ঢাকা: বিজেএমইএ-বিকেএমইএসহ মালিকপক্ষের চাপে সরকার বার বার পেছাচ্ছে শ্রম আইনের সংশোধন। ২০০৬ এ চারদলীয় সরকারের করা শ্রম আইনের অসঙ্গতি ও অসম্পূর্ণতা তুলে ধরে তা সংশোধনের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থাকলেও তিন বছরেও তা সম্পন্ন করতে পারেনি মহাজোট সরকার।
এর ফলে দেশের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ কৃষিখাতে কাজ করলেও তারা এখনো পাননি শ্রমিকের স্বীকৃতি। আইনের আওতায় আসেনি গৃহস্থালী কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা। মাতৃত্বকালীন ছুটির সুবিধা বঞ্চিত রয়েছেন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের অসংখ্য নারী শ্রমিক। সম্পূর্ণতা পায়নি শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার খর্ব হয়ে আছে অনেক ক্ষেত্রেই।
সরকার তার কর্তব্য মনে করে বিজেএমইএসহ মালিকপক্ষকে বারবার সময় দিয়ে যাচ্ছে, এমনটাই জানালেন শ্রমমন্ত্রী।
শ্রমিকপক্ষ মনে করছে মালিকপক্ষের চাপেই সরকার আইন সংশোধন ত্বরান্বিত করতে পারছে না। এদিকে মালিকপক্ষের দাবি তাড়াহুড়ো করে কিছু হয় না। এর জন্য সময় চাই।
তবে শ্রম আইন বিশ্লেষক ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের মতে, শ্রম আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনীতে যেসব বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে তা মালিকপক্ষ মেনে নিতে পারছেন না বলেই বার বার তা পিছিয়ে যাচ্ছে।
তারা জানান, শিল্পে শান্তি রক্ষার্থে মালিকের মুনাফায় শ্রমিকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ও কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় শ্রমিক হতাহত হলে ক্ষতিপূরণ দ্বিগুণ করার প্রস্তাবের বিষয়েই মালিকপক্ষের মূল আপত্তি।
তবে ক্ষমতার তিন বছর পার হয়ে গেলেও শ্রম আইন বাস্তবায়ন করতে না পারাকে সরকারের অন্যতম ব্যর্থতা বলে দাবি করছেন শ্রমিকনেতারা।
সূত্র জানায়, ২০০৬ সালে প্রণীত শ্রম আইন প্রস্তাবিত সংশোধনী প্রক্রিয়ায় সরকার ও শ্রমিক নেতারা একমত পোষণ করলেও মালিকপক্ষ তাতে বাধ সাধে। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তার হস্তক্ষেপও কামনা করেছেন তারা।
ক্ষমতায় আসার পরপরই এই আইন সংশোধনের কাজ শুরু করে বর্তমান সরকার। শ্রমিক, মালিক, বেসরকারি সংগঠন সবাইকে নিয়ে এ আইন সংশোধন প্রক্রিয়ায় যুক্ত রাখা হয়। আইনটিকে যুগোপযোগী করতে ১২১টি ধারার বিভিন্ন অংশ সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
এরপর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় তৈরি আইনটির সংশোধনী প্রস্তাবের খসড়া ৯ ফেব্রুয়ারি টিসিসি (ট্রাইপাট্রিয়াট কনসালটেশন কমিটি)-তে উপস্থাপন করা হয় যেখানে শ্রমিক, মালিক, সরকারের সমান সংখ্যা প্রতিনিধিত্ব ছিলো।
টিসিসিতে উপস্থাপনের পর কোন ধরনের সময়ক্ষেপণের নিয়ম না থাকলেও মালিকপক্ষের অনুরোধে তাদেরকে প্রথমে একমাস ও পরে দুইমাস সময় দেওয়া হয়। আগামী ৯ মে এ সময়সীমা পার হবে।
শ্রমিক নেতাদের অভিযোগ, কালক্ষেপণ করে মালিকপক্ষের প্রতিনিধিত্বকারী প্রধান দুটি সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এ প্রক্রিয়াকে এতোটাই দীর্ঘায়িত করতে চাচ্ছেন যাতে এই আইনটি বর্তমান সরকারের আমলে আলোর মুখ না দেখে।
শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সমন্বয়কারী ও বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র’র সাধারণ সম্পাদক ডাঃ ওয়াজেদুল ইসলাম খান বাংলানিউজকে বলেন, “মালিকপক্ষের বারবার সময় চেয়ে নেওয়া সরকারের উপর আছর হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের সদিচ্ছা এবং চেষ্টা না থাকায় শ্রমআইন পাশের ব্যাপারটি ঝুলে যাচ্ছে। ”
তিনি বলেন, “ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে সুসম্পর্ক রেখে সারা বিশ্বে শিল্প যেখানে এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে শ্রম আইনের প্রতি মালিকদের অনীহা খুবই দুঃখজনক। এ আইনটি শ্রমিক অধিকার রক্ষাকবচ। শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার্থে আইনটি পাশ করানোকে আমরা ন্যায়সঙ্গত মনে করি। ”
সরকারের সদিচ্ছা থাকলে যেকোন সময়ে এটি পাশ করিয়ে কোটি কোটি শ্রমিকের অধিকার রক্ষা সম্ভব বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এ অভিযোগ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর আইন বিষয়ক কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, “হুট করে আইন পরিবর্তন চাপিয়ে দিলেই হয় না। মালিকরা সেটা কতটা সফলতার সাথে বাস্তবায়ন করতে পারবে সেটাও দেখতে হবে। সংশোধনীগুলো যাচাই করে দেখার জন্য সময় প্রয়োজন। তাই আমরা সরকারের কাছে সময় চেয়ে নিয়েছি। তা মোটেই অযৌক্তিক নয়। ”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রম ও প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের কন্ঠেও শোনা যায় একই সুর। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, “মালিক-শ্রমিকের সম্পর্ক সুশৃঙ্খল রাখাই শ্রম আইনের উদ্দেশ্য। কোন পক্ষই যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আইনটি পাশ করাতে হবে। ”
তিনি বলেন, “কোনো পক্ষ আইনটি ভালভাবে বোঝার জন্য যদি সময় চেয়ে নেয় তাহলে সময় দেয়াটা কর্তব্য মনে করে সরকার। ”
তবে মাত্রাতিরিক্ত সময় তাদেরকে দেওয়া হবে না জানিয়ে শ্রমমন্ত্রী বলেন, “প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে জোর করে হলেও এ বিষয়ে আবার আলোচনায় বসবে সরকার। ”
তবে সরকারের এ ‘আলোচনায় বসা’কে শুধুমাত্র দায়সারা বা সৌজন্য আলোচনা বলছেন শ্রমিক পক্ষ ও শ্রম আইন বিশ্লেষকরা।
শ্রম আইন ২০০৬ এর সংশোধন প্রস্তাবগুলোর মধ্যে উল্লেযোগ্য দিকগুলো হচ্ছে- কৃষি শ্রমিকের স্বীকৃতি প্রদান, শ্রমিক তথা কর্মীর সংজ্ঞা আরও ব্যাপক করা, শ্রমিকের অবসরগ্রহণের বয়স বৃদ্ধি, মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়ানো এবং তা ওই নারীর সুবিধাজনক সময়ে ভোগ করার ব্যবস্থা করা, পেশাগত ব্যাধিতে আক্রান্ত শ্রমিকের পরিপূর্ণ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, প্রতিষ্ঠানে সেফটি কমিটি গঠন করা, তিনশ বা ততোধিক কর্মী নিযুক্ত এমন প্রতিষ্ঠানে শ্রমকল্যাণ কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া, এক হাজার এর বেশি শ্রমিক থাকলে বিধি দ্বারা নির্ধারিত পন্থায় হাসপাতাল স্থাপন, নারী শ্রমিকরা যাতে তাদের শিশুদের বুকের দুধ পান করাতে পারেন তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া, সকল প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক গ্রুপ বীমা চালু করা, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা, শ্রম আদালত ও শ্রম আপিল আদালত বৃদ্ধি করা, ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের ক্ষেত্রে অন্ততপক্ষে পাঁচটি বিভাগে তার সংগঠন পরিচালনা করা, ইউনিয়নের কার্যনির্বাহী কমিটিতে ২০ শতাংশ দক্ষ শ্রমিক নেতাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, শ্রম আইনের বিভিন্ন ধারা অমান্য করার ক্ষেত্রে সাজার মেয়াদ বৃদ্ধি করা ইত্যাদি। তবে সংশোধনীর অন্যতম উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো শিল্পে শান্তি রক্ষার্থে মালিকের মুনাফায় শ্রমিকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। এছাড়া কর্মরত অবস্থায় শ্রমিকের মৃত্যুর ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দ্বিগুণ করার বিষয়টিও সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, আশির দশক থেকে দেশে পোশাক শিল্পে উন্নতি সাধনের পর শ্রম আইনের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। এরপরেই এ আইনের ক্রটিগুলো ধরা পড়ে। এ প্রেক্ষিতে ১৯৯২ সালে শ্রম আইনের ত্রুটিগুলো পরিমার্জন, পরিবর্ধন করতে শ্রম আইন কমিশন গঠন করা হয়। এ কমিশন প্রায় ১২ বছর পর ২০০৩ সালে একটি সুপারিশ প্রদান করে। সুপারিশ অনুযায়ী ২০০৬ সালে তৎকালীন সংসদে তড়িঘড়ি করে বিরোধী দলকে আলোচনার সুযোগ না দিয়ে দুই মিনিটের মধ্যে আইনটি পাস করা হয়। তখনই অভিযোগ ওঠে এ আইনে রয়েছে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি।
বাংলাদেশ সময় ১২৩৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৫, ২০১২
জেপি/ সম্পাদনা: মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।