ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

রাজধানীজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি আর বালুর স্তুপে জনদুর্ভোগ

মনোয়ারুল ইসলাম রিবেল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫৩ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১২
রাজধানীজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি আর বালুর স্তুপে জনদুর্ভোগ

ঢাকা : প্রায় সারা ঢাকা শহরে এখন চলছে  খোঁড়াখুঁড়ির সিজনওয়ারি উৎসব। প্রতিবছর বর্ষাকালের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ কাজ চলে।

রাজধানীর পথ চলতে কিছুদূর পরপর হঠাৎ চোখের সামনে উদয় হয় রাস্তা খুঁড়ে তোলা ময়লা-আবর্জনা, মাটি আর বালুর স্তুপ।

বিশ্বরোড থেকে রাজধানীর সায়েদাবাদ সড়ক, রোকেয়া সরণী, মিরপুর সড়ক, কল্যাণপুর, মোহাম্মদপুর, খিলক্ষেত ও রামপুরার রাস্তাগুলোতে এসব কারণে জনদুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে।

ঢাকার রাস্তা ক্ষত-বিক্ষত করার এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে ওয়াসা, বিটিসিএল, বিপিডিসি, ইন্টারনেট সেবাদানকারী বিভিন্ন সংস্থা, ডিসিসিসহ অন্যান্য উন্নয়ন অংশীদাররা।

নগরবাসীর অভিযোগ, এসব সরকারি-বেসরকারি সংস্থার মধ্যে কোনো সমন্বয়ই নেই। সমন্বয়হীনতার কারণে এক প্রতিষ্ঠান রাস্তা খোঁড়ার পর দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্য প্রতিষ্ঠান তা মেরামত করে না।

সব সময় দেখা যায় জনগণের দীর্ঘ ভোগান্তির পর রাস্তা মেরামত হলেও আবার শুরু হয় অন্য প্রতিষ্ঠানের খোঁড়াখুঁড়ি। ফলে ভোগান্তির শেষ হয় না কিছুতেই। ভুক্তভোগীরা আরো অভিযোগ করছেন, অনেক ক্ষেত্রে পুরো রাস্তা বন্ধ করে আবার কখনো আংশিক বন্ধ করে এ খোঁড়াখুঁড়ির প্রতিযোগিতা চালানো হয়। ফলে যানবাহনের চাপ পড়ে অন্য রাস্তায়। এতে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। নষ্ট হয় অনেক কর্মঘন্টা।

সোমবার সকাল থেকে রাজধানীর রামপুরা, খিলক্ষেত, ধানমণ্ডি, মিরপুর রোডের দারুসসালাম, কল্যাণপুর, শ্যামলী, শিশুমেলা এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে মহানগরীর ব্যস্ততম এসব সড়কে দেখা দিয়েছে দীর্ঘ যানজট।

গাবতলী থেকে রাজধানীতে ঢোকার রাস্তায় চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। পাইপলাইন বসানোর জন্য রাস্তা খোঁড়ার কারণে প্রশস্ত রাস্তাটি এক রকম বন্ধই হয়ে আছে। রাস্তার এক পাশ দিয়ে যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হলেও খুঁড়ে রাখা মাটি, রাস্তার ভাঙা অংশ এবং পাইপ রাখার কারণে বাকি অংশ দিয়ে যান চলাচল প্রায় কঠিন। দীর্ঘ সময় ধরে যানজটে বসে থাকতে না পেরে অনেক যানবাহন উল্টোদিকের রাস্তা ব্যবহার করছেন। ফলে কোনো কোনো রাস্তার একদিকে খোঁড়াখুঁড়ি চললেও অন্য পাশে দীর্ঘ যানজট তৈরি হচ্ছে।

নাটকপাড়া বেইলি রোডকে এখন যানজট রোড বললে ভুল বলা হবে না। এখানে একদিকে যানজট, অন্যদিকে ড্রেন ও ম্যানহোলের পানি উপচে পড়ে রাস্তা সয়লাব। এ ময়লা-দুর্গন্ধযুক্ত নোংরা পানির মধ্যে চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছেন এলাকাবাসী।

সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের পর থেকেই রাস্তার অবস্থা নাজুক। রোডের পিচ ঢালাই উঠে গেছে অনেক আগেই। ছোট-বড় ড্রেন থেকে উপচে পড়া পানিতে খানাখন্দ ভর্তি। যেখানে সেখানে রাস্তার বেশির ভাগ জায়গা দখল করে গাড়ি পার্ক করে রাখা হয়। বিশেষ করে সকালে স্কুল ছুটির সময় গাড়ির সংখ্যা বাড়তে থাকে আর বাড়ে যানজটও। ফুটপাত সংস্কারের নামে ইট-বালু স্তূপ করে রাখা হয়েছে। ফলে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে চলা দায়।

শুধু যানজটই নয়, এ অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়িতে সৃষ্টি হচ্ছে প্রচুর ধুলোবালির। এতে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। শিশুসহ বয়স্করাও আক্রান্ত হচ্ছেন নানা ধরনের অসুখে।

