ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

ভর্তি কোচিং সংস্কৃতির কারণে পিছিয়ে পড়ছেন গ্রামের শিক্ষার্থীরা!

মহিউদ্দিন মাহমুদ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৭ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০১২
ভর্তি কোচিং সংস্কৃতির কারণে পিছিয়ে পড়ছেন গ্রামের শিক্ষার্থীরা!

ঢাকা : বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে চালু থাকা কোচিং সংস্কৃতির কারণে পিছিয়ে পড়ছে গ্রাম ও মফস্বল এলাকার শিক্ষার্থীরা। এসব এলাকা থেকে রাজধানী ঢাকা মহানগরীতে ভর্তির লক্ষ্যে কোচিং করতে আসা শিক্ষার্থীদের পদে পদে নানা বিড়ম্বনা, আর্থিক ও অন্যান্য নানা সংকট এবং নাগরিক জীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত হতে না পারার নানা যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে।

ফলে ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় পড়াশোনা করতে না পেরে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর পক্ষে আর কাঙ্খিত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া সম্ভব হয় না।

মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে শহরে কোচিং করতে আসা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা নগরের পরিবেশে খাপ খেতে কয়েক মাস লেগে যায় তাদের। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হতে হয় যাদের ঢাকায় কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই।

মেস খোঁজা, মেসের জীবনে খাপ খাপ খেতে খেতে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। ভর্তি পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করার সময় থাকে না হাতে।

তার ওপর কোচিং খরচ ও শহরে থাকার জন্য হাজার হাজার টাকা খরচ করার ক্ষমতা নেই অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীর পরিবারের সন্তানদের। অনেকে কোচিং করতেই পারেন না। আবার অনেককে ব্যয়বহুল ঢাকার জীবনে অল্প টাকায় থাকতে গিয়ে নানামুখী সমস্যা পোহাতে হয়।

সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে চালু থাকা কোচিং সংস্কৃতির কারণে পিছিয়ে পড়ছে গ্রাম ও মফস্বল এলাকার শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে পয়সাওয়ালাদের দখলে। অথচ, স্বাধীন দেশ হিসেবে সবার জন্য শিক্ষার সমান অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ বছর বিভিন্ন মেডিক্যাল কোচিং সেন্টারগুলো শুধুমাত্র কোচিং ফি বাবদ ১২ হাজার টাকা নিচ্ছে। একইভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিংয়ের জন্য ১২ হাজার ও বিশ্ববিদ্যালয় কোচিং করতে ৯ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা নিচ্ছে। আর যদি কেউ সব কটিতেই কোচিং করতে চায় তবে কোচিং ফি বাবদ মোট খরচ হবে ৩২ থেকে ৩৬ হাজার টাকা।

এ রকম বড় অংকের টাকার সঙ্গে যোগ হবে থাকাসহ আনুষঙ্গিক আরো খরচ। ফলে কোচিং বাণিজ্য ব্যবস্থার কারণে পিছিয়ে পড়ছেন গ্রাম থেকে আসা শিক্ষার্থীরা। গরীবদের কাছেতো কোচিং করাটা অলীক চিন্তা ছাড়া কিছুই নয়।

চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার মনির হোসেন এসএসসি ও এইচএসসি দু’টি পরীক্ষায়ই জিপিএ-৫ অর্জন করেছেন। বাবা ভ্যানচালক হওয়ায় কোচিং করার সুযোগ হয়নি তার। দুই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে শেষ পর্যন্ত চাঁদপুর সরকারি কলেজে একাউন্টিং এ ভর্তি হন তিনি।

কুমিল্লার ফরহাদ হোসেন গতবার কোচিং করেও কোথাও ভর্তির সুযোগ পাননি। এবার আবার কোচিং করছেন।

ফরহাদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘একটা বছর জীবন থেকে চলে যাচ্ছে, এজন্য খারাপ লাগছে। গতবার ঢাকায় এসে এখানকার মেসের সঙ্গে খাপ খেতে বেশ সময় লেগেছে। মেসে পড়ার ভালো পরিবেশ পেতাম না। তার ওপরে প্রথম দিকে পেটের সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে অল্পতেই অসুস্থ হয়ে পড়তাম। ঢাকায় থাকতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবে যতোটুকু খরচ করা দরকার ততোটুকু খরচও করতে পারতাম না। ’

ফোকাস কোচিং সেন্টারে ভর্তি হতে আসা লক্ষীপুরের সুমন দাসের বাবা প্রিয়লাল দাস ক্ষোভ প্রকাশ করে বাংলানিউজকে বলেন, ‘একটা ছেলেকে ২ বছর উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে পড়াশোনার পর কেন তাকে আবার ভর্তি পরীক্ষার জন্য কোচিং করতে হবে? কলেজগুলো শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার উপযোগী করে গড়ে তুলতে না পারলে কলেজগুলো বন্ধ করে দেওয়া দরকার। শিক্ষার্থীদের শুধু কোচিংয়ের মাধ্যমে সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যবস্থা করা উচিত। ’  

তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির উপযোগী হতে কোচিং করার সংস্কৃতির মাধ্যমে এক শ্রেণীর লোকদের মুনাফার ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা হচ্ছে সেটা হল, আবারো ধনী-দরিদ্র এবং শহর ও গ্রামের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। ’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এস এম নজরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে এ কোচিং ব্যবস্থাকে পছন্দ করি না। এ কোচিংয়ের ফলে দেখা যায়, শহর ও শহরের আশপাশের এলাকার শিক্ষার্থীরা ভর্তির বেশি সুযোগ পাচ্ছে। গ্রাম বা মফস্বলের ছেলেরা ভর্তিযুদ্ধে পিছিয়ে যাচ্ছে। ’

তিনি বলেন, ‘গত বছরে বুয়েটে ভর্তির সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, প্রায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী শহর কিংবা শহর এলাকার। বাকি ১০ শতাংশ গ্রাম ও মফস্বল এলাকা থেকে আসা। ’

‘অথচ ২০ বছর আগে যখন কোচিং ছিল না, তখন ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রামের ছেলেরা বেশি সুযোগ পেতো। এখন গ্রামের মেধাগুলোর অপচয় হচ্ছে। ’

নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিগত ১০ বছরের প্রশ্ন বাছাই করে কোচিং সেন্টারগুলো গৎবাধা পদ্ধতিতে কিছু কৌশল শেখানো ছাড়া আর কিছুই করে না। এতে শিক্ষার গুণগত মানের কোনো পরিবর্তন হয় না। ’

‘তাই কোচিং সেন্টারগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া দরকার। সব প্রতিষ্ঠানে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা দরকার, যাতে কাউকে বৈষম্যের শিকার হতে না হয়। ’

বাংলাদেশ সময় : ১৭৩৭ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০১২
এমইউএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।