২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ চলাকালে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। এই বিদ্রোহের ঘটনায় সে সময় গঠিত তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়।
বিডিআর বিদ্রোহের প্রায় দেড় দশক পর ঘটনার পুনঃতদন্ত শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত ঘটনা উন্মোচন ও হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের শনাক্ত করতে গঠন করা হয়েছে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতার জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
তৎকালীন বিডিআরের (বর্তমানে বিজিবি) উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) তৌহিদুল আলম কি বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন—এমন প্রশ্ন তুলেছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ হাসান নাসির। বিডিআর বিদ্রোহের পর হত্যার তদন্তে সচিব আনিসুজ্জামানের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় তদন্ত কমিশনের সদস্য ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক এই কর্মকর্তা বাংলানিউজের কাছে একান্ত সাক্ষাৎকারে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। আজ থাকছে সেই সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় অংশ।
ডিএডি তৌহিদ কি হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন?
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাসান নাসির জানান তদন্তে তারা দেখতে পান, হত্যাকাণ্ড চলার সময় সৈনিক লাইনের পঞ্চমতলা ভবনে ডিএডি তৌহিদ ও কর্নেল কামরুজ্জামান লুকানো অবস্থায় ছিলেন। পরে ডিএডি তৌহিদকে ডেকে আনা হয় প্রধানমন্ত্রীর অফিসে যাওয়ার জন্য।
এখানে হাসান নাসিরের প্রশ্ন, তিনি (ডিএডি তৌহিদ) যদি সত্যিই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকতেন তাহলে তিনি কেন লুকিয়ে থাকবেন? বিষয়টি এখনও তদন্তের দাবিদার বলে মনে করছেন সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা।
তদন্তের সার্বিক পর্যালোচনায় তিনি জানান, বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় হত্যার বিষয়টি গুটিকয়েক আওয়ামী লীগ নেতা, প্রধানমন্ত্রী আর বিদেশি সংস্থার (ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’) মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তাই সেদিন দরবার হলে দাবি-দাওয়া আদায়ের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যেই পিকআপ ভ্যানে করে তৃতীয় পক্ষ ঢুকে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়।
আওয়ামী লীগ নেতাদের ভূমিকা
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাসান নাসির স্পষ্ট করে বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আওয়ামী নেতা শেখ সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, মির্জা আজমসহ বেশ কিছু নেতা জড়িত ছিলেন। তবে অসহযোগিতামূলক আচরণের জন্য সেই সময় বিষয়টি প্রমাণসহ নিশ্চিত করা যায়নি।
কর্নেল শামসের ভূমিকা
দরবার হলে ঘটে যাওয়া ঘটনার মধ্যে কর্নেল শামসের আচরণ বিস্ময়কর ছিল উল্লেখ করে হাসান নাসির বলেন, দরবার হলের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন কর্নেল শামস। আমরা তদন্তে দেখতে পাই, তিনি অফিসারদের হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তার অস্ত্র (৪৪ রাইফেলসের অস্ত্র) নিয়ে একজন সৈনিক ডিজির দিকে তাক করে। তবে তিনি (কর্নেল শামস) অভিযোগ অস্বীকার করে বলছেন, এটি ১৩ রাইফেলস ব্যাটালিয়ানের অস্ত্র। কিন্তু এটি ডিজির (মহাপরিচালক) মুখের কথায় রেকর্ড রয়েছে সেই সময়ে গঠিত জাতীয় তদন্ত কমিশনের কাছে, দাবি করেন হাসান নাসির।
কর্নেল শামসের ভূমিকা আরও স্পষ্ট করতে সেই সময়ের তদন্ত কমিশনে তদন্তে উঠে আসা তথ্যের ব্যাখ্যা দিয়ে হাসান নাসির বলেন, তদন্তে তার (কর্নেল শামস) সেদিনের বর্ণনায় মনে হয়নি যে, তিনি দরবার হল থেকে কোনো জেসিওর (জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার) বাসায় পলাতক ছিলেন। বরং তার বর্ণনা এমন ছিল, যেটি ঘটনাস্থলে না থাকলে দেওয়া সম্ভব না।
এরপর হাসান নাসির প্রশ্ন তোলেন, এটি (অস্ত্র) যদি ১৩ রাইফেলসের হয়েও থাকে, তবে তিনি কেন দরবার হলের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলেন?
বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় শেখ হাসিনার সংযোগ
সশস্ত্র বিদ্রোহে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও প্রধানমন্ত্রীর করা মিটিংকে বিরল ও সন্দেহজনক মন্তব্য করে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, সেদিন ১৪ জন হত্যাকারী প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে কথা বলেন। তবে তাদের রেকর্ড তদন্ত কমিশন কোথাও পায়নি! প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে কেউ যাবেন আর সেটির রেকর্ড কোথাও থাকবে না, এটাও কি সম্ভব!
তিনি বলেন, আমরা শুধু মিডিয়াতে ৫ জনের চেহারা দেখলাম, যারা বেরিয়ে কথা বললেন। বাকিদের কোনো হদিস কোথাও মেলেনি। এ থেকে স্পষ্ট হওয়া যায় যে, ঘটনার সঙ্গে তৎকালীন সরকারপ্রধান জড়িত।
তৎকালীন তদন্ত কমিশন ধারণা করেছে, ২৫ ফেব্রুয়ারি ৩টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত ৩০-৪০ জনের মতো অফিসার খুন হয়েছিলেন। অর্থাৎ সরকার চাইলেই বাকি হত্যা দমন করতে পারতো। কিন্তু তিনি (শেখ হাসিনা) তা না করে ১৪ জন হত্যাকারীকে ফিরে যেতে দিলেন সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। পরবর্তী সময়ে যেটি দেখা গেল, হত্যাকাণ্ডের সামনের সারিতে নেতৃত্ব দেওয়া ওই ১৪ জন পিলখানায় ফিরে গিয়ে বাকি অফিসারদের নির্মমভাবে হত্যা করল, বলেন হাসান নাসির।
৫৪ জন অফিসারকে বিভিন্ন জায়গা থেকে বদলি করে রাতারাতি বিডিআরে নিয়ে আসা হয় এবং ২৫ তারিখে দরবার হলে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়। এমনকি তড়িঘড়ি করে বাইরের টেইলার্স দিয়ে তাদের ইউনিফর্ম তৈরি করা হয়। এদের মধ্যে চৌকস অফিসার কর্নেল গুলজার অন্যতম। এই তড়িঘড়ি বদলির বিষয়েই সরকারের প্রতি সন্দেহ আরও ঘনীভূত করে। এই বদলির প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০০৮ সাল থেকে অর্থাৎ নির্বাচনের আগে থেকেই। এ বিষয়ের সুষ্ঠু তদন্ত করলেই খুনের রহস্য উদঘাটন সম্ভব বলে জানান সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা।
বাইরের লোক জড়িত
২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে পিলখানায় ৪টি আনরেজিস্টার্ড অ্যাম্বুলেন্স ৪ নম্বর গেট দিয়ে প্রবেশ করে। গাড়িগুলোতে করে কারা প্রবেশ করে আবার বের হলো সেই রেকর্ড আমরা কোথাও পেলাম না, বলেন হাসান নাসির। এই বিষয়গুলোই নিশ্চিত করে এটা কোনো বিদ্রোহ নয়, বরং পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, যেটির সঙ্গে জড়িত ছিল বাইরের শক্তি।
তিনি মনে করছেন, এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আরও ব্যাপকভাবে তদন্ত করে সত্য উন্মোচন করা বর্তমান কমিশনের জন্য বড় রকমের চ্যালেঞ্জ, যেটার মাধ্যমে প্রকৃত হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা সম্ভব।
লাশ পাওয়া যায়নি এডি খন্দকার আব্দুল আউয়ালের
‘২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় আওয়ামী নেতাকর্মীরা কয়েক দফায় ৪০-৫০ জনের মিছিল নিয়ে পিলখানায় প্রবেশ করেন। কিন্তু বের হওয়ার সময় সেই মিছিলে লোক সংখ্যা দ্বিগুণ দেখা যায়। এ বিষয় থেকে আমরা তদন্তে স্পষ্ট হই যে, মিছিলে বিডিআর সদস্যদের বের করে আনা হয় (সম্ভবত তারাই হত্যাকারী)। সেদিন এডি (অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর খন্দকার আব্দুল আউয়াল, ঢাকা সেক্টরের ডিকিউ) অফিসারদের প্রাণ রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হন। ’
তবে এডি খন্দকার আব্দুল আউয়ালের বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত থেকে গেছে। তার মরদেহ পাওয়া যায়নি। তার বিষয়টি স্বাধীন তদন্ত কমিশনকে সামনে নিয়ে আসার পরামর্শ দেন হাসান নাসির।
বিএনপিকে জড়ানোর মিথ্যা নাটক
প্রয়াত বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি পুরোটাই সাজানো নাটক বলে জানান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাসান নাসির। তিনি বলেন, আমার কাছে একটি বেনামি চিঠি আসে, যেটি র্যাব অফিসে টাইপ করা বলে চিঠি বহনকারী র্যাব কর্মকর্তা আমাকে জানান। তবে সেই বেনামি চিঠি তদন্ত কমিশন আমলে নেয়নি।
পরবর্তী সময়ে ওই চিঠির ভিত্তিতেই গ্রেপ্তার করা হয় নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুকে। এটা রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে জড়িত করার মিথ্যা নাটক বলে মনে করেন বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিশনের এই সদস্য।
পিএ/এমজেএফ