ঢাকা : রেল পুলিশের কমান্ড্যান্ট (ঢাকা) এনামুল হক বলেছেন, ‘৯ এপ্রিল রাতে জিএম স্যার (ইউসুফ আলী মৃধা) আমাকে ফোন দেন। তার ফোন পেয়ে আমি বের হই।
মঙ্গলবার সকালে রেলওয়ে ভবনে এবং পরে দুপুরে পল্টনের একটি অফিসে বাংলানিউজের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। মঙ্গলবার জবানবন্দি দিতে রেলভবনে আসেন রেলওয়ের কমান্ড্যান্ট এনামুল হক। ১১টা ৩৫ মিনিটে তিনি রেলভবনে আসেন এবং ১১টা ৪২ মিনিটে রেলওয়ের মহাপরিচালকের কক্ষে প্রবেশ করেন।
এক ফাঁকে মহাপরিচালকের কক্ষ থেকে বের হলে সাংবাদিকরা তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। তিনি পরে গণমাধ্যমের সবাইকে ডেকে কথা বলবেন বলে দ্রুত লিফটে উঠে পড়েন। সাংবাদিকরাও তাকে খোঁজাখুঁজি করেন। অনেকবার তার মোবাইলে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
অবশেষে বাংলানিউজের এ প্রতিবেদক তাকে চার তলার একটি কক্ষে দেখতে পান। কিছু বলতে চাওয়ার আগেই প্রথমে তিনি বলেন, ‘প্লিজ কিছু বলবেন না। আমি এখন গণমাধ্যমকে কিছু বলতে চাই না। ’
অনেক অনুরোধের পর তিনি বাংলানিউজকে রেলওয়ে ভবনের একপ্রান্তে সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে কিছু কথা বলতে রাজি হন।
এনামুল হক বলেন, ‘আমাকে বলির পাঁঠা করা হয়েছে। আমি নির্দোষ। ’
গাড়ি কি রেলমন্ত্রীর বাসায় যাচ্ছিলো? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি জানি না, জানি না, জানি না। আমার জিএম আমাকে গাড়িতে উঠতে বলেছেন, তাই আমি উঠেছি। ’
এনামুল হক বলেন, ‘আমি নির্দোষ তবুও আমাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। ’
পত্রিকায় তার পদোন্নতি সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য এসেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি ১৮ বছর অ্যাসিসট্যান্ট কমান্ড্যান্ট থাকার পর কমান্ড্যান্ট হয়েছি। অথচ গণমাধ্যমে এসেছে, আমাকে নাকি দ্রুত প্রমোশন দেওয়া হয়েছে। ’
তিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন, ‘আমার কোনো বাড়ি নেই এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টও নেই। যদি এগুলো কেউ প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে আমি দান করে দেবো। ’
এছাড়া অফ দ্য রেকর্ডে কিছু কথা বলেন তিনি।
দুপুর ২টায় রেলভবনে তদন্ত কমিটির কাছে রেলের নিরাপত্তা বাহিনীর কমান্ড্যান্ট এনামুল হক লিখিত জবানবন্দি দেওয়ার পর বাংলানিউজের প্রতিবেদকের মোবাইলে ফোন দিয়ে বলেন, ‘লিখিত জবানবন্দি তো দিয়েছি। বাংলানিউজকে আমি মৌখিক জবানবন্দি দিতে চাই। তবে শর্ত হচ্ছে, আমি যেখানে আসতে বলবো সেখানে কাউকে আনতে পারবেন না। এসব শর্তে রাজি হলে আমি আপনাদের (বাংলানিউজকে) সেদিনকার ঘটনা যা আমি কোনো গণমাধ্যমকে বলিনি তা বলতে রাজি। ’
তিনি ঠিক আড়াইটায় পল্টনের একটি অফিসে যেতে বলেন। আড়াইটায় পল্টনের ওই অফিসে ফের বাংলানিউজের মুখোমুখি হন এনামুল হক। কথা বলার আগেই তিনি শর্ত দেন, তার বক্তব্য যাতে বিকৃত করে না উপস্থাপন করা হয় এবং হুবহু প্রকাশ করা হয়।
শুরুতেই তিনি বলেন, ‘লিখিত জবানবন্দি দেওয়ার আগেই রেলভবনের চার তলায় আমি আপনাকে কিছু বিষয় বলেছি। পরে ডিজির রুম থেকে বের হওয়ার পর টেলিভিশন সাংবাদিকরা ঘিরে ধরলে তাদের কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। তবে যে কথা আমি গণমাধ্যমকে বলিনি বা গণমাধ্যমে আসেনি তা জানাতেই আপনাকে এখানে আসতে বলেছি। ’
