গত ২৪ জানুয়ারি বাংলানিউজের পক্ষ থেকে যখন কয়েকবার ফোন করে জরুরি ভাবে আমার বিস্তারিত জীবন বৃত্তান্ত এবং ভ্রমণের অপশন জানাতে বলা হলো তখনো ঠিক বুঝতে পারিনি কি ঘটনা কি। পরদিন কারিগরি ত্রুটির কারণে অফিসের ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলো দুপুর পর্যন্ত।
বাংলানিউজ কর্তৃপক্ষকে অসংখ্য ধন্যবাদ সরাসরি পাঠকদের অংশগ্রহণে ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য নতুন বিভাগ ‘ট্রাভেলার্স নোটবুক’ চালু করার জন্য। যেখানে পাঠকরাই লেখক এবং লেখকরাই পাঠক। এই অসাধারণ উদ্যোগের কারণেই আমার মতো একজন নবীন লেখক বাংলানিউজে লেখার সুযোগ পেয়েছে এবং ভবিষ্যতে লেখার জন্য দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করছে।
যাই হোক, বাংলানিউজের সঙ্গে যোগাযোগ করে ৫ থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি তিন দিনের কক্সবাজার ভ্রমণসূচি চূড়ান্ত করলাম। এরপর ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলানিউজ চট্টগ্রাম অফিসে গেলাম ব্যুরো চিফ তপনদার সঙ্গে দেখা করতে। তার অমায়িক ব্যবহার, কিছুক্ষণ আলাপচারিতায় ও আপ্যায়নে কাটল। আমার সামনেই তিনি কক্সবাজারের কলাতলীতে অবস্থিত 'Hotel White Orchid'-এ আমাদের জন্য বুকিং কনফার্ম করলেন এবং টিকিটসহ দু’টি খাম হস্তান্তর করলেন।
৫ ফেব্রুয়ারি যথারীতি ঠিক সকাল ৯টায় গ্রিন লাইন বাসে যাত্রা করলাম কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। আমার সঙ্গে স্ত্রী এবং ৪ বছরের ছেলে যুফী। জীবনে অনেকবার কক্সবাজার গিয়েছি। একা, বন্ধুদের সঙ্গে, পরিবারসহ, কখনো বা অফিসের প্রোগ্রামে। কিন্তু এবারের অনুভূতি ও ভালোলাগা অন্যরকম।
এই ভালোলাগায় অন্যমাত্রা যোগ হলো যখন কিছুদূর যাওয়ার পর জানতে পারলাম আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী! যে কথাটা আমি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম।
যা হোক, খুবই সুন্দর জার্নি উপভোগ করে আমরা হারভাং এ অবস্থিত ‘ইনানী’ রিসোর্টে পৌঁছলাম। সেখানে কিছুক্ষণ যাত্রাবিরতি করে চকরিয়া পার হওয়ার পর হোটেল থেকে ফোন এলো, আমরা তখন কোথায় আছি এবং কখন পৌঁছব।
অর্কিড হোটেল কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছব। অবশেষে বেলা ২টার দিকে হোটেল 'Hotel White Orchid'-এ পৌঁছলাম। ফ্রন্ট ডেস্কে কর্মরত কর্মকর্তারা বেশ ভালোভাবেই আমাদের রিসিভ করলেন। বেশ সুন্দর হোটেল, বেশ গোছানো ও পরিচ্ছন্ন।
খানিকবাদেই লাঞ্চ সেরে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে বিকেলে বিচে গেলাম। আমার ৪ বছরের ছেলের উচ্ছ্বাস আর সাগরের ঢেউয়ের উচ্ছ্বাস যেন মিলিয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে সৈকতের নয়নাভিরাম সূর্যাস্তের দৃশ্য উপভোগ করে সন্ধ্যার দিকে হোটেলে ফিরে আসলাম।
পরদিন ৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টায় টমটমে করে আমরা ইনানির দিকে যাত্রা শুরু করলাম। প্রায় খোলা ও শ্লথগতিসম্পন্ন হওয়ায় দু’পাশের দৃশ্য ভালোভাবে উপভোগ করা যায়। একপাশে সাগর, আরেক পাশে পাহাড়, সুপারির বন, মিষ্টি হিমেল বাতাস। সবমিলিয়ে এই টমটম এক অসাধারণ মাত্রা যোগ করল। এই বাহনটি শুধু পরিবেশবান্ধব নয়,পর্যটনবান্ধবও বটে! কক্সবাজারকে এখন শুধু পর্যটকের শহর নয়, টমটমের শহরও বলা চলে।
সাগরের এই অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা প্রায় সাড়ে ১০টায় ইনানি বিচে পৌঁছি। এখানকার বড় বড় প্রবাল পাথরে স্বচ্ছ নীল পানির ঢেউ আছড়ে পড়ার দৃশ্য যে কাউকে কিছুক্ষণের জন্য জীবনের সব গ্লানি ভুলিয়ে দেবে।
ফেরার পথে হিমছড়িতে কিছুক্ষণ কাটিয়ে দুপুর ২টায় হোটেলে ফিরে আসি।
বিকেলে আবার সৈকতে ঘোরাঘুরি। পাঠকদের জন্য দু’টি নতুন তথ্য দিচ্ছি যা কখনো মিস করবেন না। একটি হলো ৮-১০ বছরের কিছু ছেলে সামান্য টাকার বিনিময়ে আপনাকে Live Music শোনাবে। এরকম কোনো ছেলে যদি এসে বলে, ‘স্যার গান শুনবেন? তখন চমকাবেন না। নতুন একটি অভিজ্ঞতা হবে। আর সন্ধ্যার পরে সুগন্ধা পয়েন্টে বিচ রোডে অনেক খোলা দোকান দেখবেন যেখানে কাঁচা মাছ সাজিয়ে রাখা হয়েছে, আপনার পছন্দমতো আপনার সামনেই ভেজে দেবে। রসনাবিলাসীরা নতুনত্বের স্বাদ পাবেন।
