্যাচেলরের ছোয়া।
 
দুপুর দেড়টায় আমাদের যাত্রা শুরু হলো, পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তা বেয়ে এগিয়ে চলছে আমাদের গাড়ি। দু’ধারে যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড়ের পর পাহাড়, মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে পাম গাছের বাগান।
 
বৃহস্পতিবার দুপুরে বেশ ব্যাস্ত নূর আজলিন। দুপুরে স্বাক্ষাৎ হয় ইউনিভার্সিটিতে তার চেম্বারে। সুন্দর গোছানো রুম। এর আগে কোনো শিক্ষকের চেম্বার এতো গোছানো দেখিনি আমি। কুশল বিনিময় শেষে রওনা দিলাম আবার। পথে চোখে পড়লো লিটল ইন্ডিয়া।
 
বিকেল নাগাদ পৌঁছালাম মালাক্কা নগরীতে। এখানকার পতাকা আলাদা। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলোতে মালয়েশিয়ার জাতীয় পতাকার সঙ্গে রয়েছে মালাক্কা প্রদেশের পতাকাও। এটা হচ্ছে এক শহর এক প্রদেশ। মালয়েশিয়ার অন্য যে কোনো স্থান থেকে এ স্থানটি বেশ গরম, বললেন তৌহিদ ভাই। যেতে যেতে আমরা সেখানে দেখলাম বৃষ্টি। তবে তা খুবই অল্প সময়ের জন্যে। যেটা মালয়েশিয়ার আবহাওয়ার চেনা র‍ূপ।
malosia-32 
শহরটি মালয় উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে, ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগরকে সংযোগকারী মালাক্কা প্রণালীর তীরে অবস্থিত। আনুমানিক ১৪০৩ খ্রিস্টাব্দে মালয়ের জনৈক পলাতক রাজা এই শহরটি প্রতিষ্ঠা করেন। খুব তাড়াতাড়িই এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি সমৃদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়।

পালতোলা জাহাজের যুগে মালাক্কা শহর ছিল মালয় উপদ্বীপের সবচেয়ে ব্যস্ত বন্দরগুলির একটি। কিন্তু মালাক্কা পোতাশ্রয়টি আধুনিক সমুদ্রগামী জাহাজগুলির জন্য উপযুক্ত নয় বলে বর্তমানে বন্দরের কর্মকাণ্ড উপকূলীয় বাণিজ্যের মধ্যেই সীমিত।

১৫শ’ শতকে মালাক্কার রাজারা মালয় উপদ্বীপের অধিকাংশ এবং সুমাত্রা দ্বীপের উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেন।
 
রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে হাঁটা দিলাম আমরা।
 
শহরের মাঝখান দিয়ে ছোট নদী বয়ে গিয়ে পৌঁছেছে মালাক্কা প্রণালীতে। নদীর তীর ধরে সুন্দর করে বাঁধানো। এর পাশে বসার বেঞ্চ রয়েছে। ইচ্ছে হলে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকা যায় বেশ কিছুটা সময়। ওপারের মানুষদের দেখেও সময় পার করা যায়।

কয়েক কদম এগোতেই চোখে পড়লো, ‘ফ্রোল ডে লা মার’ অথবা ‘ফ্লাওয়ার অব দ্য সী’ নামক এক পর্তুগিজ জাহাজ। এ জাহাজে করেই পর্তুগিজরা ১৫১১ সালে সর্বপ্রথম মালয়েশিয়া এসেছিলো। পর্তুগিজদের এক ঐতিহাসিক জাহাজ এটা। বিখ্যাত পর্তুগিজ পর্যটক ও নাবিক ‘অ্যাফোন্সো ডি অ্যালবুকার্কি’-র নেতৃত্বে এ জাহাজ দিয়েই তারা ১৫০৭ সালে গুজরাটের সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ‘দিউ’ বিজয় এবং ১৫১০ সালে গোয়া বিজয়ের পর ১৫১১ সালে মালাক্কা বিজয় করে।
 
১০ রিঙিতে দু’টো টিকিট কেটে আমরা উঠলাম জাহাজে। মনে হচ্ছিল ‘পাইরেটস অব দ্যা ক্যারেবিয়ান’র কোনো চরিক্র হয়ে উঠেছি আমি। সত্যি তাই, কাঠের জাহাজটির যতো ভেতরে প্রবেশ করছিলাম, শুধু মুগ্ধ হচ্ছিলাম।
Malosia-42 
মালাক্কা বিজয়ের বছরই অ্যাফোন্সো ডি অ্যালবুকার্কি পর্তুগাল ফিরে যাচ্ছিলেন এই জাহাজে করে। যাত্রাপথে ২০ নভেম্বর ১৫১১ সালে জাহাজটি ফুটো হয়ে ডুবে যায় কিন্তু ভাগ্যক্রমে অ্যালবুকার্কি বেঁচে যান।

জাহাজটি ডুবে যাওয়ায় পর্তুগিজরা বিশাল বড় এক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলো। আমেরিকার বিখ্যাত ট্রেজার হান্টার ‘রবার্ট ম্যাক্স’ এর মতে, সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া জাহাজগুলোর মধ্যে এটাই ছিলো সবচাইতে সম্মৃদ্ধশালী, যার মধ্যে ছিল বিভিন্ন ধরনের পাথর এবং হীরা। ডুবে যাওয়া এই জাহাজটিরই একটি রেপ্লিকা তৈরি করে রাখা হয়েছে মালাক্কার মেরিটাইম মিউজিয়ামে।
 
মালাক্কার ইতিহাস থেকে দেখা যায়, পর্তুগিজ শাসনের সময় সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার এখানে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করেন। ১৬৪১ সালে ওলন্দাজরা শহরটি দখল করে। তখন থেকে ১৮২৪ সাল পর্যন্ত শহরটি ওলন্দাজদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, তবে মাঝে ১৭৯৫-১৮০২ এবং ১৮১১-১৮১৮, এই দুই সময়ে এটি ব্রিটিশদের অধীনে ছিল। ১৮২৪ সালের পর সুমাত্রা দ্বীপের বেনকুলেন (বর্তমান বেংকুলু) শহরের বিনিময়ে যুক্তরাজ্যে ওলন্দাজদের কাছ থেকে নিয়ে নেয়।

সিঙ্গাপুরের উন্নতির সাথে সাথে মালাক্কা শহরের অবনতি ঘটতে থাকে। ১৮২৬ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত মালাক্কা শাসনের কাজ পেনাং ও সিঙ্গাপুরের সাথে একত্রে পরিচালিত হতো।

সমুদ্র ঘেষা শহর শুনে অনেকেই এখানে এসে সী-বিচ খোঁজেন। তবে এখানে সী-বিচ নেই। মাকোটা পর্যন্ত গেলে সমুদ্রের পাড়ে পৌঁছানো যায়, তবে বীচে নয়।
 
তৌহিদ ভাই বএই শহরে আগে অনেকবার আসলেও এবারই প্রথম ঘুরে দেখছেন তিনি। এর আগে শুধু গাড়িতেই ছিলেন।
 
পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো ক্ষিধে। ভিন্ন খাবারের স্বাদ নেওয়ার ইচ্ছে হলো না। আশপাশে তাকিয়ে ম্যাকডোনাল্ডস দেখে ঢুকে পড়লাম।
 
চলবে….
 
ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।

আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন- [email protected] এই ঠিকানায়

লেখক: মাজেদুল নয়ন
স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাংলাদেশ সময়: ১৯১১ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৩
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।