ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

আওয়ামী লীগ

৭৫’র পর ২১ বছর ক্ষমতায় যেতে না পারার কারণ বললেন হাসিনা

মহিউদ্দিন মাহমুদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৯
৭৫’র পর ২১ বছর ক্ষমতায় যেতে না পারার কারণ বললেন হাসিনা ছবি: পিআইডি

ঢাকা: ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্বগহণের পর দলের ভেতরে-বাইরের ষড়যন্ত, অসহযোগিতা, দলে গ্রুপিং-ভাঙনসহ অজানা অনেক কথা তৃণমূল নেতাদের কাছে তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আপনাদের মনে আছে এই সংগঠন গোছাতে কম কষ্ট করতে হয়নি।’

১৯৭৫’র পর ক্ষমতায় আসতে আওয়ামী লীগকে ২১ বছর অপেক্ষার কারণ তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, “হয়তো ৮০’র দশকেই আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে পারতো, নির্বাচন করে জয়ী হতে পারতাম। ”
 
রোববার (২২ ডিসেম্বর) রাতে গণভবনে একুশতম জাতীয় সম্মেলনে পুনরায় আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানান বিভিন্ন পর্যায়ের তৃণমূল নেতারা।

শুভেচ্ছা বিনিময়কালে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্বপালন করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় কষ্টের কথাগুলো তৃণমূল নেতাদের কাছে তুলে ধরেন তিনি।
 
এর আগে শনিবার (২১ ডিসেম্বর) আওয়ামী লীগের ২১ জাতীয় সম্মেলনে টানা নবমবারের মতো দলটির সভাপতি নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।
 
শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানের সূচনা বক্তব্যের পর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা মিডিয়ার ক্যামেরা বন্ধ করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আমাকে একটু মন খুলে কথা বলতে দাও।
 
১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের ভূমিকা নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করে তিনি বলেন, তখনও এত নেতা ছিল কিন্তু আমরা জাতির পিতাকে রক্ষা করতে পারিনি। ওনার লাশ পড়ে থাকল, কেউ এগিয়ে আসল না।
 
১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগ সভাপতির দায়িত্বগ্রহণের পর অনেকের অসহযোগিতা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, দলকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে এই আমি দেশে ফিরে সব চাচাদের (তৎকালীন সিনিয়র নেতা) দরজায় দরজায় ঘুরেছি। সবার কাছে গেছি। কিন্তু কার কাছে কি পেয়েছি, সব কথা আমি জানি। আমি সব কথা বলতে চাই না।
 
এর আগে সূচনা বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৭৫ এর ঘটনার পরে আবার আওয়ামী লীগের ওপর যে আঘাত আসলো- তখন এটাই ধারনা করেছিল যে আওয়ামী লীগ আর কখনো ক্ষমতায় যেতে পারবে না। এটাই ছিল সকলের পরিকল্পনা। ’
 
৮১ সালে বিদেশে থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হওয়া এব পরে দেশে ফিরে আসার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যাই হোক আমাকে নিয়ে আসা হয়। আমি চেষ্টা করেছি সংগঠন গোছাতে। আপনাদের মনে আছে এই সংগঠন গোছাতে কম কষ্ট করতে হয়নি। ’
 
‘সবচেয়ে দুঃখজনক হলো আমি ৮১ সালে আসলাম, ৮২ সালে একবার পার্টি ভাঙলো। এই ভাঙাটা আমার জন্য খুব ক্ষতিকর ছিল। ’
 
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার দুঃখ লাগে যে যাদের ওপর সবচেয়ে বেশি ভরসা করেছি, দেশের বাইরে থাকতে যারা আমার সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ করেছেন, আমি বাইরে থাকতে, ইন্ডিয়াতে থাকতে বা লন্ডনে থাকতে, যে তাদের সঙ্গে কাজ করবো তারাই আমাকে হতাশ করেছেন। ’
 
‘১৯৭৯ সালে মুক্তি পাওয়ার পর, সবাই আওয়ামী লীগের নেতারা যখন মুক্তি পেলো। ৮০ সালে লন্ডনে আমার সঙ্গে দেখা করেছে… আর ৭৯ সাল থেকে ইন্ডিয়াতে যখন আমার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তখন সব সময় আমাকে জিজ্ঞেস করতো তখন আমি সব সময় যার কথা বলে দিতাম, তিনি যাতে দলটা চালাতে পারেন তার কিছু ব্যবস্থাও আমি করে দিয়েছিলাম। যাদের যাদের জন্য করে দিয়েছি আমি ফিরে আসার পর তারাই আমার সঙ্গে বিট্রে করে চলে গিয়েছে।
 
‘এটা হচ্ছে আমাদের দুর্ভাগ্য। সব কিছু গুছিয়ে দিলাম, তখন আওয়ামী লীগের যারাই নেতা ছিলেন সবাই আমাদের কাছে জিজ্ঞেস করতেন। আমরা কাকে নিয়ে কাজ করবো, এত গ্রুপিং এর মধ্যে কোথায় যাবো।

.
 ভাঙন না হলে ৮০’র দশকেই আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে পারতো মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৮২ সালে আব্দুর রাজ্জাক সাহেব পার্টি ভেঙ্গে গেলো, এই যে মতিয়া আপা এখানে আছে, মতিয়া আপা তার পা ধরেছিল যে আপনি পার্টিটা ভেঙে যাইয়েন না। জলিল ভাই (প্রয়াত সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল) গিয়ে পা ধরেছিল যে পার্টিটা ভেঙে যাইয়েন না। আমি নিজে বলেছিলাম যে আপনি পার্টি ভেঙে যাচ্ছেন কেন? রাজনীতি তো আপনার সঙ্গে করে আসছি। আপনি ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, আমি ইন্টারমিডিয়েটে কলেজের ভিপি হলাম। … আপনি পার্টি ভাঙবেন কেন? উনি তখন বাকশাল করবেন এই বলে পার্টি ভাঙলেন। আর এই ভাঙাটা হয়ে গেলো আমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। ’
 
“ঐ ভাঙনটা যদি না হতো তাহলে হয়তো আওয়ামী লীগ ৮০’র দশকে সরকার গঠন করতো পারতো, নির্বাচন করে জয়ী হতে পারতাম। তখন আর এরশাদ ওভাবে মার্শাল ল’ দিয়ে ওভাবে গেড়ে বসতে পারতো না। ”
 
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক সরকার বিরোধী আন্দোলনের কথা তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘তারপরও এরশাদের বিরুদ্ধে আমরা যখন আন্দোলন করি তখনো একটা ষড়যন্ত্র ছিল, এক জেনারেলের পরিবর্তে আরেক জেনারেল। আর আমার স্ট্যান্ড ছিল নো, এক জেনারেলের পরিবর্তে আরেক জেনারেল না, আমরা গণতন্ত্র চাই। আমরা নির্বাচন চাই, গনতন্ত্র চাই। ’
 
‘এর জন্য অনেক সমালোচনার সম্মুখীন আমাকে হতে হয়েছে এটা ঠিক। অনেকে অনেক কথা বলেছে, অনেক ষড়যন্ত্র করেছে। কিন্তু আমি আমার বাবার কাছ থেকে যেটা শিখেছি যে যেটা নীতি হিসেবে জানবো, সেটা মেনে নিবো। সেখানে কে কি বললো সেটা বড় কথা না। আলটিমেটলি দেখা গেছে যে যেটা আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটা ঠিক ছিল। ’
 
শেখ হাসিনা বলেন, ‘দলের ভেতরে বাইরে সমালোচনা অনেক কিছু ছিল। ভাঙন হলো। কারণ আমি তখন কেবল আসছি। কেবল আসার পর যখন এ রকম একটা ধাক্কা খেলাম.. তারপর সারা বাংলাদেশ আমাকে ঘুরতে হয়েছে, সংগঠন তৈরি করতে হয়েছে। দিনের পর দিন মিটিং, রাতের পর রাত সবার সঙ্গে বসে আলোচনা করে করে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ সংগঠনগুলোকে নতুন ভাবে তৃণমূল থেকে গড়ে তুলতে হয়েছিল। ওভাবে সংগঠন করে করে আজকে সংগঠনটা একটা পর্যায়ে এসে গেছে। ’
 
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ছিল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে দেশ বেচে দিবে, আজান হবে না, মসজিদে উলু ধ্বনি হবে। এ রকম নানা অপপ্রচার কিন্তু করা হতো। সেগুলো আমাদের মোকাবেলা করতে হয়েছে, জবাব দিতে হয়েছে। ’
 
