‘কোনো দেশকে ভালো বুঝতে হলে অবশ্যই তার রাজধানীতে যেতে হবে’ এ রকম কথা কোনো মনিষী বলে গেছেন কিনা জানি না, তবে ঠিক করলাম ওয়াশিংটন ডিসি ভ্রমণ করতে হবে।
নিউ ইয়র্ক থেকে ওয়াশিংটন ডিসির দূরত্ব বাসে প্রায় ৪-৫ ঘণ্টার পথ।
আমেরিকার রাজধানীর প্রাচীন নাম ছিলো ‘ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়া’। বর্তমানে এটি ওয়াশিংটন ডিসি নামে পরিচিত। ডিসি মূলত পূর্ব নাম ‘ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়া’র সংক্ষিপ্ত রূপ।
মেরিল্যান্ড এবং ভার্জিনিয়া স্টেট’র কিছু অংশ নিয়ে ১৭৯০ সালে আমেরিকার প্রথম রাজধানী ‘ফিলাডেলফিয়া’ কে ওয়াশিংটন ডিসিতে স্থানান্তর করা হয়। এটি কোনো স্টেটের অংশ না, একটি স্বতন্ত্র টেরিটরি।
পোটোম্যাক নদীর তীরে অবস্থিত ওয়াশিংটন ডিসির জনসংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। ওয়াশিংটন ডিসির অধিবাসীরা কংগ্রেস নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন না, একথা হয়তো অনেকেই জানেন না।
একটি জরিপে দেখা গেছে, খোদ যুক্তরাষ্ট্রের ৮০ শতাংশ মানুষ এ বিষয়টি জানেন না। ডিসি ভোট নামের একটি সংগঠন গত দশ বছর ধরে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করছে। বর্তমানে এই সংগঠন ওয়াশিংটন ডিসির ভোটাধিকার নামের একটি বিল পাস করানোর জন্য চেষ্টা করছে।
ওয়াশিংটন ডিসি একেবারে কোলাহলমুক্ত শহর। এ শহরের আয়তন মাত্র ৬৮ বর্গমাইল বা ১৭৭ বর্গাকিলোমিটার। বিশালাকার রাস্তা আর বড় বড় দালান-কোঠা দিয়ে সুসজ্জিত। তবে এদের কোনটিই খুব উঁচু নয়। প্রতিটি দালানের সাথে মার্কিনিদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে। ইউএসএ’র অন্যসব বড় বড় শহরে সব দালানগুলো বেড়েছে উপরের দিকে। কিন্তু এই ওয়াশিংটন ডিসিতে সেটা বেড়েছে পাশের দিকে বা প্রস্থের দিকে। অত্যন্ত রুচিশীল আর আধুনিক নির্মাণশৈলীর দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপনাগুলোই বলে দেয় এই শহর বিশেষ একটা কিছু।
পেন্টাগনের কথাই ধরা যাক, ফ্লোর’র আয়তনে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অফিস, প্রায় আশিটি ফুটবল মাঠের সমান এবং পঁচিশ হাজারের বেশি মানুষ এখানে কাজ করের। আসলে পেন্টাগন নিজেই যেনো একটা ছোটো শহর।
ইউএস পার্লামেন্ট ভবনের নাম ক্যাপিটাল হল। ক্যাপিটাল হিলের চারদিকেই প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর। ক্যাপিটাল হিলে পর্যটকদের ঘুরে দেখার সুযোগ আছে। ইউএস ক্যাপিটালের পাশেই রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি-‘লাইব্রেরি অব কংগ্রেস’। এখানে রাখা আছে প্রায় আড়াই কোটি পুস্তক।
১৬০০ পেনসিলভ্যানিয়া অ্যাভিনিউ, ওয়াশিংটন ডিসি, এই ঠিকানা যে ত্রিতল বাড়িটির, তার নাম হোয়াইট হাউস। হোয়াইট হাউস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির দাপ্তরিক বাসভবন। এই বাসভবনটি ১৭৯২ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার পর থেকে সব রাষ্ট্রপতিরই বাসভবন হয়ে ওঠে এটি, একমাত্র জর্জ ওয়াশিংটন ছাড়া, যিনি ছিলেন এর রূপকার।
১৮১২ সালে শুরু হয় ইংল্যান্ড-আমেরিকা যুদ্ধ। এই যুদ্ধ চলাকালে ১৮১৪ সালের ২৪ আগস্ট ব্রিটিশ সেনাবাহিনী হোয়াইট হাউস দখল করে নেয়। সে সময় তারা পুরো ভবন আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।
নকশাকার জেমস হোবানের পরামর্শ নিয়ে আমেরিকানরা আবার সেই আগুনে পোড়া ভবনের সংস্কার কাজ শুরু করে।
ভবনটির বিভিন্ন জায়গায় আগুন ও ধোঁয়ার দাগ ঢাকতে এর দেয়ালে সাদা রঙ করা হয়। সেই থেকে মূলত এটি ‘হোয়াইট হাউস’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে থাকে। এই নামের স্বীকৃতি পেতে সময় লাগে আরও ৮৫ বছর। ১৯০২ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থিয়েডোর রুজভেল্ট এই নামের স্বীকৃতি দেন। তখন থেকে সরকারিভাবে এর নামকরণ করা হয় ‘হোয়াইট হাউস’।
ওয়াশিংটর ডিসির প্রতিটি ভবনই দেখার মতো। ন্যাশনাল মল এখানকার সবচে বড় পার্ক, যেটি ডাউন টাউনে লিংকন মেমোরিয়াল ও ইউনাইটেড স্টেস ক্যাপিটালের মাঝামাঝিতে অবস্থিত। রাজনীতিবিদরা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে এই মল ব্যবহার করে থাকেন। বিভিন্ন মৌসুমে মেলা, ফেস্টিভ্যাল বা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের ব্যবহার করা হয় এই ন্যাশনাল মল।
