ঢাকা: রেলের অর্থ কেলেঙ্কারির দায় থেকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে মুক্তি দেওয়ার পর এবার তার ছেলে সৌমেন সেনগুপ্তকেও ‘নির্দোষ’ সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে। অবৈধ অর্থে আইসিএক্স লাইসেন্স পাওয়ার অভিযোগ থেকে সুরঞ্জিতপুত্রকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়টি রোববারই অনুমোদন হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বৈঠকে।
তবে এই দায়মুক্তির কারণে সমালোচনার ঝড় উঠেছে বিভিন্ন মহলে। রেলের তদন্ত প্রতিবেদনের মতোই বিতর্কের মুখে পড়েছে দুদকের প্রতিবেদন। পিতা-পুত্রকে ‘দুর্নীতি’র অভিযোগ থেকে বাঁচিয়ে দিতেই এ দুই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে বলেও অভিযোগ তুলছেন অনেকে। এমনকি খোদ রেল মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝেই এ নিয়ে শুরু হয়েছে নানা নেতিবাচক কথাবার্তা।
দুদকের এক সূত্র বাংলানিউজকে জানিয়েছে, দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনের মূল মেসেজ বা বার্তাটি হচ্ছে বিটিআরসির ‘আইসিএক্স’ লাইসেন্সের পাঁচ কোটি টাকা সৌমেনের নয়; এ কারণে তিনি নির্দোষ। ’
অনেকটা একইভাবে এর আগে রেলের অর্থ কেলেঙ্কারির দায় থেকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়।
ওই ঘটনায় খোদ সুরঞ্জিত ও তার তৎকালীন এপিএস ওমর ফারুকের পলাতক গাড়িচালক আলী আযমের জবানবন্দি না নেওয়ায় ওই তদন্ত প্রতিবেদনের যথার্থতা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে, তেমনি তড়িঘড়ি সুরঞ্জিতপুত্রকে নির্দোষ সার্টিফিকেট দেওয়ায় দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনের বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
সুরঞ্জিতকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে মর্মে দেওয়া দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের দেওয়া বক্তব্য শেষ পর্যন্ত কেন কার্যকর করা হলো না প্রশ্ন উঠছে তা নিয়েও।
গুঞ্জন চলছে, অভিযোগের সঙ্গে পিতা-পুত্রের সংশ্লিষ্টতার পক্ষপাতহীন নিরপেক্ষ তদন্ত করতে নয়, বরং অভিযোগ থেকে তাদের দায়মুক্তি দিতেই পছন্দের লোক দিয়ে ওই দুই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিলো। আর রেলের তদন্ত কমিটি তো পদত্যাগের আগেই নিজেই গঠন করেছিলেন সুরঞ্জিত।
সুরঞ্জিতকে নির্দোষ ঘোষণা করলো তারই গড়া কমিটি
সাবেক রেলমন্ত্রী ও বর্তমান দপ্তরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেলমন্ত্রীর পদ থেকে অব্যাহতি নেওয়ার আগে তার মন্ত্রণালয়ের অর্থ কেলেংকারির ঘটনা অনুসন্ধানে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। সুরঞ্জিতের গড়া সেই তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয় রেলের মহাপরিচালক আবু তাহেরকে। সুরঞ্জিতের সেই তদন্ত কমিটি তাকে ‘নির্দোষ’ বলে অভিহিত করে।
রেলের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ৯ এপ্রিলের ঘটনায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সংশ্লিষ্টতা নেই।
ওই তদন্ত প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, গাড়িতে ৭০ লাখ টাকা ছিল এবং তা সুরঞ্জিতের সাবেক এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারের।
জানা গেছে, তদন্ত প্রতিবেদনে অনেক বিষয়েরই উত্তর নেই। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, এতো রাতে ব্যক্তিগত টাকা নিয়ে ওমর ফারুক কেন মন্ত্রীর বাসায় যাচ্ছিলেন? রাত গভীরে কেনইবা রেলের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধা, নিরাপত্তা বিভাগের কমান্ড্যান্ট এনামুল হককে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিলেন? বিজিবি দপ্তরের গেটে কড়া নিরাপত্তা থাকার পরও কীভাবে অবলীলায় মাইক্রোবাসটি পিলখানায় ঢুকে গিয়েছিল, ওই সময় তাদের গাড়ি কেন গেটে আটক করা যায়নি? এসব প্রশ্নের রহস্য উন্মোচন না করেই ‘সুরঞ্জিতের সংশ্লিষ্টতা নেই’ উল্লেখ করে রেলের তদন্ত কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
রেলের একটি সূত্র জানিয়েছে, ‘সুরঞ্জিত রেলওয়ের অর্থ কেলেংকারির সঙ্গে জড়িত নন’ এটা মাথায় রেখেই রেলের তদন্ত প্রতিবেদন করা হয়েছে। ’
তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগেই রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে গুঞ্জন ছিল যে, অর্থ কেলেংকারির ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি সুরঞ্জিতকে রক্ষা করতেই কাজ করছে।
জানা গেছে, রেলওয়ের মহাপরিচালক আবু তাহের ও মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শশী কুমার সিংহ অর্থ কেলেংকারির ঘটনা তদন্ত করলেও শশী কুমার সিংহ এ তদন্ত প্রতিবেদনে সুরঞ্জিতকে নির্দোষ প্রমাণ করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে সুরঞ্জিতকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য একটি মহলের চাপ ছিল বলেও জানিয়েছে অপর এক সূত্র।
সুরঞ্জিতকে জিজ্ঞাসাবাদই করেনি দুদক
গত ১৬ এপ্রিল দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান সাংবাদিকদের ‘সুরঞ্জিতকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে’ এমন ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, ‘দুদক কর্মকর্তারা তদন্তের প্রয়োজনে যে কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন, পারবেন। ’
সূত্র জানায়, তিনজনের জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে দুদক সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা চিন্তা করেছিল। কিন্তু একপর্যায়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে জিজ্ঞাসাবাদের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়।
অভিজ্ঞমহল মনে করছে, যেহেতু অভিযোগ উঠেছিল ৯ এপ্রিল ওমর ফারুকের গাড়িটি সুরঞ্জিতের বাসার দিকে যাচ্ছিলো, তাই সুষ্ঠু তদন্তের জন্য সুরঞ্জিতকেও জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা যেতো।
``কিন্তু সুরঞ্জিতের বক্তব্য না নিলেও অর্থ কেলেংকারির ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে তাকে নির্দোষ প্রমাণ করা হবে`` বলে মনে করেছিলো তদন্ত কমিটি। বাস্তবিক করেছেও তাই।
পার পেলেন সৌমেনও!
অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেলেন দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ছেলে সৌমেন সেনগুপ্তও। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা শেষে তাকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়টি রোববার কমিশনের বৈঠকে অনুমোদন করা হয়েছে। অব্যাহতির বিষয়টি সৌমেনকে জানাতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চলতি সপ্তাহেই চিঠি পাঠাবে বলে জানা গেছে।
অভিযোগ উঠেছে, পাঁচ কোটি টাকা দিয়ে বিটিআরসি থেকে ‘আইসিএক্স’ (ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ) লাইসেন্স পান সুরঞ্জিত পুত্র সৌমেন। এ অর্থের উৎস নিয়ে সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ এপ্রিল দুর্নীতি দমন কমিশনের বৈঠকে ঘটনা তদন্তে অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২৬ এপ্রিল দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) সৌমেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সৌমেন সেনগুপ্ত সেদিন সাংবাদিকদের জানান, এই প্রতিষ্ঠানে তার পুঁজি মাত্র ৬০ হাজার টাকা। জ্ঞাত আয় বহির্ভূত তার সম্পদ নেই বলেও জানান তিনি।
দুদকের উপ-পরিচালক আখতার হামিদ ভূঁইয়া ও সহকারী পরিচালক মনিরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত একটি তদন্ত দল সেনগুপ্ত টেলিকমিউনিকেশন বিষয়ে অনুসন্ধান চালায়।
দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়-আইসিএক্স’-এর লাইসেন্সের ফি পাঁচ কোটি টাকা। সেনগুপ্ত টেলিকম এ লাইসেন্স পায়। সেনগুপ্ত টেলিকমের একজন শেয়ার হোল্ডার সৌমেন সেনগুপ্ত। প্রতিষ্ঠানে তার পুঁজি ৬০ হাজার টাকা।
যমুনা ব্যাংকের পরিচালক কানুতোষ মজুমদার এবং দি নিউ জেনারেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সঞ্জিত কুমার দত্ত হচ্ছেন সেনগুপ্ত টেলিকমের মূল অর্থদাতা। এ দুজনই লাইসেন্সে মূল টাকার জোগান দেন।
দু’কোটি টাকার প্রাথমিক মূলধন দিয়েছেন সঞ্জিত কুমার। তার প্রতিষ্ঠান থেকে ধার নিয়ে বিটিআরসির লাইসেন্স কেনা হয়েছে।
এই প্রতিষ্ঠানে কারিগরি অংশীদার হচ্ছেন সুরঞ্জিতের ছেলে সৌমেন সেনগুপ্ত, অগ্নি সিস্টেমের কর্মরত মতিবুর রহমান ও প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাকসুদুর রহমান। সৌমেনকে নির্দোষ উল্লেখ করে তদন্ত প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেওয়া হয়।
এ তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে যোগাযোগ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘দুদকের তদন্ত কমিটির কাছে সুরঞ্জিতপুত্রের দেওয়া বক্তব্য ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পরীক্ষা করে প্রতীয়মান হয়েছে যে- বিটিআরসিতে জমা দেওয়া ৫ কোটি ৫০ লাখ টাকার উৎস বৈধ। এ টাকা সৌমেনের একার নয়। এ টাকায় তার কোম্পানির অন্য পরিচালকদের অংশের পরিমাণই বেশি। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের কাগজপত্রেও বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। ’
উল্লেখ্য, গত ৯ এপ্রিল রাতে পিলখানায় বিজিবি সদর দপ্তরের ফটকে সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুকের গাড়িতে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাওয়া যায়। পূর্বাঞ্চল রেলের মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধা এবং রেল পুলিশের কমান্ড্যান্ট এনামুল হকও ওই গাড়িতে ছিলেন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ওই অর্থ রেলের বিভিন্ন পদে নিয়োগের জন্য ঘুষ হিসেবে নেওয়া হয়েছিল। এই টাকার পরিমাণ ছিল ৭০ লাখ টাকা।
তবে কোনো কোনো সূত্রের দাবি, প্রকৃতপক্ষে টাকার পরিমাণ ছিল চার কোটি ৭০ লাখ। অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনার পর ইউসুফ আলী মৃধা ও এনামুল হককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। চাকরিচ্যুত হন ওমর ফারুক। অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ঘটনার পরদিন তদন্ত কমিটি করে রেল কর্তৃপক্ষ। রেলের তদন্ত প্রতিবেদনে অবশেষে সুরঞ্জিতকে ‘নির্দোষ’ উল্লেখ করা হয়।
এদিকে অভিযোগ ওঠে, পাঁচ কোটি টাকা দিয়ে বিটিআরসি থেকে ‘আইসিএক্স’ (ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ) লাইসেন্স পান সুরঞ্জিত পুত্র সৌমেন। এ অর্থের উৎস নিয়ে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ওঠে। এ নিয়ে দুদকের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটিও সৌমেনকে ‘নির্দোষ’ উল্লেখ করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
বাংলাদেশ সময়: ২১৩৬ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১২
সম্পাদনা: জাকারিয়া মন্ডল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর;
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
[email protected]