এরপর ৯ এপ্রিলের ঘটনার বর্ণনা দেন এনামুল হক। তিনি বলেন, ‘আমার বাসা শাহজাহানপুরের ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল সংলগ্ন ৩নং গেট দোহালেজ কোয়ার্টারের নিচতলায়। আমার বাসার সামনেই জিএম স্যারের {রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (পূর্বাঞ্চল) ইউসুফ আলী মৃধা} বাসা। রাত সাড়ে ৯টায় জিএম স্যার আমাকে ফোন করে তার বাসার সামনে আসতে বলেন। আমি হেঁটে তার বাসার সামনে গিয়ে দেখি, গাড়ির পেছনের সিটে জিএম স্যার ও তার স্ত্রী। আমি ড্রাইভারের পাশে সামনের সিটে বসি। ’ ‘গাড়ি চলতে থাকে। এক পর্যায়ে দেখি, জিএম স্যার ধানমণ্ডির ৩নং রোড়ে গাড়ি থামান। গাড়ি থেকে স্যার ও আমি নেমে পড়ি। আর স্যারের স্ত্রী ওই গাড়িতে করে তার বাবার বাসায় (ধানমণ্ডি) চলে যান। আমি ও স্যার ধানমণ্ডির ৩নং রোডের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। পনের কি বিশ মিনিট রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার পর রেলমন্ত্রীর এপিএস ফারুক (ওমর ফারুক তালুকদার) তার ড্রাইভারসহ আমাদের সামনে গাড়ি থামান। পেছনের সিটে রেলমন্ত্রীর এপিএস। দরজা খুলে পেছনের সিটে বসেন জিএম স্যার। আমি ড্রাইভারের পাশের সিটে বসি। পরে দেখি ড্রাইভার পিলখানায় বিজিবি দফতরে ঢুকে পড়ে ...’
এনামুল হক আরো বলেন, ‘পরদিন সকাল নয়টার দিকে গাড়িচালক আলী আজমকে রেখে পিলখানা থেকে আমাদের দু’জনকে ছেড়ে দেয় বিজিবি। ফারুকের গাড়িতে করেই আমরা পিলখানা ত্যাগ করি। ’
তিনি বলেন, ‘গাড়ির পেছনে টাকা ছিলো কি ছিলো না আমি কিছুই জানতাম না। গাড়ি কোথায় যাচ্ছে, তাও আমি জানতাম না। ’
আপনি তার সঙ্গে এত রাতে যাওয়ার কারণ কি?- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘জিএম স্যারের নিরপত্তা দেওয়া আমার কাজ। ৯ এপ্রিল রাতে আমাকে আসতে বলেন। তাই আমি যাই। ’
গাড়িচালক আলী আজমের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এপিএসের গাড়িচালক কোথায় তা আমার জানার কথাও নয়। জানিও না। ’
উল্লেখ্য, ৯ এপ্রিল মন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারের গাড়িতে বিপুল পরিমাণ টাকা পাওয়ার ঘটনা ঘটে। ওই সময় গাড়িতে ছিলেন এপিএস ওমর ফারুক ও রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (পূর্বাঞ্চল) ইউসুফ আলী মৃধা। ইউসুফ আলী মৃধার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন রেলওয়ের কমান্ড্যান্ট এনামুল হক।
রেলওয়েতে নিয়োগ বাবদ ঘুষ হিসেবে পাওয়া ৭০ লাখ টাকাসহ তারা পিলখানা বিজিবি সদর দফতরের প্রধান ফটকে আটক হন বলে অভিযোগ রয়েছে। পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
অভিযোগ উঠেছে, গাড়িটি রেলমন্ত্রীর বাসার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলো।
এ ঘটনায় গত রোববার রেলওয়ে ভবনে সংবাদ সম্মেলন করে সদ্য পদত্যাগী রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত জানান, সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ওমর ফারুক তালুকদারকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। রেলের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (পূর্বাঞ্চল) ইউসুফ আলী মৃধা ও কমান্ড্যান্ট এনামুল হককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
সোমবার সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংবাদ সম্মেলন করে মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
বাংলাদেশ সময় : ১৩৪২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১২
এডিএ
সম্পাদনা : অশোকেশ রায় ও আহমেদ জুয়েল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর