‘এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে/এসো নির্মল নীলপথে,
এসো ধৌত শ্যামল আলো-ঝলমল বন-গিরি-পর্বতে’
রূপসী বাংলায় শরতের রূপে মুগ্ধ হয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এভাবেই স্বাগত জানিয়েছিলেন মোহনীয় ঋতু শরৎকে। এই শরতেই, প্রকৃতি যেন ফিরে পায় নতুন প্রাণ।
শরতের শুভ্র নীলাকাশ, আর আকাশে মেঘের সাদা ভেলার সঙ্গে তো পরিচিতি রয়েছে সবার। রূপে মুগ্ধ হয়ে কবি-সাহিত্যিকরাও যে কত নামে ডেকেছেন শরৎকে, লিখেছেন কত-শত প্রবন্ধ-কবিতা তার কি ইয়ত্তা আছে?
সাহিত্যের প্রতিটি বর্ণেও তো ছড়িয়ে আছে শরতের অনাবিল স্নিগ্ধতা। কালিদাস থেকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে শামসুর রাহমান। কেউ কি শরৎকে এড়িয়ে যাওয়ার কথা ভেবছেন কখনো? মোটেও না। বরং এই কবি-সাহিত্যিকরাই বলেছেন, শরৎ মানুষের মনের কলুষতা দূর করে। মনকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় শরতের হালকা মেঘের মতোই। তাই শরতের রঙ দিয়ে যদি আমরা জীবনকে রাঙাই তাহলে আমাদের জীবনও হয়ে উঠবে এমন শুভ্রতায়-স্নিগ্ধতায় ভরা।
শরতের আশ্চর্য-আবেশময় রূপটি হচ্ছে জ্যোৎস্নালোকিত শরতের রজনী। যারা শরতের এই মোহনীয় রূপটি দেখেছেন তাদের বুঝি প্রকৃতির কাছ থেকে এর বেশি কিছু চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকে না।
জ্যোৎস্না শোভিত রাতে রাস্তার ধারের কোনো গৃহস্থের বাড়ির আঙিনায় ফোটা শিউলির মৃদু মিষ্টি গন্ধের আকর্ষণ এড়িয়ে যাবে কোন পথিক! এমন বাঙালি আদৌ কি খুঁজে পাওয়া যাবে? শরতের এই মোহনীয় রূপ প্রকৃতি-পিয়াসী প্রত্যেককেই তো কাছে টানে। কিন্তু শত ব্যস্ততার এই নাগারিক জীবনে শরতের টান অনুভব করার সময় কোথায়? তবুও যখন শরৎ এসে কড়া নাড়ে দুয়ারে, হাজার ব্যস্ততার মাঝেও কার না মন চায় অন্তত একটি দিনের জন্য হলেও একাত্ম হয়ে মিশে যেতে প্রকৃতির সাথে! কিছুক্ষণের জন্য হলেও এক ঘেঁয়ে ভাব কাটিয়ে নির্মল আনন্দে মেতে উঠতে।
সম্প্রতি সব ব্যস্ততা ছুঁড়ে ফেলে রামু ছুঁয়ে পৃথিবীর দীর্ঘ সৈকতে ক্ষণিকের নির্মল আনন্দে মেতে উঠেছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ও বর্তমান এক ঝাঁক বৌদ্ধ শিক্ষার্থী। দিনটি ছিল শরতের শেষ লগ্নের এক ছুটির দিন, ২৬ আশ্বিন (১১ অক্টোবর, ২০১৩) শুক্রবার।