এতো আনন্দের মাঝেও কক্সবাজারের পর্যটন বাণিজ্যের হাহাকার অবস্থা মনকে দারুণ পীড়া দিচ্ছিল। রিকশাওয়ালা, টমটমচালক, রেস্টুরেন্ট ও হোটেল কর্মচারী সবার মধ্যেই দেখেছি বিষাদের ছায়া। পর্যটনের এমন ভরা মৌসুমেও অন্যান্য সময়ের তুলনায় অর্ধেক পর্যটকও নেই। এসবের মধ্যেই টুকটাক শপিং করে রাতে হোটেলে ফিরে আসলাম।
পরদিন অর্থাৎ ৭ তারিখ সকাল সাড়ে ৯টায় রওয়ানা হয়ে প্রথমে গেলাম উত্তর মিঠাছড়িতে 'বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা বিহার'-এ অবস্থিত গৌতম বুদ্ধের ১০০ ফুট দীর্ঘ মূর্তি দর্শন করতে। খুবই দৃষ্টিনন্দন। কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে বেশ কিছু ছবি নিলাম। অতঃপর সেখান থেকে রামুতে অবস্থিত উমংরী বৌদ্ধ বিহার, লালচিং মৈত্রী বিহার কমপ্লেক্স, রামু মৈত্রী বিহার এবং সবশেষে রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহার পরিদর্শন করলাম।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর ১২ তারিখের ধ্বংসযজ্ঞের পর সরকারের আর্থিক আনুকুল্যে মন্দিরগুলো পুনর্নির্মিত হয়। সবকিছু ঘুরে দেখে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। বেশ নিরিবিলি, শান্ত-সমাহিত পরিবেশ। বর্তমানে এই দৃষ্টিনন্দন বৌদ্ধ স্থাপনাগুলো পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। তাই যারা কক্সবাজার বেড়াতে যান তারা অনায়াসে টমটম অথবা সিএনজি ভাড়া করে সব দেখে আড়াই তিন ঘণ্টার মধ্যে আবার কক্সবাজার ফিরে আসতে পারেন।
অতঃপর বিদায়ের পালা। লাঞ্চ সেরে গোছগাছ করে হোটেলের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গ্রিন লাইনের কাউন্টারে আসলাম।
হোয়াইট অর্কিডের কর্মচারীদের আতিথেয়তা বিশেষ করে রেস্টুরেন্টের কর্মচারীদের আতিথেয়তা ও অমায়িক ব্যবহার অনেকদিন মনে থাকবে।
২ রাত ৩ দিনের এ ভ্রমণ প্যাকেজের থাকা ও খাওয়া স্পন্সর করেছে 'Hotel White Orchid'। বিচের প্রাণকেন্দ্র কলাতলী বিচের কাছেই এর অবস্থান। কক্সবাজার বাসস্ট্যান্ড থেকে এর দূরত্ব মাত্র কয়েক মিনিটের। বিচের অনেক কাছে হওয়ায় সমুদ্রের গর্জন শুনতে পাবেন হোটেল থেকেই। মনোরোম পরিবেশে ঘেরা এ হোটেলে সাধারণ অতিথি ছাড়াও তিন ধরনের অতিথির জন্য আছে বিশেষ ব্যবস্থা। বিজনেস ক্লাস, ভ্যাকেশন ট্যাভেলার্স, বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও এখানে আসতে পারেন আপনি। আপনি লগঅনও করতে পারেন-www.whiteorchidhotelbd.com এই ঠিকানায়। এছাড়া বুকিংয়ের জন্য কল করতে পারেন ০১৭৭৭১৫৫১৫৭ ও ০১৮৩৯৬৫৮৭৪৩ নম্বরে। তাছাড়া ই-মেইল করতে পারেন [email protected] এই ঠিকানায়।
ঠিক বিকেল ৪টায় বাস ছাড়ল। বিদায় চির নতুন কক্সবাজার! সারা পথ দু’দিনের কক্সবাজার ভ্রমণের সুখস্মৃতিগুলো রোমন্থন করতে করতে প্রায় রাত সাড়ে ৯টায় চট্টগ্রাম ফিরে এলাম।
সবশেষে শুধু পাঠকদের বলব এই অসম্ভব সুন্দর দেশটি ঘুরে দেখুন, অসংখ্য সৌন্দর্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এদেশের আনাচে-কানাচে। যেগুলো আমাদের সবাইকে দেশটিকে নতুন করে ভালোবাসতে শেখাবে।
বাংলানিউজকে আবারো অসংখ্য ধন্যবাদ আমাদের এই অসাধারণ সুখস্মৃতি উপহার দেওয়ার জন্য এবং আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে ভ্রমণবিলাসীদের ভ্রমণে আরও উৎসাহিত করার জন্য।
ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে। আর মাস শেষে ‘ট্রাভেলার্স নোটবুক’র সেরা লেখকের জন্য তো থাকছেই বিশেষ আকর্ষণ..
আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।
আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন- [email protected] এই ঠিকানায়।
বাংলাদেশ সময়: ১০২৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৪