ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

পূর্ব রেল: সু্ইপার চৌকিদার পদে নিয়োগেও পকেট ভারি কর্তাদের

আদিত্য আরাফাত, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৭ ঘণ্টা, জুলাই ৯, ২০১২
পূর্ব রেল: সু্ইপার চৌকিদার পদে নিয়োগেও পকেট ভারি কর্তাদের

ঢাকা: ট্রেড অ্যাপ্রেন্টিস পদে ১২১৬ কোড নম্বরধারী লিখিত পরীক্ষায় পেয়েছেন মাত্র ২। তা পরিবর্তন করে ২৫ নম্বর দেখিয়ে এ কোডধারীকে উত্তীর্ণ দেখানো হয়েছে।

৩৫টির বেশি কোড নম্বরের খাতায় কাটাছেঁড়া করে নম্বর দেওয়া হয়েছে। টেব্যুলেশন শিটে ভয়াবহ জালিয়াতির মাধ্যমে এরকম অসংখ্য অকৃতকার্যকে করা হয়েছে কৃতকার্য।

পূর্ব রেলে নিয়োগের ক্ষেত্রে এমন ভয়াবহ জালিয়াতির তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য।

এর আগে পূর্ব রেলে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে উপ-পরিচালক আবু সাঈদকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দুদক। তার নেতৃত্বে সহকারী পরিচালক রাশেদুর রেজা ও মজিবুর রহমান পূর্বাঞ্চল রেলের নিয়োগে অনিয়মের বিষয়গুলো তদন্ত করছেন।

তদন্ত কাজে এরই মধ্যে তারা চট্টগ্রাম গেছেন এবং নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতির চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন বলে একাধিক সূত্র বাংলানিউজকে নিশ্চিত করেছে।

সূত্র জানায়, দুদক সবচেয়ে বড় দুর্নীতির প্রমাণ পায় নিম্নস্তরের পদগুলোতে নিয়োগে। রেলের বড় কর্তারা সুইপার, চৌকিদার পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও কমিশন ভিত্তিতে টাকা নিয়েছেন। সবচেয়ে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে ১১২ জন চৌকিদার, ৩৬৯ জন ট্রেড অ্যাপ্রেন্টিস, ২৪৮ জন সুইপার, ১৪৩ জন ট্রলি ম্যান, ১৫ জন সহকারী সাব ইন্সপেক্টর ও ১৮২ জন লোকো মাস্টার পদে নিয়োগে।

সূত্র জানায়, বিভিন্ন পদের জন্য লাখ লাখ টাকা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মহাব্যবস্থাপক (বরখাস্ত) মৃধা এবং তার সহযোগীরা হাতিয়ে নিয়েছেন।

দুদক জানতে পেরেছে, নিয়োগ কমিটি বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংবিধান অনুসরণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে জেলাওয়ারি পদ বণ্টন, রেলওয়ের কর্মচারীদের জন্য সংরক্ষিত, মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের সন্তান-সন্ততি, মহিলা, অনগ্রসর জেলা, আনসার-ভিডিপি, উপজাতীয়, এতিম প্রতিবন্ধীসহ বিভিন্ন ধরনের কোটার ক্ষেত্রে কোন প্রকার নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেনি নিয়োগ কমিটি।

বাংলানিউজকে সূত্র জানায়, সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর পদে লিখিত পরীক্ষায় ৯৫ জনের মধ্যে ৭ জন মাত্র মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ১১ জনকে। এর মধ্যে ৬ জনই মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ১০, ময়মনসিংহের ০১, কিশোরগঞ্জের ২৫, পটুয়াখালীর ১৮, রংপুরের ৩৩, মাদারীপুরের ২৬ নম্বরধারী প্রার্থী উত্তীর্ণ হয়ে নিয়োগ পেয়েছেন। অথচ নিয়োগের জন্য উপযুক্ত থাকার পরও অন্যায়ভাবে বাদ পড়েছেন কুমিল্লার ৫০ এবং চট্টগ্রামের ৬০ রোল নম্বরধারী।

রেলে নিয়োগবাণিজ্যে রেলের কর্মকর্তারা ছাড়াও চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুলের কয়েকজন শিক্ষকের জড়িত থাকার গুরুতর অভিযোগ পেয়েছে দুদক। খাতায় নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভয়াবহ দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন এসব শিক্ষক।

এসব গুরুতর অভিযোগ পাওয়ায় দুদকে তলব করা হয় নিয়োগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। অভিযুক্তদের দুদকের প্রধান কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাজির হতে নোটিশ পাঠানো হয়। নোটিশ অনুযায়ী গত সোম, মঙ্গল ও বুধবার পূর্ব রেলের নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে মৃধাসহ ৪৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক।

জানা গেছে, রেলের অনিয়মের অভিযোগে যারা দুদকে এসে জবানবন্দি দিয়েছেন তাদের অনেকেই দুদকের প্রশ্নের সঠিক উত্তর ও দুর্নীতিতে জড়িত না থাকার প্রমাণ দেখাতে পারেন নি।

পূর্বাঞ্চল রেলের নিয়োগ কমিটির আহবায়ক ছিলেন পূর্ব রেলওয়ের অতিরিক্ত যান্ত্রিক প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান চৌধুরী এবং সদস্য সচিব ছিলেন সিনিয়র ওয়েলফেয়ার অফিসার গোলাম কিবরিয়া। এ দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। গত সোমবার এ তিনজনসহ চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুলের ৯ জন শিক্ষককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

মঙ্গলবার রেলওয়ের নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফলের সারণীকরণপত্র (টেব্যুলেশন শিট) জালিয়াতির ঘটনা তদন্তে সহায়তার জন্য চট্টগ্রাম কলেজের সাত শিক্ষককে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। এছাড়া সেদিন পূর্ব রেলের ১৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

বুধবার রেলের নিয়োগ দুর্নীতির বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় রেল বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এসএম লেয়াকত আলী, মেইনটেনেন্স ইঞ্জিনিয়ার (চট্টগ্রাম সদর পূর্ব) এফএম মহিউদ্দিন ও আইন কর্মকর্তা (চট্টগ্রাম পূর্ব) আমান উল্লাহকে। গত সপ্তাহে তিন দিনে মোট ৪৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। বর্তমানে দুদকের তদন্ত টিম তদন্ত প্রতিবেদন তৈরির কাজ করছে বলে জানা গেছে।

রেলে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগের বিষয়ে দুদকের উপ-পরিচালক ও প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, ``যেসব অভিযোগ উঠে এসেছে তা আমরা তদন্ত করেছি, করছি। চট্টগ্রামও গিয়েছে দুদকের তদন্ত টিম। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় নথি ও কাগজপত্র সংগ্রহ করেছি। এছাড়া অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি চেষ্টা করছে স্বচ্ছ একটি তদন্ত প্রতিবেদন তৈরির। ``

উল্লেখ্য, গত ৯ এপ্রিল রাতে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের তৎকালীন এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারের গাড়িতে ৭০ লাখ টাকা পাওয়া যায়। এ সময় ফারুকের সঙ্গে ছিলেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের তৎকালীন জিএম ইউসুফ আলী মৃধা ও রেল পুলিশের তৎকালীন কমান্ড্যান্ট (ঢাকা) এনামুল হক । ওই ঘটনায় তাদের বরখাস্ত করা হয়। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব ছাড়েন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।

অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনার পর রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে।

বাংলাদেশ সময়: ১২১২ ঘণ্টা, জুলাই ৯, ২০১২
সম্পাদনা: জাকারিয়া মন্ডল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর;জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।