এই মলের পাশে এবং হোয়াইট হাউসের দক্ষিণে রয়েছে জর্জ ওয়াশিংটনের মনুমেন্ট এবং জেফারসন মেমোরিয়াল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতির ধারক ন্যাশনাল ওয়ার্ল্ড ওয়্যার টু মেমোরিয়াল এবং লিংকন মেমোরিয়াল রিফলেকটিং পুল, কোরিয়ান ওয়্যার ভেটারনস মেমোরিয়াল।
ওয়াশিংটন ডিসির ঐহিত্যবাহী ভবন ন্যাশনাল আর্কাইভ। বিশাল ভবনের ভেতরে বাইরে শতশত বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধারণ করে আছে। আছে লাইব্রেরি অব কংগ্রেস, সুপ্রিম কোর্ট ভবন,পুরনো সিনেট চেম্বার ভবন, জাতীয় চিড়িয়াখানা, ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি, ন্যাশনাল অ্যায়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়াম, আর্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ বিল্ডিং, এস ডিলন রিপলে সেন্টার, স্মিতিসোনিয়ান ইন্সটিটিউশন বিল্ডিং, ন্যাশনাল পোট্রেট গ্যালারি, ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব আমেরিকান হিস্ট্রি, ন্যাশনাল পোস্টাল মিউজিয়াম, জুডিশিয়ারি স্কোয়ার,ন্যাশনাল গ্যালারি অব আর্টস, আছে জন এফ কেনেডি সেন্টার ফর দ্য পারফরমিং আর্টস, ন্যাশনাল অপেরা হাউস, ফোর্ড থিয়েটারসহ আরও কতো ঐহিত্যবাহী ভবন।
ওয়াশিংটন ডিসিতে এক ডজনেরও বেশি জাদুঘর আছে। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব আমেরিকান হিস্ট্রি, বড় জাদুঘরগুলোর মধ্যে একটি। এ যাদুঘরের সংগ্রহের মধ্যে আছে ৩ মিলিয়নেরও বেশি ঐতিহাসিক নিদর্শন। এটির মোট আয়তন প্রায় ৭৫০,০০০ বর্গফুট। মাদাম তুসোর মিউজিয়ামে আছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মোমের তৈরি প্রেসিডেন্টের প্রতিকৃতি।
মার্কিন রাজধানী বলেই হয়তো মাদাম তুসোর এই শাখাটিতে মার্কিন রাষ্ট্রপতিদের আধিক্য। প্রত্যেকটি পুতুল বানানোর ক্ষেত্রে অবাক করার মত নৈপুণ্যের পরিচয় দেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু জায়গায় আসল মানুষ মনে করে ধাক্কা লাগবে বা বিরক্ত হবে ভেবে থেমে যাচ্ছিলাম। পরে দেখি এটাও মূর্তি।
জাদুঘরের থেকে বের হবার ঠিক আগে দরজার ডানপাশে ল্যারি কিং দাঁড়ানো এবং বামপাশে একটি মেয়ে ল্যারি কিং এর মূর্তির ছবি তুলছে। ছবি তোলার সময় সামনে দিয়ে যাওয়া অভদ্রতা তাই অপেক্ষা করার একপর্যায়ে খেয়াল করলাম ছবি তুলতে থাকা মেয়েটিও আরেকটি মূর্তি।
ওয়াশিংটনে মহাকাশ জাদুঘর পরিদর্শন এক মনোরম অভিজ্ঞতা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন যুদ্ধবিমান থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক মার্কিন স্টিল্থ জঙ্গি বিমান পর্যন্ত অনেক কিছুর রেপ্লিকা রক্ষিত আছে এই জাদুঘরে।
ওয়াশিংটন মনুমেন্ট এই স্মৃতিস্তম্ভটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের স্মৃতিতে ১৮৮৪ সালে নির্মিত হয়। উচ্চতা ৫৫৫ ফুট। জর্জ ওয়াশিংটন’র মৃত্যুর পর ১০০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে এটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়।
দু'দফায় এটির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। নির্মাণ শেষে এটি ছিলো তখনকার সময়ের সবচেয়ে উঁচু ভবন। বর্তমানে এটি ওয়াশিংটন ডিসির সর্বোচ্চ ভবন এবং বিশ্বের সর্বোচ্চ পাথর নির্মিত কাঠামো।
এবার আসি লিঙ্কন মেমোরিয়ালের কথায়। আব্রাহাম লিঙ্কন। ইউএসএর সন্মানিত প্রেসিডেন্টদের মধ্যে একজন। লিঙ্কন মেমোরিয়ালের সিঁড়িতে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে মনোরম লেক আর খানিকটা দূরে সুউচ্চ ওয়াশিংটন মনুমেন্ট।
ওয়াশিংটন ডিসি জুড়েও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য চেরি গাছ। বসন্তে সেখানেও ফোটে হাজার হাজার চেরি ফুল। সেই আনন্দে উৎসবে মাতে ওয়াশিংটন ডিসি।
প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।
আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।
প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন [email protected] এই ঠিকানায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩০ ঘণ্টা, জুলাই ০৪, ২০১৪