আয়োজন: আলোচনা চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে। ব্যস্ততার ঘূর্ণিপাকে আবদ্ধ জীবনের একগুঁয়ে ভাব কাটানো, সেই সাথে অন্তত একদিনের জন্য নির্মল আনন্দে মেতে ওঠা। সব মিলিয়ে প্রকৃতি-ও তার অপার সৃষ্টি রাশি রাশি বালি কণার দীর্ঘ সৈকত, সমুদ্রের গর্জণ তোলা সেই বিশাল ঢেউ আর নোনতা জল যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছিল তারুণ্যকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকেই মূলত এই উদ্যোগ। মার্কেটিং বিভাগের জাপান দা’র (প্রভাষক জাপান বড়–য়া) তত্ত্বাবধানে কয়েক দফা বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত হলো, রামু ছুঁয়ে পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকতই হবে গন্তব্য। আর শরতের শুভ্রতায় ঘেরা কোনো এক ছুটির দিনেই হবে সেই আয়োজন।
দিনটিও চূড়ান্ত হলো। অবশেষে চলে এল সেই মহেন্দ্রক্ষণ, ১১ অক্টোবর শুক্রবার। আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল ষোল-শহর শপিং কমপ্লেক্সের সামনে বাস অপেক্ষায় থাকবে।
সকাল ৬টায় বাস ছাড়া হবে তাই পৌনে ৬টায় নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হতে হবে সবাইকে। সময়টা শুনে এত সকালে ঘুম থেকে উঠা সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে একটু চিন্তায় পড়ে যাই। যাই হোক, রাতের অ্যালার্ম-ভোরে মুঠোফোনে কয়েকজনের ফোন কোনো কিছুই ভাঙাতে পারেনি আমার ঘুম। অবশেষে সকাল ৬টায় ঘুম ভাঙে। ততক্ষণে মুঠোফোনে ১২ থেকে ১৫ টা মিসডকল। বুঝতে বাকি রইল না কিছুই।
আয়োজকদের একজনকে ফোন দিয়ে বললাম অল্পক্ষণের মধ্যেই আসছি। এরপর তড়িঘড়ি করে কোনো রকম প্রস্তুত হয়ে যখন বাসা থেকে বের হই, তখন ঘড়ির কাটা সাড়ে ৬টা পেরিয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত বিলম্ব যাত্রী হিসেবে বহদ্দারহাট মোড় থেকেই বাসে উঠি।
বাসের ভিতরটা এক পলক দেখে নিলাম, পরিচিত-অপরিচিত মুখে ভর্তি গোটা বাস। যাত্রীর সংখ্যা আসনের চেয়েও বেশি। কোথাও কোথাও দুই সিটে ৩/৪জন করে বসতে হয়েছে। বর্তমান ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাই বেশি। প্রাক্তন শিক্ষার্থীর মধ্যে পাভেল, বাবলুসহ হাতে গোনা ৩/৪জন। তবে চালকের পিছনে প্রথম দিকের আসনে বসে ছিলেন মার্কেটিং বিভাগের দুই শিক্ষক, সহকারি অধ্যাপক সজীব বড়ুয়া ও প্রভাষক জাপান বড়–য়া। আছেন কয়েকজন অভিভাবকও।
দেখলাম, বসার সিট পায়নি আয়োজকদের কেউ কেউ। যার মধ্যে অনুজ সরোজ ও শিবা অন্যতম। বাস চলতে শুরু করেছে। প্রথম গন্তব্য রামুর সীমা বিহার। সেখানে পৌঁছে নিজেদের আয়োজনে সংঘদান সম্পন্ন করতে হবে। এরপর নব-নির্মিত ও সংস্কারকৃত রামুর আরও কয়েকটি বৌদ্ধ বিহার ঘুরে দেখার কথা।
