ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

এভিয়াট্যুর

কাশ্মীর ভ্রমণ

গ্রামগুলো যেনো তেল রঙে আঁকা

তুহিন ডি. খোকন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০৭ ঘণ্টা, জুন ৯, ২০১৪
গ্রামগুলো যেনো তেল রঙে আঁকা ছবি: লেখক

ভূ-স্বর্গ কাশ্মীর। প্রকৃতির বিচিত্র রঙের অলঙ্করণে সজ্জিত।

তুষারশুভ্র বরফ আর নীল পাহাড়ে ঘেরা এর গ্রামগুলো যেন তেল রঙে আঁকা। এক দিনে কি শেষ হয় এর সৌন্দর্য উপভোগ! প্রিয় পাঠক, কাশ্মীর ভ্রমণ নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনীর শেষ পর্ব তুলে ধরা হলো বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য...

কাশ্মীর মানেই তো বরফ রাজ্য, এতো বছর শুধুমাত্র তুষার-আবৃত কাশ্মীরের বিভিন্ন ছবি দেখে এমন ধারণা জন্মে গিয়েছিল আমাদের সবার।

কিন্তু বরফ, তুষারপাত কই, আমাদের তো মাথা খারাপ অবস্থা। আজ আমরা সোনমার্গ যাবো। যতটুকু জেনেছি তাতে এই ভর-গ্রীষ্মে শুধুমাত্র সোনমার্গের গ্লেসিয়ারগুলোই বরফে আবৃত থাকে।

ড্রাইভার রিয়াজ ভাই নির্দিষ্ট সময়েই হোটেল থেকে তুলে নিলেন আমাদের। ডাল লেক, নাগিন লেক হয়ে গাড়ি ঘুরে সোজা ঢুকে গেলো বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত সমৃদ্ধ কাশ্মীরের গ্রামীণ এলাকায়।

সোনালি পটভূমিকায় ধূসর পাথরের গা ও সবুজ অ্যাসবেসটসে ছাওয়া ঘর, পাইনে ঘেরা গ্রামগুলোকে দেখতে অনেকটা তৈলচিত্রের মতো।

শ্রীনগর থেকে সোনমার্গের দূরত্ব প্রায় ৮০ কিলোমিটার, কিন্তু বিপদসঙ্কুল পাহাড়ি রাস্তা হওয়াতে এই দূরত্ব পেরুতেই প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা লেগে যায়।

গাড়ি সোনমার্গ পার্কিং পয়েন্টে পৌঁছে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। অর্থাৎ যথারীতি ঘোড়াওয়ালাদের অত্যাচার, এরসঙ্গে যুক্ত হলো আরেক সমস্যা! সোনমার্গ লোকাল ভিউ দেখতে হলে সোনমার্গের বাইরে থেকে আসা কোনো গাড়িকে যেতে দেওয়া হয় না। ভাড়া করতে হবে লক্কর-ঝক্কর মার্কা টাটাসুমো।

গ্লেসিয়ারের দূরত্ব কতটুকু জানতাম না, তাই এবারও ধরা খেলাম। আসা যাওয়া মাত্র ৬ কিলোমিটার পথের জন্যে দু’হাজার রুপি গুণতে হলো। অচিন দেশ, কী আর করা!

সোনমার্গ ভ্যালিতে পৌঁছে আবারও ঘোড়াওয়ালা! এ যেন ঘোড়াওয়ালাদেরই রাজ্য। মেজাজটা এমনিতেও খিঁচড়ে ছিল, তাই দু’একজনকে হালকা ধমক লাগাতেই পথ ছেড়ে দিলো বটে, কিন্তু পেছন থেকে ঠিকই টিটকারি দিতে থাকলো এই বলে যে- হেঁটে গেলে জীবনেও বরফের দেখা পাবে না।

কিছুক্ষণ পর তাদের ভবিষ্যত বাণীকে বিফল প্রমাণিত করে দেখা মিলল প্রত্যাশিত তুষার-ছাওয়া পর্বত চূড়ার, তবে অনেক উঁচুতে এবং সীমিতই রইল তা।

গলিত বরফের হিমশীতল জল নেমে এসে সোনমার্গ ভ্যালিতে সৃষ্টি করেছে পাথুরে ছড়ার, কলকল ধ্বনিতে বইছে সে বিশুদ্ধ জলের ধারা। সবাই জুতো খুলে নেমে গেলাম তাতে, তবে কয়েক মুহূর্তের জন্যে। কেননা জল এতোটাই ঠাণ্ডা যে দশ-পনের সেকেন্ডের বেশি থাকা সম্ভব না। খাওয়ার পানি বোতলে ভরে সঙ্গে থাকা বিস্কুট ও জেলি সহযোগে সবাই হাল্কা নাস্তাও সেরে নিই। এখানেও অক্সিজেনের ঘাটতি আছে বটে।

সুদূর এই ঝরনাজলের ওপর নির্মিত দৃষ্টি-নন্দন কাঠের সেতুতে বসে পাওয়া যায়  স্বর্গীয় অনুভূতি। পাশাপাশি চলছে ছবি তোলার কাজ, এমন সময় এলো জিরো পয়েন্ট যাওয়ার প্রস্তাব।

ড্রাইভাররা যা বললো তাতে, এখন রওনা হলে শেষ বিকাল নাগাদ ফেরা সম্ভব। কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগলো, কারগিল এতো কাছে! হাতের অ্যান্ড্রয়েডের মাধ্যমে গুগলে সার্চ দিলাম, সর্বনাশ!

সোনমার্গ থেকে বরফাবৃত জিরো পয়েন্টের ট্রাভেল ডিসটেন্স ১ হাজার ৬৭৪ কিলোমিটার। ভয়ঙ্কর দুর্গম এই পথে যাওয়াতেই শুধুমাত্র ২১ ঘণ্টা লাগবে। আর কারগিল গেলে জিরো পয়েন্টে দুরত্ব ১ হাজার ৮১৩ কিলোমিটার।

অন্তরের অন্তস্থল থেকে গুগলকে আবারো ধন্যবাদ জানাই সুবিশাল এই প্রতারণা থেকে পরিত্রাণ পেয়ে। পরিত্রাণায় সাধুনাং...

পাহাড়ের কোল ঘেঁষেই ঝরনা জলবাহী পাথুরে নদী সিন্দ, তার পাশেই নয়নাভিরাম সোনমার্গ রিসোর্ট। এখানে ঘাসের লনও গলফ-কোর্টের মতো সবুজাভ, আশপাশে নানারঙের দুষ্প্রাপ্য অর্কিডের বাগান এক কথায় অনন্য।

রিসোর্ট সংলগ্ন রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সারি কাশ্মিরি মসলাসমৃদ্ধ ঝালমুরগি ও ফ্রাইড রাইস দিয়ে।   খেয়ে অনিন্দ্য-সুন্দর সোনমার্গ-ভ্যালির লনের বিছানো বেঞ্চে বসে রোদ-পোহাই আর ছবি তুলি ইচ্ছে মতো।

জায়গাটা আমাদের এতোই ভালো লাগলো যে একরাত ওখানে থাকার ইচ্ছে প্রকাশ করে সবাই। তাতে হোটেলে গিয়ে রুমের জন্যে দরদামও করে ফেলি।

কিন্তু আমাদের সীমিত বাজেটে একই দিনে দুটো হোটেল রেস্টুরেন্টের ভাড়া বহন করা বেশ দুরূহ। তাই শেষে আবার কোনোদিন আসবো- মনকে এমন বুঝিয়ে সোনমার্গে থাকার পরিকল্পনা এবারের মতো বাদই দিই।

আমরা চলছি শ্রীনগরের দিকে, আমাদের পাশাপাশি চলছে বরফগলা উত্তাল সিন্দ নদীও। মাঝপথে দেখা মিললো নদীর ওপারে ম্যাপল গাছে ছাওয়া আরেকটি উদ্যানের, এটিও একটি চিলড্রেন পার্ক।

মাথাপিছু ১০ টাকা খরচা করে তাতে ঢুকে পড়ি সবাই সবাই। মাথাব্যথা করছিল সবার, তাই অনেকটা চড়া দাম দিয়েই পাইন-ম্যাপলে ঘেরা গাঢ় এই সবুজে বসে চা খেয়ে নিই। আমাদের শিশুরা পার্কে আগত অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে খেলতে শুরু করে।

এখানে ঘণ্টাখানেক কাটানোর পর রওনা হই শ্রীনগরের উদ্দেশে। শহরে যখন ঢুকি, তখন আকাশ প্রদীপ পুরোপুরি নিভে গেছে।

যুসমার্গে আমাদের অভিযানটা তেমন সুখের হলো না। যতটুকু বুঝতে পারলাম, তুষারপাতের সময়টায় এ অঞ্চল আরো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।

চিরাচরিত কাশ্মীরের গাঢ় সবুজ রূপ, বিস্তীর্ণ ঘাসের লন ও পাইনের সমারোহ। একে তো অফ সিজন, তার ওপর সহিংসতার কারণে যুসমার্গ এখন বলতে গেলে পর্যটক শূন্য।

ফলে এখানকার ঘোড়াওয়ালাদের অবস্থাও ত্রাহি ত্রাহি। এখনকার দ্রষ্টব্য স্থান দুধগঙ্গা দেখার জন্যে ঘোড়ায় চড়ার হাজারো হাঁক-ডাক উপেক্ষা করে হেঁটেই রওনা দিই।

একটু তফাতে সবার পেছনে আমি। এক বুড়ো ঘোড়াওয়ালা তার ঘোড়াটি নেওয়ার জন্যে তার ঘোড়া নিয়ে অনুনয় করতে থাকে, গত কয়েকদিন সে একজন পর্যটকও পায়নি। ভাড়া হিসেবে আমার যা খুশি তা দিলেই চলবে। এখানের ঘোড়াওয়ালাদের মধ্যে উনিই সবচেয়ে বৃদ্ধ। মনটা নরম হয়ে গেল, চেপে বসলাম তার ঘোড়াতে।

এদিকে আমার দেখাদেখি আমার স্ত্রীকেও উঠিয়ে নিলো বুড়োর নাতি তার ঘোড়াতে। যেহেতু আমাদের যা খুশি তাই ভাড়া দিতে হবে তাই কিছুদূর গিয়ে নোমানদেরও তুলে দিলাম অন্য চারটি ঘোড়ায়।

সাতটি ঘোড়া টগবগিয়ে চললো কথিত দুধগঙ্গার উদ্দেশে...।

মাইলটাক যাওয়ার পরই শুরু হলো আসল বিপদ! পাহাড়ের খাড়া গিরিখাত ধরে নামতে শুরু করলো আমাদের ঘোড়াগুলো, আলগা পাথুরে পথ খানাখন্দে ভরপুর।

প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।

আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।

প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন- [email protected] এই ঠিকানায়।

বাংলাদেশ সময়: ১০০৫ ঘণ্টা, জুন ০৯, ২০১৪

** খিলানমার্গের পর্বত চূড়ায়
** স্বর্গ-যাত্রা হলো শুরু...

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।