ঢাকা, বুধবার, ৯ বৈশাখ ১৪৩২, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

একই বৃত্তে ১৪ দল, নেতা-কর্মীরা এখনও সন্ত্রস্ত

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০০৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২৫
একই বৃত্তে ১৪ দল, নেতা-কর্মীরা এখনও সন্ত্রস্ত ২০২৩ সালের ১০ ডিসেম্বর নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনের ঘোষণা দেন ১৪ দলের নেতারা

ঢাকা: দীর্ঘ আট মাসেও বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো। ঝুঁকি নিয়েই চলতে হচ্ছে এ দলগুলোর নেতা-কর্মীদের।

অনেকে এখনো আত্মগোপনেই আছেন। তবে প্রতিকূলতার মধ্যেই অস্তিত্ব রক্ষায় ঘরোয়াভাবে কিছু কর্মসূচি পালনের চেষ্টা করছে জোটের দু-একটি দল।  

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। জনরোষের ভয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান দলটির প্রধান শেখ হাসিনা। তার আগে-পরে পালান আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিসহ অনেক নেতা-কর্মী।  

৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন হয়, যেখানে শেখ হাসিনাসহ তার সরকার, দল ও জোটের অনেক সহযোগীর বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়া দেশের অন্যান্য প্রান্তেও শেখ হাসিনার নামে হত্যা মামলা হয়েছে, যেখানে আসামি হয়েছেন আওয়ামী লীগের পাশাপাশি ১৪ দলের অনেক নেতা-কর্মীও।  

ফলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাদের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোও বিপর্যয়ে পড়ে৷ অভ্যুত্থানের পরপরই আওয়ামী লীগের লোকদের মত এ দলগুলোর নেতা-কর্মীরাও আত্মগোপনে চলে যান। নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে হাইকমান্ড। কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা পড়ে যান মারাত্মক রাজনৈতিক সংকটে।  

জানা যায়, শেখ হাসিনার সরকার যখন অভ্যুত্থান দমনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করছিল, তখন তাদের আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়ে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছিল ১৪ দল। এমনকি আগস্টের প্রথম থেকে তারা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামারও পরিকল্পনা নেয়। যদিও ৫ আগস্ট সরকারের পতন ঘটে যায়। মূলত হাসিনার সরকারের দমননীতির পক্ষে এমনভাবে অবস্থান নেওয়ার ফলেই তাদের ওপর ক্ষুব্ধ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ ফ্যাসিবাদবিরোধীরা। ফলে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতাদেরও পড়তে হয় জনরোষে। তারাও গা ঢাকা দেন।

মামলা-গ্রেপ্তার
নাম ‘১৪ দল’ হলেও এ জোটে মোট দল আছে ১২টি। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য দলগুলো হলো বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ, গণতন্ত্রী পার্টি, জাতীয় পার্টি (জেপি), সাম্যবাদী দল, তরিকত ফেডারেশন, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, বাসদ (রেজাউর রশিদ)। এর মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদই ছিল রাজনীতির মাঠে বেশি সক্রিয়, দৃশ্যমান ও হাসিনার সরকারের সুবিধাভোগী ৷ 

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের কয়েকদিন পরই শেখ হাসিনার সরকারের দুই সাবেক মন্ত্রী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু গ্রেপ্তার হন। তারপর থেকে তারা কারাগারে আছেন ৷ তাদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা রয়েছে ৷ এর মধ্যে হত্যা মামলাও আছে৷ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও মামলা রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ৷ ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি ফজলে হোসেন বাদশা দেশের বাইরে চলে যান। তার নামেও একাধিক মামলা হয়েছে এবং তিনি ভারতে আছেন বলে জানা গেছে।  

এছাড়া মামলা হয়েছে জাতীয় পার্টির (জেপি) সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর মতো নেতাদের বিরুদ্ধেও।  

১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর কয়েকজন নেতা-কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখনো তারা সংকটের মধ্যেই রয়েছেন। গত আট মাসের বেশি সময় পার হলেও ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো এ সংকট এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি৷ এই জোটের দলগুলো এখনো প্রকাশ্য কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি নিতে পারছে না ৷ দলগুলোর অধিকাংশ নেতা-কর্মীই এখনো গা-ঢাকা দিয়ে বা আত্মগোপনে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। কেউ কেউ প্রকাশ্যে এলেও সতর্কভাবে চলাফেরা করতে হচ্ছে। কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পর্যন্ত একই অবস্থা। এ দলগুলোর রাজনৈতিক ইতিহাসে নেতা-কর্মীরা এর আগে কখনো এত বড় বিপর্যয়ে পড়েননি বা মুখোমুখিও হননি, যা এখনো কাটেনি।  

বিবৃতি-দিবসভিত্তিক কর্মসূচিতে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা
প্রথম পাঁচ-ছয় মাস অনেক ঝড়ঝাপ্টায় গেলেও এখন কৌশলে এবং ঝুঁকি নিয়ে হলেও রাজনৈতিক অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনতে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা চলছে জোটের দলগুলোর মধ্যে। এর জন্য কিছু কিছু কর্মসূচি নেওয়ার চেষ্টা করছে এ জোটের কোন কোন দল, বিশেষ করে ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে গণমাধ্যমে বিবৃতি, কার্যালয়ে বসা, দিবসভিত্তিক দুই-একটি কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ, কার্যালয়ের ভেতরে ঘরোয়াভাবে সংক্ষিপ্ত কর্মসূচি পালন।  

এ জোটের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি গত ৮ এপ্রিল ফিলিস্তিন ইস্যুতে গণমাধ্যমে প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠায় ৷ এর শিরোনাম ছিল ‘ফিলিস্তিনি গণহত্যার বিচার চাই’৷ 

তার আগে গত ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ওয়ার্কার্স পার্টির উদ্যোগে সকাল সাড়ে ৯টায় বীর শহীদদের স্মরণে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করে লাল সালাম জানানো হয়। পার্টির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহমুদুল হাসান মানিকের নেতৃত্বে এ কর্মসূচিতে অংশ নেন পার্টির কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর নেতারা ৷ 

রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, গবেষক, লেখক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক, ছায়ানটের সভাপতি ড.সনজীদা খাতুনের মৃত্যুতে ২৬ মার্চ দলটি গণমাধ্যমে শোক এক বিবৃতি পাঠায় ৷

ওয়ার্কার্স পার্টির পলিট ব্যুরোর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, ঢাকা ও ঢাকার বাইরের নেতা-কর্মীদের এখনো সতর্কভাবে চলাফেরা করতে হচ্ছে। কেউ কেউ এখনও আত্মগোপনে। আমাদের পার্টি অফিসে একাধিকবার হামলা হয়েছে, কয়েকদিন আগেও হামলা হলো। চুয়াডাঙ্গা পার্টি অফিস দখল করে নিয়েছে। কয়েকটি জেলায় পার্টি অফিসে হামলা হয়েছে। নেতা-কর্মীরা এখনো নিরাপদ নন। এ অবস্থার মধ্যে আমরা আছি। তবে এ অবস্থায়ই ঘরোয়াভাবে কেন্দ্রীয় অফিসের মধ্যে কিছু ছোটখাট কর্মসূচি পালন করছি, কমিটি মিটিং করছি। নেতা-কর্মীরাও কেউ কেউ মাঝেমধ্যে পার্টি অফিসে আসছে। পার্টির পলিট ব্যুরোর সভা করা হয়েছে।  

জাসদের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঝুঁকি নিয়ে হলেও নেতা-কর্মীরা কেন্দ্রীয় কার্যালয় যাচ্ছেন এবং বসছেন। কয়েকটি জেলার নেতা-কর্মীরাও কাজ করার চেষ্টা করছেন।  

মুজিবনগর দিবস উপলক্ষে গত ১৭ এপ্রিল জাসদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে জাসদের কেন্দ্রীয় ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন এবং বক্তব্য রাখেন বলে দলটির প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।  

তারও আগে গত ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে জাসদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কর্ণের তাহের মিলনায়তনে বৈশাখী মঙ্গল মিলনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। জাসদের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা এই অনুষ্ঠানে অংশ নেন। তারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গল্প, আড্ডা, প্রীতিভোজ ও আলোচনায় অংশ নেন বলে জাসদের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।  

জাসদের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কেন্দ্রীয় নেতা বাংলানিউজকে বলেন, রুটিন কিছু কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের মধ্যে। কয়েকটি জেলায় এভাবে কাজ হচ্ছে। জাসদের ৮-৯টি জেলা কার্যালয় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, হামলা করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় অফিসে একাধিকবার হামলা হয়েছে। কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, বগুড়া অফিস দখল করে নিয়েছে। কোনো কোনো জেলায় নেতাদের ব্যক্তিগত অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে। সংকট এখনো কাটেনি, তারপরও ঝুঁকি নিয়েই কিছু কিছু কাজ হচ্ছে। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে পহেলা বৈশাখ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কর্মসূচিতে অনেক নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিলেন, ভালো অনুষ্ঠান হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ০০০২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২৫
এসকে/এইচএ/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।