নানা ঝড়ঝাপটার মধ্যেও রাঙামাটির নয়নলোভা সৌন্দর্য আজও ফুরিয়ে যায়নি। যে দিকে চোখ যায় দেখা মেলে পাহাড়-অরণ্য-ঝর্না আর হ্রদ।
উপজাতি বা আদিবাসী কিংবা পাহাড়িদের শহর বলে জানতাম রাঙামাটিকে। সম্প্রতি রাঙামাটি ভ্রমণে গিয়ে প্রধান সড়কগুলোতে পাহাড়িদের তেমন আর চোখে পড়লো না কোথাও। হোটেল-রেঁস্তোরা-দোকানপাটে পাহাড়ি থেকে বাঙালিই এখন বেশি।
রিজার্ভবাজারে আদিবাসীদের না দেখে রীতিমতো ‘থ’ খেয়ে গেলাম। এক জনের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, বনরূপা ও আসাম বস্তিতে গেলে মগ ও চাকমাদের দেখা মিলবে। ভাবলাম, খুঁজে খুঁজে পাহাড়িদের দেখবো! ৪৪ বছর আগেতো এমনটি ছিলো না!!
মনে পড়ে, ১৯৭২ সালে কলকাতায় বেড়াতে গিয়ে বিখ্যাত নৃত্য তারকা সাধনা বসুর সঙ্গে দেখা করতেই তিনি হাসতে হাসতে বললেন, তুমিতো আমার ‘আলীবাবা’ ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে দেখা করতে এলে...।
পরক্ষণেই তিনি বললেন, রাঙামাটিতে কখনো গিয়েছো? বললাম, কেন নয়। তাকে এ-ও জানিয়েছিলাম, আপনি রাঙামাটিতে একবার এসেছিলেন, ওমর খৈয়াম নাটকে নৃত্য প্রদর্শনও করেছিলেন...। কথাগুলো শুনে উনি আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান শহর রাঙামাটির সৌন্দর্যের কথা শুনেছিলাম, ১৯৬৬-৬৭ সালের দিকে। চাকমা, মগ, মুরং, তঞ্চগ্যা, টিপরাদের দেখার আগ্রহ নিয়ে প্রথম রাঙামাটিতে এলাম ১৯৭০ সালে।
গৌতম চাকমা নামে এক পত্রবন্ধুর আমন্ত্রণে সেবার পাহাড়িয়া শহরে গিয়ে দেখেছিলাম শুধুই পাহাড়িদের। তবে তখন দু’চার জন বাঙালি চোখে পড়েছিলো, এখন যেমন পাহাড়িদের-ওইটুকুই।
৪৪ বছর আগের রাঙামাটিতে আরও দেখেছি-পাহাড়ি রমনীরা পিঠে ডালা বেঁধে পাহাড়িয়া পথ ধরে বাজারে আসতেন। বাজারে চুরুটে টান দিয়ে মগ নয়তো চাকমা নারীরা ফল বিক্রি করতেন। ওদের দিকে তাকাতেই মুখে ফুটে উঠতো এক ঝিলিক হাসি।
পাহাড়ের গায়ে দেখেছি পাহাড়িদের ফলানো কত রকমের সবজি। জুম চাষও করতো তারা । পাহাড়িয়া ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে নৌকায় বরকল, শুভলং, মারিশ্যা, নানিয়ারচর, বিলাইছড়ি, কাসালং যেতে যেতে দেখেছি কর্ণফুলী হ্রদের দুইপাশে পাহাড়ের পর পাহাড়।
চট্টগ্রাম থেকে রাঙামাটিতে নদী পথে লঞ্চ কিংবা বড় বড় বোটে করে আসার একমাত্র পথ ছিল। সময়ের ব্যবধানে কত কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন চট্টগ্রাম থেকে মাত্র আড়াই ঘণ্টায় বাস জার্নিতে এই রাঙামাটিতে পৌঁছানো যায়।
কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হলো। তারা জানালেন, নোয়াখালি, বরিশাল, কুমিল্লা, রংপুর অঞ্চল থেকেই ১৯৭৭-৭৮ সালের দিকে এখানে এসে বসতি স্থাপন শুরু করে বাঙালিরা।
ভূমিহীনদের এই রাঙামাটিতে পুর্নবাসন করা হয় তখন। কয়েক বছরের ব্যবধানে রাঙামটির চিত্র পাল্টে গেল। এবার রাঙামাটিতে এসে দেখলাম মগ, চাকমা, টিপরা, মুরংদের সেই রাঙামাটিও আজ আর নেই।
তাদের ঐতিহ্যও যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। পর্যটন এলাকা হিসেবেও রাঙামাটি যেন চোখে পড়ার মতো নয়। একজন বিদেশি ট্যুরিস্টও চোখে পড়লো না। যাদের গিয়ে দেখলাম, তারা কেউ অফিসিয়াল কাজে এসেছেন নয়তো এনজিওর লোকজন।
চট্টগ্রাম থেকে রাঙামাটি যাবার রাস্তাটিও আগের মতো সুন্দর নয়। দেখলে মনে হয়, অনেকদিন ধরে রাস্তা সংস্কার করা হচ্ছে না। চট্টগ্রামের পরে রাস্তার দুইপাশে হাটবাজারের কোনো অভাব নেই। দেখা যায়, যানবাহন রাস্তার মধ্যখানে রেখে ড্রাইভার বসে আছে নয়তো চায়ের দোকনে ঢুকেছে।
এ অবস্থায় এ পথের পাশে রাখা বাসগুলো চলাচলে সমস্যা সৃষ্টি করেছে। ভ্রমণে যারা এ পথে আসেন তাদের মাথায় প্রতিনিয়ত একটাই টেনশন- হরতাল, অবরোধ ডেকে বসবে নাতো কেউ।
রাঙামাটিতে পর্যটন করপোরেশন হোটেল মোটেল স্থাপন করে তাদের দায়িত্ব শেষ করে বসে আছে। হ্রদের শহর রাঙামাটিতে সকাল-দুপুর-বিকেলে বোটে, স্পিডবোটে, ছোট লঞ্চে বেড়ানোর জন্য কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এখানে ট্যুরিস্ট একবার এসে পড়লে দ্বিতীয়বার যাবার আর কোনো আগ্রহ দেখাবে না।
প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।
আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।
প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন [email protected] এই ঠিকানায়।
লেখক: লিয়াকত হোসেন খোকন
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
বাংলাদেশ সময়: ১৫২৬ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০১৪