প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করছেন—এমন খবরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নানান জল্পনা-কল্পনার সৃষ্টি হয়। নড়েচড়ে বসেন পতিত স্বৈরশাসকের সমর্থকরা।
একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে সব ধরনের সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জুলাই বিপ্লবের অংশীদার রাজনৈতিক দলগুলো। তবে নির্বাচনী রোডম্যাপ, সংস্কার, ফ্যাসিস্টদের বিচার এবং জুলাই ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের দাবিও জানানো হয়েছে দলগুলোর পক্ষ থেকে।
ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের চাপ, সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্য, মব সন্ত্রাস, রাখাইনের জন্য মানবিক করিডোর বিতর্ক এবং চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনা বিদেশিদের হাতে দেওয়ার পরিকল্পনাগুলো মোটা দাগে অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে ফেলে। অধ্যাপক ইউনূস অভিমান থেকে হোক আর নানামুখী চাপ থেকে হোক, পদত্যাগের কথা বলে নতুন আলোচনার জন্ম দেন।
তবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের পর কয়েকজন উপদেষ্টা বলেছেন, অধ্যাপক ইউনূস পদত্যাগ করছেন না। এটাও একটা সন্দেহজনক মন্তব্য। কারণ অধ্যাপক ইউনূস পদত্যাগ করবেন, এমন ঘোষণা সরাসরি দেননি।
বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে গিয়ে ঠেকেছে। গত সপ্তাহজুড়ে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে আসছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।
অন্যদিকে বিএনপির এই দাবির প্রতিক্রিয়ায় সংস্কার সুপারিশ বাস্তবায়ন না হলে অন্তর্বর্তী সরকারের তিনজন উপদেষ্টাকে ‘বিএনপির মুখপাত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করে পদত্যাগে বাধ্য করার হুঁশিয়ারি দেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা।
অন্তর্বর্তী সরকারের নয় মাসে দুটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম থেকে ছয় উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি উঠলেও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের পদত্যাগের দাবি ওঠা তো দূরের কথা, তার বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনাও শোনা যায়নি। এ সত্ত্বেও গত বৃহস্পতিবার (২২ মে) আকস্মিকভাবে গুঞ্জন ওঠে প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করতে চাইছেন।
রাজধানীতে প্রতিদিন সড়ক আটকে আন্দোলন, সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না হওয়া, রাষ্ট্রীয় কাজে নানা পক্ষের অসহযোগিতার বিষয়টি আলোচনায় আসে। উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আলোচনার একপর্যায়ে কাজ করতে না পারার বিষয়টি তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, সংস্কারের বিষয়ে এখনো তেমন কিছু হলো না। তাহলে তিনি কেন থাকবেন?
বিগত নয় মাস ধরে নানা ইস্যুতে প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীতে আন্দোলন হচ্ছে। রাজপথ বন্ধ করে এসব আন্দোলনের কারণে নগরজুড়ে যানজট, জনভোগান্তি চরম আকার ধারণ করে। এসব ভোগান্তির প্রেক্ষিতে সরকারকে আন্দোলনকারীদের আশ্বস্ত করতে হয়। কিছু কিছু দাবি চাপের মুখে পূরণও করতে হয়েছে। গত সপ্তাহে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র পদে ইশরাক হোসেনের শপথ না পড়ানোর কারণে বড় আন্দোলন হয়েছে নগর ভবন ও কাকরাইল এলাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের নেতা সাম্য হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলন হয়েছে শাহবাগে। এনসিপির নির্বাচন কমিশন ঘেরাও কর্মসূচি পালিত হয়েছে। এসব কারণে নগরবাসীর অস্বস্তি যেমন বাড়ছে তেমনি সরকারের ওপর মানুষের আস্থার জায়গায় চিড় ধরছে।
বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের রোডম্যাপ চেয়েছে বিএনপি। বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বিএনপি শুরু থেকেই একটি সুস্পষ্ট নির্বাচনী রোডম্যাপের দাবি জানিয়ে আসছে। এই দাবি আমরা প্রকাশ্যেই করে এসেছি। পাশাপাশি, একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে বিতর্কিত সদস্যদের বাদ দিয়ে নতুন করে উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠনের দাবি জানিয়েছে বিএনপি। নির্বাচন বিষয়ে সংস্কার কার্যক্রম অবিলম্বে শেষ করে ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দ্রুত একটি রোডম্যাপ প্রণয়নের দাবি জানায় দলটি।
শনিবার (২৪ মে) প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, বিএনপি কখনো প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ চায়নি। বরং শুরু থেকেই এই সরকারকে সহযোগিতা করে আসছে দলটি। নির্বাচন বিষয়ে সংস্কার কার্যক্রম অবিলম্বে শেষ করে ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দ্রুত একটি রোডম্যাপ প্রণয়নের দাবি আমরা জানিয়েছি। বাংলাদেশের জনগণ বিশ্বাস করে, একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন হবে।
নির্বাচন বিলম্বিত হলে দেশে স্বৈরাচার ফিরে আসার সম্ভাবনা বাড়বে বলেও মন্তব্য করেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, নির্বাচন যত বেশি বিলম্ব করা হবে, আমরা মনে করি জাতির কাছে আবারও স্বৈরাচার ফিরে আসার সম্ভাবনা তত বেশি বাড়বে। আর এর দায়-দায়িত্ব বর্তমান সরকার ও সংশ্লিষ্টদের ওপরেই বর্তাবে।
বৈঠকে তিনটি প্রধান বিষয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে তিনি জানান, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন, বিচারকাজ এবং সংস্কার নিয়ে তারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছেন। সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া এবং বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।
বৈঠক শেষে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, গত কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশে কিছুটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। তার ধারাবাহিকতায় গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের একটা বৈঠক হয়, সেই বৈঠক থেকে প্রধান উপদেষ্টা একটি মেসেজ জাতিকে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি সেটা দেননি। কিন্তু এটা খুব দ্রুত সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। যার কারণে এক ধরনের আশঙ্কা বিরাজ করে। আমরা সেটাকে আমলে নিয়েছি। একই সময়ে একজন রাজনৈতিক নেতা তার জনপ্রতিনিধির দাবি নিয়ে অবস্থান নিয়েছেন। আরেক জায়গায় আরেকজনরা গুরুত্বপূর্ণ দাবি নিয়ে অবস্থান নিয়েছে। সব মিলিয়ে বিষয়টা কিছুটা কষ্টের ও বিরক্তির। যার কারণে তিনি তার দায়িত্বের ব্যাপারে বিবেচনা করবেন এমনটি প্রকাশ করেছিলেন।
তিনি বলেন, আমাদের সবার দাবি ছিল অর্থবহ একটি সংস্কার হবে। এই সংস্কার ও বিচারের মধ্য দিয়েই একটা অর্থবহ নির্বাচন হবে। এই নির্বাচনের সুষ্ঠু মাঠ থাকবে, যারা অংশগ্রহণ করবে তারা ষড়যন্ত্রের শিকার হবে না, পেশীশক্তির প্রবণতা থাকবে না। সাড়ে ১৫ বছর জনগণ ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে, এবার তারা ভোট দিতে পারবে, সেটা নিশ্চিত হবে—এটাই ছিল আমাদের দাবি। আমরা বলেছি দুইটা বিষয় স্পষ্ট করা দরকার, আমরা বলেছি গ্রহণযোগ্য সংস্কার হতে হবে এবং সুষ্ঠু নির্বাচন হতে হবে। আমরা মনে করি সংস্কার ও নির্বাচনী রোডম্যাপের ঘোষণা হলে অনেকটাই সংশয় কেটে যাবে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, জুলাই ঘোষণাপত্র যেন জারি করা হয়, সেই বিষয়ে আমরা আহ্বান জানিয়েছি। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আহত এবং নিহতদের ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসন করার কথা ছিল, সেটি এখনো হয়নি। শেখ হাসিনার সময়ে অনুষ্ঠিত সকল জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নির্বাচন বাতিল ঘোষণার দাবি জানিয়েছি।
টিএ/এমজেএফ