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় ধ্বংস স্তুপে পরিণত হওয়া এসব বিহার ও স্থাপনাগুলোর নতুন রূপ দেওয়া হয়েছে। শেষ গন্তব্য সমুদ্র-সৈকত হলেও এই আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ধ্বংসস্তুপ থেকে নতুন রূপ পাওয়া এসব বিহার ও স্থাপনা পরিদর্শন।
যা হোক, মৃদু বাতাস আর শরতের সকালের মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে কালুর ঘাট সেতু পেরিয়ে পটিয়া-দোহাজারি-লোহাগাড়া-চকরিয়া হয়ে রামুর উদ্দেশে হেলে-দুলে এগিয়ে চলে আমাদের বাস। মাঝে মাঝে পিছন থেকে কয়েকজনের ছোট-ছোট দল মাঝারি স্বরে গান ধরে। যেন সবাইকে জানিয়ে দিতে চায়, আমরাও আছি দুষ্টু ছেলের দল।
দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে প্রায় ১১টার দিকে রামুতে বাস থামল। প্রথমেই রামু সীমা বিহার। সেখানে সংঘদান আয়োজনের সব কিছু প্রস্তুত করে অপেক্ষায় ছিলেন প্রাক্তন শিক্ষার্থী রোমেল বড়–য়া ও কপিল বড়–য়াসহ (দু’জনেই এখন ব্যাংকে কর্মরত) স্থানীয় অনেক তরুণ। যোগ দেন সুনীল দা’ও (স্থানীয় সাংবাদিক সুনীল বড়–য়া)। তাদের অক্লান্ত ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় সংঘদানের অনুষ্ঠান শেষ হয় নিখুঁত ভাবেই।
সংঘদান শেষ হওয়া মাত্রই আয়োজন করা হয় দুপুরের খাবারের। সব ক্ষেত্রে যেমন, এখানেও ব্যাতিক্রম নয়। লেডিস ফার্ষ্ট। খাওয়া শেষ করে পার্শ্ববর্তী লাল চিং ও সাদা চিং পরিদর্শনের পালা।
সীমা বিহার থেকে ছোট ছোট দলে হাঁটা শুরু। মাথার ঠিক উপরে এসে সর্ব শক্তিতে তাপ ছড়াতে সূর্য মামারও যেন এতটুকু কৃপণতা নেই। আজ তিনি বড়ই উদার। কিন্তু সূর্য মামার এই উত্তাপ গায়ে না মেখে হেঁটেই সবাই পৌঁছলাম ওখানে। এবার সেখান থেকে উত্তর মিঠাছড়ি যাওয়ার পালা। সেখানে রয়েছে ১০০ ফুট সিংহ শয্যা বুদ্ধ মূর্তি।
বাসের ড্রাইভারকে ফোন করা হলো। বাস এখান থেকে ছাড়া যাবে। কিন্তু ড্রাইভার সাহেব বড়ই একরোখা। তিনি বলে দিয়েছেন এখানে গাড়ি আনা যাবে না। যেখানে পার্কিং করা আছে সেখানে গিয়েই আমাদের উঠতে হবে। কি আর করা, কড়া রোদে অগত্যা কেউ হেঁটে কেউ বা টম-টম ও রিকশায় এসে ড্রাইভারের ইচ্ছার সম্মান দিলাম। ড্রাইভার বলে কথা!
রামু উপজেলা পরিষদের সামনে থেকে আবার যাত্রা শুরু। গন্তব্য উত্তর মিঠাছড়ি। ২০ থেকে ২৫ মিনিটের ব্যবধানে বাস থামল মিঠাছড়ি মূল সড়কের উপর। বাস থেকে নেমে রিকশা, টম-টম ও সিএনজি নিয়ে ছোট ছোট দলে পৌঁছে গেলাম। ১০০ ফুট দীর্ঘ শায়িত বুদ্ধ মূর্তিটি নির্মাণ ও সংস্কার পূর্বক উদ্বোধনের পর থেকে এখানে যেন দর্শনার্থীদের ঢল নেমেছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শুরু করে দেশের বাইরে থেকেও আসছেন দর্শনার্থীরা।
উপরে উঠেই চোখে পড়ল-ভাবনা কোর্সে অংশ নেওয়া ধ্যানীরা চক্রমন করছেন। প্রায় একশ’ জন ধ্যানী নিয়ে কয়দিন আগে ভাবনা কোর্স শুরু করেছেন ভাবনা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ।
অধ্যক্ষের পক্ষ থেকে আমাদের দলটিকে জানিয়ে দেওয়া হলো শব্দ হলে ধ্যানীদের মনোযোগ নষ্ট হবে। তাই শব্দ করা যাবে না। ছেলেদের কথা থামানো গেলেও মেয়েদের কথাবার্তায় বিচলিত বোধ করছিলাম আমরা অনেকেই। পাছে অধ্যক্ষ মহোদয় কিছু বলেন, এই ভয়ে।
প্রার্থনা পর্ব শেষে শুরু হয় ফটো সেশন। আমাদের সবাইকে শায়িত বুদ্ধ মূর্তির সামনে জড়ো করে ছবি তোলা শুরু করে দিলেন সুনীল দা। সিঁড়িতেও বেশ কয়টি ছবি নিলেন। পার্শ্ববর্তী আরও দুটি মন্দির ঘুরে দেখতে দেখতে বিকাল সাড়ে তিনটা বেজে গেল। এবার গন্তব্য সেই সমুদ্র সৈকত।
বাস আবার চলতে শুরু করলো। রাস্তায় বেশ কয়টি পশুর হাট পার হতে একটু বেগ পেতে হলো (কয়দিন পর কোরবানির ঈদ থাকায় জমজমাট পশুর হাট বসেছিল রাস্তায়)। বাস যখন সৈকতের পাড়ে এসে থামল তখন বিকেল সাড়ে ৪টা।
বাস থেকে নামার আগে সবাইকে বলে দেওয়া হলো ঠিক সাড়ে ৫টায় বাসে ফিরে আসতে হবে। সৈকতে নামার যেন তর সইছিল না কারো। সমুদ্র যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। আর এত কাছে এসে সমুদ্রের ডাক এড়িয়ে যাবে কেউ। এটা কি সম্ভব?
সেটা সম্ভব নয় বলেই হুড়োহুড়ি পড়ে গেল সমুদ্র পানে ছুটে যাওয়ার। কেউ দলবদ্ধ, কেউ জুটিবদ্ধ কেউ বা একাকি সৈকতের নিগূঢ় সৌন্দর্য অবলোকনে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল নিমিষেই। এ যেন সৈকত মাড়িয়ে সমুদ্রের পরশ পেতে ছুটে চলা। আমাদের দলটি প্রথমে ৫ জনের থাকলেও পরে ৩ জনের দলে রূপ নেয়। জাপান দা আর রোমেল দা দু’জনে কি একটা কাজে আমাদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেলেন। সজীব দা, সুনীল দা ও আমি ধীরে ধীরে নেমে আসলাম সৈকতে। দাঁড়িয়ে আশপাশে চোখ বুলালাম। পড়ন্ত বিকেলে হাজারো পর্যটকের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে সৈকত।
সামনে-পিছনে বিস্তৃত সৈকত জুড়ে সমুদ্র পিয়াসী মানুষের ঢল। কেউ বালি কণা নিয়ে খেলায় মগ্ন। কারও নোনতা জলে পা ভিজিয়ে অকৃত্রিম আনন্দ উপভোগের নিদারুন প্রয়াস। কেউ বা মেতে উঠেছে ভাটার টানে ক্ষণে-ক্ষণে আসা ঢেউয়ের সাথে লুকোচুরি খেলায়। আর সমুদ্রস্নানের ফাঁকে সৈকত জুড়ে খালি গায়ে কিছু যুবকের ছুটো-ছুটি। কেউ বা নেমে পড়েছে ফটো সেশনের প্রতিযোগিতায়। যেমনটি দেখা গেল এমবিএ’র অদিতা ও বিবিএ শেষ বর্ষের অনুরাসহ ৫/৬ জনের একটি দলকে। এসব দেখছি আর ভাবছি...
পৃথিবীর রহস্যময় সৃষ্টিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো এই সমুদ্র। এর বিশাল গভীরতার পরতে পরতে লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য ও বিস্ময়। বিস্তৃত বালুকারাশি, নুঁড়ি ও ঢেউয়ের দোলাসমৃদ্ধ বিশ্বের দীর্ঘতম এই সমুদ্র সৈকত মানুষকে কাছে টানে প্রতিনিয়ত। সমুদ্রই তার নান্দনিক সৌন্দর্য দিয়ে মানব মনকে সব সংকীর্ণতা ও কুসংস্কার থেকে পরিশুদ্ধ করে। মানুষকে উদারতা, কোমলতা ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার শিক্ষা দেয়। কর্মক্লান্ত হৃদয়ে এনে দেয় ক্ষণিকের প্রশান্তি। তাই নিয়ম মেনে সমুদ্রে ভাটা এলেও সমুদ্র-সৈকতের প্রতি মানুষের যে অকৃত্রিম আকর্ষণ, তা যেন ভাটা পড়ার নয়।
হঠাৎ সজীব দা বলে উঠলেন, আমি একটু নামব। এই বলে জুতো জোড়া খুলে রেখে নোনতা জলে পা ভিজিয়ে হেঁটে চলা শুরু করলেন। তা দেখে সুনীল দা’ও যেন আর দাঁড়িয়ে থাকতে চাইলেন না। ছুটলেন সজীব দা’র পিছু পিছু। সাথে থাকা ক্যামেরাটির কভার খুলে শুরু করে দিলেন ফটো সেশন। ক্যামেরায় একের পর এক শট। নানা ভঙ্গিমায় একের পর এক সজীব দা’র ছবি তুলে চলেছেন তিনি। (পরে আমার কাছে ই-মেইলে ছবিগুলো পাঠিয়েছিলেন সুনীল দা। সেখানে দেখা যায়, পুরো আয়োজনে যত ছবি তুলেছেন তার মধ্যে অধিকাংশ জুড়েই রয়েছেন আমাদের সজীব দা। অবশ্য, আমারও বেশ কয়টি ছবি তুলেছেন। প্রতিটি ছবিতে পেশাদারিত্বের নিখুঁত ছাপ। সাংবাদিক বলেই হয়তো সুনীল দা’র ছবি তোলার হাত এমনটি দক্ষ)।
আমি দাঁড়িয়ে থেকে এসব উপভোগ করছিলাম। একটু পর সুনীল দা’ কাছে এসে বললেন, সাগরের এত কাছে এসেও পা না ভিজালে, সমুদ্রের পরশ না নিলে মিস করবেন কিন্তু! ইতোমধ্যে সজীব দা’ আর সুনীল দা’র শরীরের অধিকাংশই ভিজে গেছে। ভিজবো কিনা, তা নিয়ে কিছুটা দ্বিধা কাজ করলেও শেষ পর্যন্ত থাকতে পারলাম না। জুতো জোড়া খুলে একজনকে পাহারায় রেখে নেমে গেলাম। সমুদ্রের কাছে যেতেই উত্তাল এক ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিয়ে গেল।
এদিকে, ছবি তোলা থেমে নেই সুনীল দা’র। কখনো সজীব দা, কখনো আমি। আবার কখনো একসাথে আমাদের দু’জনকেই তার ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি করে চলেছেন তিনি। জাপান দা’কে খুব মিস করছিলাম। ফোন দিয়ে দেখলাম তার মুঠোফোনটি বন্ধ। পরে জানতে পেরেছিলাম, এক পাশে গিয়ে হিসেব মেলাতে ব্যস্ত ছিলেন তারা কয়েকজন।
সময় যে কখন গড়িয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। বাসে ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে গেলো। সমুদ্র ছেড়ে যেতে হবে ভাবতেই কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর একটি কবিতা মনে পড়ে গেলো-
আমার একাকী বিহারে এই সমুদ্র সৈকতে/কল্লোল, উর্মি কিংবা বীচ এসেছে আমায় নিতে
অন্তরীক্ষের নীহারিকা ধারায়/সকল কিছু যদি সবাই হারায়
আমি শুধু বেঁচে যেতে চাই/বাংলার এই সমুদ্র সৈকতে একবার তাই।