এ ব্যাপারে হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ার‌ম্যান এবং প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ধুলাবালি নাক, মুখ দিয়ে ঢুকে মানুষের আয়ু কমাচ্ছে। শিশুদের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হচ্ছে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির। এতো ধুলাবালি নিয়ে জীবনযাপন স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্নক ক্ষতিকর। অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, কফ, যক্ষাসহ নানা ধরনের রোগ হচ্ছে বা অন্য রোগকে বাড়াচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র ও নগরবাসীর অভিযোগ, ডিসিসি দুই ভাগ হবার পাশাপাশি ঢাকাকে পরিচালনা করে ১৯ মন্ত্রণালয়ের ৫২ সংস্থা। এই ৫২টি সংস্থার কর্মকাণ্ডের কোনোটির সঙ্গে কোনোটির সমন্বয় নেই। কোনো কেন্দ্রীয় সমন্বয়কও নেই। নেই কোনো সমন্বিত পরিকল্পনাও। সমন্বয় তো দূরের কথা, অনেক ক্ষেত্রে রয়েছে তীব্র বিভাজন ও মতবিরোধ।

একটি সংস্থা কোনো উন্নয়ন কাজে হাত দিলে বেশিরভাগ সময় অন্য সংস্থাগুলো বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যেমন ওয়াসা, ডেসা, বিটিসিএল তাদের লাইনের জন্য রাস্তা কাটে। কিন্তু রাস্তার মালিকানা ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি)। নগরবাসীর দুর্ভোগ কমানোর জন্য ডিসিসিই বেশি দায়বদ্ধ। এসব সংস্থা রাস্তা কাটলেও নগরবাসী একচেটিয়া দোষ দেয় ডিসিসিরই। কারণ, ঢাকা ওয়াসা, বিটিসিএল, ডিপিডিসি, তিতাস গ্যাস রাস্তা খোঁড়ার আগে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে অবহিত করে।
    
রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত সড়ক কেটে চলছে ঢাকা ওয়াসার পাইপ ড্রেন স্থাপনের কাজ। আর মিরপুর ১ নম্বর থেকে রাসেল স্কয়ার হয়ে গ্রিন রোড পর্যন্ত চলছে পানি সরবরাহের পাইপলাইন স্থাপনের কাজ। এছাড়া মিরপুর ১৪ নম্বর থেকে মিরপুর ১০ নম্বর পর্যন্ত চলছে পাওয়ার গ্রিড কম্পানির ভূগর্ভস্থ কেবল স্থাপনের কাজ।

মিরপুর ১১ নম্বর থেকে পলাশনগর পর্যন্ত রাস্তা ভেঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত। গাবতলী থেকে জাতীয় সংসদ ভবনের কোনা পর্যন্ত রাস্তার এক পাশে কেটে আবার সেখানে ইট-বালু ফেলা হয়েছে। শ্যামলীতে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সামনের রাস্তার মাঝখানে লম্বা করে কেটে রাখা হয়েছে। সংসদ ভবন থেকে রাসেল স্কয়ার পর্যন্ত এলাকায় রাস্তার মাঝখানেকাটা হয়েছে। তালতলা থেকে শেওড়াপাড়া হয়ে কাজীপাড়া পর্যন্ত সমতল মজবুত পাকা রাস্তাটিও কাটা। মিরপুর ১০ নম্বর থেকে কাজীপাড়া পর্যন্ত সড়কের ইট-সুড়কি ফুটপাতের ওপর স্তূপ করে রাখা হয়েছে। আর বালুতো আছেই।

এ ব্যপারে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, ‘রাস্তা খোঁড়ার আগে ডিসিসিকে অবহিত করা হয়। ডিসিসির ডিমান্ড অনুযায়ী জরিমানা এবং মেরামত ব্যয় পরিশোধের পরই সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো রাস্তা খুঁড়ে উন্নয়ন কার্যক্রম চালায়। বিধি অনুযায়ী রাজধানীর কোনো সড়ক খননের সর্বোচ্চ ২৮ দিনের মধ্যে কাজ শেষ করার বাধ্য-বাধকতা রয়েছে। আমরা এসব নিয়ম মানার চেষ্টা করি। ’

তিনি আরো বলেন, ‘রাজধানীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী পানি সরবরাহে ওয়াসার পানির লাইন সংস্কারের বিষয়টি অপরিহার্য। সে লক্ষ্যেই বিভিন্ন সড়কে নতুন পাইপলাইন বসানো হচ্ছে। স্যুয়ারেজ ব্যবস্থার উন্নয়নেও চলছে ব্যাপক কার্যক্রম। তবে এ জন্য যে ভোগান্তির সৃষ্টি হয়েছে সে ব্যপারে আমরা সচেতন। ’

বিদ্যুতের লাইন বসানার কাজ করছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি। কোম্পানিটির ব্যবস্থাপক জামাল উল্লাহ বলেন, ‘অাশা করি নির্ধারিত সময়ের আগেই আমাদের কাজ শেষ হয়ে যাবে। আমরা জনগণের ভোগান্তি না করে কাজ করছি। ’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আসাদ জানান, ‘কাজের খোঁড়াখুঁড়ির ব্যাপারে সময় বেধে দেওয়া থাকে। কাজ সম্পন্ন করার জন্য ১৫ মাস সময় দেওয়া হয়েছে। তবে সবাই দ্রুতগতিতে কাজ করছে। আতি শিগগিরই কাজ শেষ হবে বলে আশা করি। জনগনের সুবিধার জন্যই এসব কাজ করা হচ্ছে। ’

বাংলাদেশ সময় : ১৮৪৮ ঘন্টা, মে ২১, ২০১২

এমআইআর
সম্পাদনা : অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।