আমরা যারা প্যারিসে বেড়াতে যাই, সবাই প্যারিসের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হই। আর গল্প-উপন্যাস কিংবা কবিতায় প্যারিসের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের কথা শুনে যারা কখনো প্যারিসে যাননি তারাও কল্পনাতে প্যারিসের একটি স্বাপ্নিক জগত তৈরি করে ফেলেন।
প্রিয় পাঠক, যারা প্রথমবারের মতো প্যারিসে ঘুরতে আসবেন তাদের জন্য বলছি প্যারিসের পথে ঘাটে প্রতারিত হবার সম্ভাবনা প্রকট। আর চেহারা সুরতে যদি ভ্রমণকারীর ছাপ থাকে তাহলে তো কোনো কথাই নেই, প্রতারকের দেখা পেয়ে যাবেন খুব সহজেই।
আপনাদের কিছু নমুনা দেই...
যেমন ধরুন আপনি হাঁটছেন আর বিভিন্ন স্থাপনা দেখছেন। এ শহরটা জীবন্ত জাদুঘরের মতো। এমনিতে জাদুঘরের অভাব নেই, নাম করা ল্যুভর তো এখানেই। সেখানে মোনালিসার মতো লাস্যময়ীর বাস। তাই তাকে দেখতে বিশ্বজয়ীর বেশে হাজার মানুষের আগমন এ দেশে। আমার আসাটা অবশ্য সে কারণে নয়। তাই ভিড়ের দর্শক না হয়ে রাস্তার পথচারী হতেই আমার বেশি পছন্দ।
রাস্তায় হাঁটতে থাকলেও আপনি স্থাপত্যশৈলীর সৌন্দর্যের দেখা পাবেন। তাই আমার মতো এমন দর্শকের সংখ্যা কম না। তাইতো এসব মানুষের আনাগোনার মাঝে আরেকদল সুযোগসন্ধানী জাল বোনে।
আপনি যখন অবাক হয়ে রাস্তার পাশের সৌন্দর্য দেখবেন আর হাঁটবেন ঠিক তখনি আপনাকে চমকে দিয়ে কেউ একজন ডাকবে-
‘ম্যসিয়! – আপনার রিংটা পড়ে গেছে। ’
আমার মতো আপনিও হয়ত বলবেন- স্যরি এটা আমার না।
অপরজনের কাছ থেকে প্রত্যুত্তরে যুক্তি শুনবেন- তাহলে আপনি ভাগ্যবান, আপনিই এখন এটার মালিক, নিয়ে নিন।
যিনি এসব বলবেন তিনি মধ্যবয়সী মহিলা হবেন, এমন সম্ভাবনাই বেশি। তার পাশে পুরুষও থাকতে পারে। তাদের হাবভাব দেখে আপনার মনে হতেই পারে তারা দম্পতি অথবা যুগল, সত্যিটা আপনার অজানেই থেকে যাবে।
এই গেল এক প্রকার।
শহরটা বেশ বড় হওর কারণে এবং লোকজনের আনাগোনার বাড়তি চাপ সামলাতে যোগাযোগের জন্য পাতাল রেল খুব জনপ্রিয়। মেট্রো নামেই পরিচিত যা প্যারিসিয়ান কালচারের অংশ হয়ে গেছে এখন।
না হয়ে উপায় কি! প্যারিস মেট্রো পৃথিবীর পুরাতন মেট্রোগুলোর মধ্যে অন্যতম, প্রায় ১১৪ বছরের পুরানো। তাই এই মেট্রো স্টেশনগুলো অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। Arts et Métiers নামের স্টেশনটা যেমন জুল ভার্ন’র সায়েন্স ফিকশনের মতো করে বানানো। মনে হবে আপনি কোনো বিশাল বড় স্টিম ইঞ্জিনের ভেতরে আছেন। রাস্তার যানজট এড়াতে, পেট্রোলের খরচ, পরিবেশ আর সময় বাঁচাতে মেট্রো রেলের জুড়ি নেই। শহরের আনাচে কানাচে একটা না একটা স্টেশন খুঁজে পাবেনই। তাই এখানে ঠিকানা দিলে স্বভাবতই বাড়ির নম্বর আর মেট্রো স্টেশনের নাম দিয়ে দেয়। পাতাল জুড়ে এমন রেল-নেটওয়ার্ক থাকার কারণে আমার কাছে মনে হয় পুরো শহরটা কয়েক তলা বেজমেন্টের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
৩ থেকে ৪ ধরনের ট্রেন দেখতে পাবেন এখানে আপনি। RER, Metro, Tram, RER মূল শহর থেকে পাশের শহরে যাওয়ার জন্য আসে। তাই এগুলো শুধু মেইন স্টেশন আর ট্যুরিস্ট স্পটে থামে। অনেকগুলো আবার দোতলা। এদের নম্বরিং করা হয় Color (blue, red, yellow, green, pink) আর Alphabet ( ABCDE) এর সমন্বয়ে। যেমন- ব্লু লাইন বললে বুঝে নেবেন RER B. অন্যদিকে মেট্রোগুলো M ১- ১৪ পর্যন্ত।