বাসে ওঠার আগে সৈকত পাড়ে কেনা-কাটা করতে দেখা গেল অনেককেই। সারাদিন সময় দিয়ে বিদায় নিলেন সুনীল দা’। অবশেষে সন্ধ্যা ৬টায় সৈকতের পাড় থেকে বাস আবার যাত্রা শুরু করল। বাস চলতে শুরু করেছে। সবাই অনেকটা ক্লান্ত। শিবা আর অনুরার দ্বৈত সুরে গান শুরু হলো। হারানো দিনের সুর ছাড়িয়ে আধুনিক বাংলা ও মাঝে-মাঝে হিন্দি গানের সুরে তারা মোহিত করতে চাইল সবাইকে। আবার হঠাৎ পিছন থেকে ‘ফাইট্টা যায়’ বলে উচ্চ স্বরে গেয়ে ওঠে দুষ্টু ছেলের কোনো দল।
ক্লান্তি জড়ানো চোখে-মুখে হঠাৎ হঠাৎ হাসি ফুটাতে তাদের এই প্রচেষ্টা চলে সারাটি পথ জুড়ে। চকরিয়ার পর ইনানি রিসোর্টে বাস থামানো হলো। শেষ নাস্তার পর্ব সারা হবে এখানে। নাস্তা খাওয়া শেষে একটি ছোট্ট আয়োজন। রিসোর্টের উঠোনে দাঁড়িয়ে সেই আয়োজনে দু’য়েকটি কথা বললেন চবি’র মার্কেটিং বিভাগের দুই শিক্ষক সজীব বড়ুয়া ও জাপান বড়ুয়া।
আবার যাত্রা শুরু। এবার সরোজ ও শিবার উদ্যোগে আয়োজিত লটারির ড্র অনুষ্ঠানের পালা। (উল্লেখ্য, যাত্রার শুরুতে সকালেই আমাকে দিয়েই এই লটারি বেচা-কেনা শুরু করে সরোজ ও শিবা, পরে দেখা গেল-আমার চল্লিশটা টাকা জলে দিল এই দুষ্টু ছেলেগুলো)। যা হোক, একটির পর একটি লটারি তোলা হচ্ছে। একজন একজন করে পুরস্কার জিতছে। আর একেকজনের হাত দিয়ে সেই পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। সব শেষে প্রথম পুরস্কার বিজয়ীর হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন জাপান দা।
পুরস্কার পর্ব শেষ। বাস চলছে। মৃদু হাওয়ায় হালকা ঠাণ্ডাকে উপেক্ষা করে শরতের জ্যোৎস্না মাখা চাঁদনী রাতের অপরূপ সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করি আমরা। আর মাঝে-মাঝে শিবা ও অনুরার কণ্ঠে রোমান্টিক ও হারানো দিনের কিছু গান আমাদের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়।
অবশেষে বাস যখন মুরাদপারে এসে থামল, তখন রাত প্রায় সোয়া ১১টা। একে একে সবাই বিদায় নিল।
উল্লেখ্য, উদ্যোগটি মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব কয়টি বিভাগের শিক্ষার্থীরা এ আয়োজনে শামিল হন। প্রথম দিকে ৫০ জন (এক বাস) অংশগ্রহণকারী পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে কেউ কেউ সন্দিহান থাকলেও মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক জাপান দা’, শিক্ষার্থী সরোজ, অনুরা, শিবা, সতেজ ও তপুসহ আয়োজকদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা সকলের প্রত্যাশা ছাড়িয়ে যায়।
সত্যিই অসাধারণ একটি সুন্দর দিন উপহার দিলেন তারা। পরিশেষে ছন্দের সুরে বলতে ইচ্ছে করে...
কেটে গেল স্বপ্নের মতো গোটা একটা দিন
স্মৃতিগুলো হয়তো রয়ে যাবে অমলিন!
ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।
আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন- [email protected] এই ঠিকানায়
রতন বড়ুয়া
সাংবাদিক, দৈনিক আজাদী-চট্টগ্রাম
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৫ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৩
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর