ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

এভিয়াট্যুর

রামের জন্মভূমি অযোধ্যায় একদিন ...

লিয়াকত হোসেন খোকন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০০ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৪
রামের জন্মভূমি অযোধ্যায় একদিন ...

আমরা তখন লক্ষ্ণৌ দেখে জেলাশহর ফৈজাবাদে। বিকেলে হোটেলে চায়ের আড্ডা বসিয়েছিলাম আমি আর রানা।

কথায় কথায় জানলাম ফৈজাবাদ থেকে অযোধ্যার দ‍ূরত্ব মাত্র ৮ কিলোমিটার। এখান থেকে প্রতিদিন সকাল ১০টায় বেশ কটি বাস ট্যুরিস্টদের নিয়ে অযোধ্যা ঘুরিয়ে আনে। অযোদ্যা ভ্রমণ শেষ হলে আবার তাদের হোটেলে ফিরিয়ে আনে। আর এজন্য গুনতে হয় জন প্রতি মাত্র ৮০ রুপি।

পরদিন সকালেই ছুটলাম অযোধ্যা দেখতে। গাইডের কথায় জানল‍াম, ভগবান রামচন্দ্রের জন্ম এই অযোধ্যা নগরীতেই। এই নগর নির্মাণ করেছিলেন দেবতারা। সূর্য বংশীয় রাজা রামচন্দ্রের রাজধানী ছিল অযোধ্যা।

মিনিবাস চালক আমাদের নিয়ে এলেন রেল স্টেশনের কাছে। নির্জন স্টেশন। গৃহস্থ মানুষ চোখে পড়েনি একজনও, শুধু সাধু-সন্ন্যাসীদেরই স্টেশনের আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখলাম।

স্টেশনের কাছেই প্রাচীন একটি মন্দির। বেশকিছু হনুমানও দেখলাম। একজন এসে বললো, জিনিসপত্র খুব সাবধানে রাখবেন, হনুমান ও বানরের উৎপাত রয়েছে। স্টেশন থেকে অযোধ্যা শহরে যাবার জন্য রয়েছে অটোরিকশা ও টাঙা। হেঁটেও যাওয়া যায়। এই অযোধ্যায় স্টেশনের কাছেই নির্জন পরিবেশে থাকার জন্য রয়েছে উত্তর প্রদেশ পর্যটনের পর্যটন আবাসন এবং স্টেশনে রিটায়ারিং রুম। খাবারের জন্য প্রচুর হোটেল থাকলেও এ শহরে মাছ-মাংস একদম চলে না। পেঁয়াজ ছাড়া সবজি রান্না হয়।

শহরে সাধারণ বাড়ির সংখ্যা খুবই কম। যা কিছু আছে সবই মন্দির ও আখড়া। এ শহরে মন্দিরের সংখ্যা ৭ হাজার। মন্দির দেখতে দেখতে মনে হলো, এ যেন মন্দিরের শহর। গাইডের মুখে শুনলাম, শুধু হিন্দুদের মন্দিরই নয়, আছে জৈন এবং বৌদ্ধদের মন্দিরও। বেশ কিছু মসজিদ থাকলেও দেখে মনে হয়, পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। জৈনদের ২৪ জন তীর্থঙ্করের মধ্যে পাঁচজন এই শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম আদিনাথ। বুদ্ধদেব এই অযোধ্যায় ১৬টি গ্রীষ্ম অতিবাহিত করেছিলেন বলে বৌদ্ধদের বিশ্বাস। বাল্মীকি মুনি অযোধ্যাকাণ্ডে যেসব ঘটনার উল্লেখ করেছেন তার টুকরো টুকরো ছবি রয়েছে এই অযোধ্যায়। যা আমাদের ঘুরিয়ে দেখানো হলো।

মিনিবাস চালক আমাদের সরযু নদীর তীরেও নিয়ে গিয়েছিলেন। ওখানে কয়েকজন সন্ন্যাসী ও সাধুর সঙ্গে আমাদের দেখা হলো। একজন সাধু গাঁজার কলকিতে টান দিয়েই কথা বলা শুরু করলো আমাদের সঙ্গে। জানালো এখন থেকে ন-লাখ বছর আগে রামচন্দ্র এই শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

সাধু বাবার কথাগুলো শুনতে বেশ ভালোই লাগলো। রানা বললো, চলুন না সরযু নদীতে দু’হাত ধুয়ে নিই। নদীর পানি স্পর্শ করতে দেখেই এক সন্ন্যাসী বললেন, স্নান এখানেই সেরে নে, দ্যাখবি তোদের সব পাপ মোচন হয়ে গেছে।

এদিকে ত্রিশূল হাতে কয়েকজন সন্ন্যাসী আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। ত্রিশূল দেখে ভয় ভয় পেলাম। গাইড এসে বললেন, এবার চলুন। সন্ন্যাসীরা এ কথা শুনে অন্যত্র হেঁটে চলে গেল। গাইড-এও বললেন, আপনারা সাধু-সন্ন্যাসীদের সঙ্গে কোনো রকম কথা বলতে যাবেন না।

আবার মিনিবাসে। বাস এসে থামলো একটি দোকানের সামনে। এর পাশে আরও কয়েকটি দোকান। এরই পাশ দিয়ে রাস্তা বাঁ দিকে ঘুরে গেছে। ছোট গলি অথচ বিশাল বিশাল অট্টালিকা। কোনো কোনো বাড়ি দেখতে রাজ প্রাসাদের মতো।

এই বিশাল বিশাল বাড়ির স‍ামনে, বাড়ির গায়ে লেখা আছে রাম জন্মভূমি। গাইড জানালেন, অনেকেই দাবি করেন এখানেই রামের জন্মভূমি। তবে কোন বাড়িতে রাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন তা বলা মুশকিল। তবে রামকোর্টের বিতর্কিত অঞ্চলটি রাম জন্মভূমি বলে পরিচিত।

এখানকার মন্দির বা মসজিদে দেখলাম কয়েকটি করে গম্বুজ। ভেতরে প্রবেশ করতে দু’টি ফটক পার হতে হয়। গাইড আমাদেরকে নিয়ে এলো ওখানে। দেখলাম, দুই ফটকের মাথার উপর লেখা আছে রাম জন্মভূমি। রামকোর্টের কাছে কনক ভবন। বিশাল রাজভবন এটি। মোগল স্থাপত্যের ছাপ রয়েছে এখানে। দ্বিতল সাদা রংয়ের এ বাড়ির দেয়ালে লেখা দেখলাম শ্রী কনক ভবন অযোধ্যাজী।

দারুণ সাজানো-গোছানো বাড়ি। এই কনক ভবন রাজা দশরথ নির্মাণ করে কৈকেয়ীকে দিয়েছিলেন। সুমিত্রা ভবনটি দেখতে গিয়ে বেশ ভালই লাগলো। বাবরি মসজিদের ডানদিকেই এই সুমিত্রা ভবন। স্টেশন থেকে মাত্র ২ কি.মি. দূরে নিয়ে যাওয়া হলো আমাদের। ওখানে দেখলাম, একটি প্রাচীন মন্দির। কথিত আছে, মহারাজ কুশ এই মন্দির তৈরি করেছিলেন।

মন্দিরের ভেতরে আমরা কয়েকজন ট্যুরিস্ট ঢুকতে চাইলে একজন সন্ন্যাসী বাধা দিলেন। বললেন, ওখানে কয়েকশ’ বিষধর সাপ বাস করে। ওদের কাজ সাধারণ মানুষ দেখা মাত্রই তাদেরকে দংশন করা। যতোই হরিবোল বলে জপ করিস না কেন, কাজ হবে না। ওখানে ঢুকলে সাপের দংশনেই তোদের মরতে হবে।

সন্ন্যাসীর এ কথাগুলো শুনে রানা আমাকে বললো, কেউ যদি যায় যাক-আমরা কিন্তু যাচ্ছি না। মন্দিরে ঢুকতে কেউ আর সাহস দেখালো না। এবার মিনিবাস চললো মণি পর্বতের দিকে। এই মণি পর্বত নিয়ে নানা বিশ্বাস। লক্ষ্মণ আহত হলে হনুমান হিমালয়ে গিয়ে সঞ্জীবনী ওষুধ খুঁজে না পেয়ে পাহাড়টিকে মাথায় করে নিয়ে আসেন। অযোধ্যার উপর দিয়ে যাবার সময় তিনি বিশ্রাম নিয়েছিলেন এই পাহাড়ে। এখানে পাথর দিয়েই তৈরি হয়েছিল রামকোর্টের মন্দির।

রামেরা চার ভাই সকাল বেলা প্রতিদিন দাঁতন করতে যেতেন একটি পুকুরে, সেই স্থানটি এখন দাঁতন ক্ষেত্র নামে পরিচিত। ওখানে দেখলাম, পুকুরের চারপাশে চারটি থামের ওপর চার ভাইয়ের নাম লেখা। আছে সীতার রান্নাঘর। আমরা এসব দেখে দেখে তো রীতিমতো থ খেয়ে গেলাম। তুলসী স্মারক ভবনটি দেখে জানলাম, তুলসী দাস অযোধ্যার এই ভবনে বসেই রচনা করেছিলেন তার অমর সৃষ্টি।

তুলসী স্মারক ভবনকে তুলসী চৌরাও বলা হয়। রামচরিত মানসের সৃষ্টিকারী তুলসী দাস স্ত্রীর সঙ্গে অভিমান করে বানারস চলে আসেন। সেখান থেকে এলেন এই অযোধ্যায়। তুলসী স্মারক ভবনে এখন বসেছে মন্দির। রানা ও আমি  গাইডকে একটি টিলা ঘুরে আসার কথা বলতেই গাইড বাধা দিলেন। জানালেন, টিলার পরেই একটি বট গাছ আছে তার পাশেই শ্মশান ঘাট। দিনে দুপুরেও ওখানে যাওয়া নিরাপদ নয়। ওখানে নাকি আগুন জ্বলে আর নেভে। ওখানে নাকি ভূত-পেত্নি থাকে। তাই আমাদের আর যাওয়া হলো না দূরের বটগাছ আর টিলার কাছে।

এদিকে দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল নেমে এসেছে। গাড়ি থেকে রামলীলা ময়দানটি খুবই সুন্দর সাজানো গোছানো মনে হলো। এর পাশেই সরযু নদী। তুলসী উদ্যান, নয়াঘাট, গুরুদ্বার, ব্রহ্মকুণ্ড, অমাব্য, মন্দিরও দেখানো হলো আমাদেরকে। এখানকার সরযু নদী গঙ্গার মতোই পবিত্র। ঘাট বাঁধানো। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ পূণ্য করার জন্য আসেন এখানে। এখানকার রামঘাটে রামচন্দ্রকে সৎকার করা হয়েছিল বলে গাইডের মুখে শুনলাম। যারাই এখানে আসেন তারা পবিত্র এই নদীতে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করে যান।

অযোধ্যায় গিয়ে আরও জানলাম, প্রতি বছর এখানে মেলা হয়। তার মধ্যে নভেম্বর মাসে রামের বিবাহ, জুন-জুলাই মাসে রথযাত্রা, আগস্ট মাসে ঝুলনমেলা, মার্চ-এপ্রিলে রাম নবমী আর সরযুস্নান অনুষ্ঠিত হয় অক্টোবর-নভেম্বরে। তবে মার্চ-এপ্রিলে রাম নবমী মেলায় না যাওয়াই ভালো। মেলার সময় এখানে প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটে। তখন নানা ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেও থাকে।

একদিনে অযোধ্যা দেখে সন্ধ্যার আগেই আমরা ফিরে এলাম ফৈজাবাদে। মাত্র ১০ মিনিট সময় লেগেছিল অযোধ্যা থেকে ফৈজাবাদে আসতে। ফৈজাবাদে ছিলাম ৩ দিন। ফৈজাবাদ মুসলিম প্রধান অঞ্চল। এখানে দেখেছি মুসলিম স্থাপত্যের ঘরবাড়ি, পুরানো রাজমহল। বাবু বেগম সুজা-উদ-দৌলার সমাধি রয়েছে এই ফৈজাবাদ শহরে।

ফৈজাবাদের জাদুঘরটিও ঘুরে দেখেছিলাম। তবে একটি কথা না বললেই নয়, অযোধ্যায় কিন্তু আমরা বেশ কিছু মসজিদ দেখেছিলাম। কিন্তু গাইড ইচ্ছে করেই মসজিদগুলো দেখাননি। আমার অযোধ্যা ভ্রমণের কথা পড়ে অনেক হিন্দু ভাই-বোন হয়তো তাদের তীর্থস্থান অযোধ্যা দেখতে আগ্রহী হবেন। আর এজন্যই অযোধ্যা সম্পর্কে কিছু তথ্য উল্লেখ করা হলো।

হিন্দু তীর্থস্থান বানারস থেকে ১৯০ কি.মি. দূরে অযোধ্যা। লক্ষ্ণৌর দূরত্ব ১৩৫ কি.মি। বানারস থেকে বাসে অযোধ্যা পৌঁছতে সময় লাগে ৪ ঘণ্টা। কলকাতার হাওড়া থেকে রাতের দুন এক্সপ্রেস সকালে পৌঁছে বানারসে। সেই ট্রেনই অযোধ্যা পৌঁছে দেয়। অযোধ্যায় যদি কেউ রাত কাটাতে চান তাহলে উত্তর প্রদেশ পর্যটন বিভাগের বাংলোতে ওঠাই ভালো। এটি অযোধ্যা স্টেশন রোডে অবস্থিত। অযোধ্যা শহরে কখনও একা যাওয়া ঠিক নয়, এক সঙ্গে দু’জন কিংবা আরও বেশি যাওয়াই নিরাপদ। একা পেয়ে সন্ন্যাসী ও সাধুরা কখন যে কোন বিপদে ফেলে দেবে তা বলা মুশকিল। অন্তত একদিনে অযোধ্যা বেড়িয়ে আমার কাছে তাই মনে হয়েছে। আজও ভোলা সম্ভব হয়নি অযোধ্যা ভ্রমণের কথা।

বাংলাদেশ সময়:   ঘণ্টা, জুন, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।