স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারপরও ৯১ সালে উনি (আব্দুর রাজ্জাক) আসলেন জোটের সঙ্গে নির্বাচন করতে। তাকে দুই সিট দিতে হবে। মাদারীপুর ও শরিয়তপুরে দুইটা সিট নিল আর সব জায়গা একজন করে প্রার্থী দাঁড় করায়ে দিয়ে, সেটা আবার কাঁচি মার্কা দিয়ে। মানে ঐ কাঁচি মার্কা আওয়ামী লীগের কাঁচি কাটা করা। ২/৪ হাজার করে ভোট কেটে নিল। ’
 
তিনি বলেন, ‘তারওপর নমিশন দেওয়ার সময় সব চাচাদের পছন্দ। …যদিও আমি বলেছিলাম এখানে ওমুক দিলে জিতবে। ইলেকশন জেতা কিন্তু আলাদা। অনেকে অনেক বড় নেতা হতে পারে কিন্তু জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়াটা কিন্তু আলাদা। কে মানুষের কাছে বেশি যেতে পেরেছেন, কে মানুষের সবচেয়ে বেশি আস্থা অর্জন করতে পেরেছেন। কে ভোট আনতে পারবেন এটা কিন্তু অংকের মতো হিসাবের ব্যাপার। ইলেকশন করাটা কিন্তু একদম অংকের মতো হিসাব। ’
 
‘জোটের মধে যদি বেঈমানি না হতো, নমিশনগুলো দিতে পারতাম তাহলে আমরা জয়ী হয়ে আসতে পারতাম। ভোট চলে গেল জোটে। তার মধ্যে ৩৫টি সিট জোটকে দিয়ে দেওয়া হল। যাদের কোনো ভোটই নাই। নইলে আওয়ামী লীগের ভোট কখনো জামানাত বাজেয়াপ্ত হয় না। সেটাও হলো। ’
 
১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এভাবে একটা হযবরল করে করা হলো। যার জন্ন আপনারা জানেন একানব্বই সালে নির্বাচনের পর আমি পদত্যাগ করলাম, যে আমি করবো না। আমার যদি স্বাধীনতাটুকু না থাকে, নমিশন দিয়ে যদি জিততেই না পারি। তাহলে পদে থেকে লাভটা কি। আমি পদত্যাগপত্র দিয়ে দিয়েছিলাম তখন। ’
 
‘যাই হোক আমাদের নেতাকর্মী সবাই, কবি সুফিয়া কামাল আমাকে চিঠি লিখলেন যে, না, তোমার এটা ছাড়া ঠিক হবে না। আমাদের পার্টির সবাই উঠে পড়ে লাগলো- যাই হোক আমি আবার দায়িত্ব নিলাম। ’
 
৭৫’র এ বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারপর থেকে চেষ্টা করলাম যে এবার নিজেদের মতো করে করবো। ছিয়ানব্বই সালে সরকার গঠন করবো। এত বাধার পরেও আমরা ছিয়ানব্বই সালে আসতে পারলাম। ২০০১ সালে আসতে পারলাম না। আপনারা জানেন ঐ গ্যাস বিক্রি নিয়ে আমার ওপর প্রচণ্ড চাপ। আমি বললাম যে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে আমি করবো না। এটা আওয়ামী লীগের নীতি না। আমরা ক্ষমতায় আসতে পারলাম না। ’
 
২০০৮ সালে বিপুল বিজয় নিশ্চিতে পূর্ব প্রস্তুতির কথা তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘২০০১ সালে হারার পর কোন কোন কেন্দ্রে আমরা হেরেছি তার একটা হিসাব করে আমাদের যত প্রার্থী ছিল- জেতা আর হারা না, যত প্রার্থী ছিল তাদের সঙ্গে বসি। দিনের পর দিন বসি। ইউনিয়ন নেতাদের নিয়ে এসে দশটা প্রশ্ন দিয়ে, প্রশ্নপত্র নিয়ে সায়েন্টিফিকালি প্রস্তুতি নেই। যার ফলটা পেয়েছি ২০০৮ সালে। ’

বালাদেশ: ০৫০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৯
এমইউএম/এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।