এছাড়া শহরের চারপাশ দিয়ে সার্কেল করা কয়েকটা ট্রাম (T) লাইনও আছে। মেট্রোগুলোর ব্যস্ততা চোখে পরার মতো, প্রতি ২ মিনিট পর পর ট্রেন আসে। ভিড়ের কারণে আপনি বসা তো দূরে থাক, দাঁড়ানোর জায়গাও পাবেন না হয়ত। এমন ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আপনার হয়ত ঢাকায় বাসে চড়ার কথা মনে হবে। আপনার এই আনমনা ভাবের সুযোগ নিয়ে কেউ একজন আপনার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের চেনটা আস্তে করে খুলে পোস্টমর্টেম করার চেষ্টা করবে। দামি কিছু থাকলে খোয়াবেন নিশ্চিত। Coroner তাও পোস্টমর্টেম করে লাশ সেলাই করে রাখে, কিন্তু ইনি ব্যাগের চেন খোলা রেখেই আপনার পাশ থেকে আস্তে কেটে পরবেন। এমন সময় হয়ত ট্রেন হার্ড ব্রেক কষে থামবে, আপনার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কেউ একজন আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেবে, আপনার ব্যাগ খোলা। ততক্ষণে যা খোয়াবার খুইয়েছেন।
বিস্তর রেল নেটওয়ার্কের কারণে একটু দূরের কোথাও যেতে হলে ট্রেন বদল করতে হয়। স্টেশন ভেদে সেই ট্রানজিটের দৈর্ঘ্য এক রকম হয়। যেমন Châtelet-Les Halles এ কানেক্টিং ট্রেন পেতে প্রায় দশ মিনিট আন্ডারগ্রাউন্ডে হাঁটতে হবে। হবে নাই বা কেন? এটা বিশ্বের সব থেকে বড় আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রো স্টেশন। ৮টা লাইন এসে এখানে মিশেছে। কোনো কোনো স্টেশনের ট্রানজিট পথগুলো চাপা গলির মতো। যদিও আলো কিংবা সিকিউরিটি ক্যামেরার কমতি নেই।
ধরুন আপনি হয়ত হন্তদন্ত হয়ে গলি ধরে দ্রুত ছুটছেন পরবর্তী ট্রেন ধরার জন্য, লোকজনের আনাগোনা কম হলে ঠিক তখন আপনার উল্টো দিক থেকে একজন এক টুকরো কাগজ আর একটা ছেঁড়া-ফাটা মেট্রো ম্যাপ হাতে আপনার দিকে এগিয়ে এসে হাতের কাগজে লেখা ঠিকানায় যাবার রাস্তা জানতে চাইবে। তার হাব ভাব দেখে বুঝে যাবেন তিনি ফরাসি নন। স্বাভাবিকভাবে আপনিও তাকে যথাসাধ্য চেষ্টা করার জন্য উদ্যমী হবেন, আর অমনি আপনি নিজের বিপদ ডেকে আনবেন। অর্থাৎ পিক পকেটের শিকার হবেন।
সহযোগিতা শেষে সন্তুষ্ট চিত্তে আপনি গন্তব্য স্থলে যাবার জন্য স্টেশনের স্কেলেটর বেয়ে ওপরে উঠে বুল্ভার্দ ধরে এগোতে থাকবেন, তখন রাস্তার পাশের বেঞ্চে বসে থাকা শরণার্থী টি- শার্ট পড়া একজন এগিয়ে এসে Strong British accent এ আপনাকে জিজ্ঞেস করবে আপনি ইংরেজি বলেন কিনা।
প্যারিসে আসা ভ্রমণকারীদের যে ফরাসি’র থেকে ইংরেজি’র দৌঁড় বেশি হবে সেটা, আমার-আপনার সবার জানা। খুব কাতর গলায় আপনাকে তাদের সাপোর্ট করার জন্য কি সব লেখা এক কাগজে সই করার জন্য পেন এগিয়ে দেবে। মানবিকতা বোধে জাগ্রত হয়ে যেই না আপনি সই করবেন অমনি আপনার কাছে নগদ টাকা চেয়ে বসবে! কারণ আপনি সই করে ফেলেছেন এমন কাগজে যেখানে লেখা আছে আপনি টাকা দিয়ে সহযোগিতা করছেন।
অগত্যা বাড়তি ঝামেলায় না জড়িয়ে আপনি দ্রুত বিদায় নেবার জন্য পকেটের ওয়ালেট বের করতে গিয়ে ওয়ালেট না পেয়ে হয়ত চিৎকার করে উঠবেন- ‘আমার ওয়ালেট কই?’ বলে। সেটা আর পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, কেননা সে তো আগেই খুইয়ে এসেছেন সরু গলিতে পথ হারিয়ে যাওয়া আগন্তুককে পথ দেখাতে গিয়ে!
প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।
আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।
প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন-[email protected] এই ঠিকানায়।
বাংলাদেশ সময়: ১০২৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০১৪