ঢাকা, শনিবার, ১৫ আষাঢ় ১৪৩২, ২৮ জুন ২০২৫, ০২ মহররম ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু, আগস্ট-সেপ্টেম্বর ঘিরে বেশি ভয়

রেজাউল করিম রাজা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:৩৮, জুন ২৭, ২০২৫
চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু, আগস্ট-সেপ্টেম্বর ঘিরে বেশি ভয় প্রতীকী ছবি

সারা দেশেই বাড়ছে এডিস মশার প্রকোপ। আগের তুলনায় চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের হারও বেড়েছে।

আসছে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনও আমরা ডেঙ্গুর আসল প্রকোপ দেখিনি। কেবল শুরুটা দেখছি। দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হবে এবং মৃত্যুর সংখ্যাও সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে।

এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের সূচক ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ নামে পরিচিত। কোনো এলাকায় লার্ভার ঘনত্ব যদি ২০ শতাংশের বেশি হয়, তাহলে সেই স্থানকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। এ বছর রাজধানীসহ সারাদেশের বিভিন্ন এলাকা উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।

ঢাকার ডেঙ্গু পরিস্থিতি

সম্প্রতি ডেঙ্গু নিয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) এক জরিপে দেখা যায়, রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের ৭২টি ওয়ার্ডে মশার ঘনত্ব নির্দিষ্ট সূচকের চেয়ে বেশি যা ডেঙ্গু রোগের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাত এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ছয়টি ওয়ার্ডকে ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

জরিপে মশার প্রজনন উৎস হিসেবে সিমেন্টের পানির ট্যাঙ্ককে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ (ব্রুটো ইনডেক্স ২২ শতাংশ) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরপরই রয়েছে মেঝেতে জমে থাকা পানি (২০ শতাংশ);  প্লাস্টিকের ড্রাম (১৩ শতাংশ), ওয়াটার মিটার চেম্বার (১১ শতাংশ), প্লাস্টিকের বালতি (১০ শতাংশ), ফুলের টব ও ট্রে/প্লাস্টিকের পাইপের গর্ত (৭ শতাংশ), পরিত্যক্ত টায়ার (৬ শতাংশ), বাড়ির ভেতরের পানির চ্যানেল (৫ শতাংশ) এবং সিমেন্টের প্লট (৪ শতাংশ)। প্রাক-বর্ষা জরিপ অনুযায়ী, এডিস মশার লার্ভার সবচেয়ে বেশি ঘনত্ব (৫৮.৮৮ শতাংশ) পাওয়া গেছে বহুতল ভবনগুলোতে।

সারাদেশে ডেঙ্গুর চিত্র

এডিস মশা নিয়ে আইইডিসিআরের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বাইরে ঝিনাইদহ, মাগুরা, পটুয়াখালী ও পিরোজপুরে এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি বেশি।

ঝিনাইদহের শহর এলাকায় ২৭০টি বাড়ি পরিদর্শন করে ৫৪টি এডিসের লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ঝিনাইদহে ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে ৬০ শতাংশ, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া মাগুরায় ব্রুটো ইনডেক্স ৫৫.৫৬ শতাংশ  এবং পিরোজপুরে ২০ শতাংশ।  

পটুয়াখালী পৌরসভায়ও পরিস্থিতি উদ্বেগজনক, সেখানে ব্রুটো ইনডেক্স ১৯.২৬ শতাংশে পৌঁছেছে, অর্থাৎ উচ্চ ঝুঁকির সীমানায়। প্লাস্টিক ড্রাম, প্লাস্টিক বাস্কেট ও দইয়ের খালি পাত্রে লার্ভার উপস্থিতি বেশি পাওয়া গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছরে দেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই ব্রুটো ইনডেক্সে এডিস মশার ঘনত্ব ২০ শতাংশের ওপরে। এতে সারাদেশেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়বে।  

অন্য বছরের চেয়ে এবার ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বেশি

গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ১৫৯ জন এবং ডেঙ্গুতে মারা গেছেন দুজন। এ বছর ২৭ জুন পর্যন্ত সারাদেশে মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন নয় হাজার ২২২ জন। চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা অন্তত ৪০ জন।  

বিগত বছরগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, আগের বছরগুলোর চেয়ে এবার ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বেশি।  

২০২৩ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ এক হাজার ৭০৫ জন মারা যান। সে বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন মোট তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন।

২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সারাদেশে মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন সাত হাজার ৯৭৮ জন এবং ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুবরণ করেছেন ৪৭ জন। চলতি বছর ২৭ জুন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ২০২৩ সালের প্রথমার্ধের চেয়েও বেশি।

২০২৪ সালে মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন এক লাখ এক হাজার ২১৪ জন এবং ডেঙ্গুতে মোট মারা গেছেন ৫৭৫ জন। ওই বছর ৩০ জুন পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন তিন হাজার ৬৫১ জন এবং সে সময় মোট মারা গেছেন ৪৪ জন।  

এর আগে ২০২২ সালে মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৬২ হাজার ৩৮২ জন এবং ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুবরণ করেছেন মোট ২৮১ জন। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ছয় মাসে মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ৮৯ জন এবং ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে একজনের।  

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা 
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগে এডিস মশার বিস্তার কেবল রাজধানীতে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসার সক্ষমতা সীমিত। তাই এখনই পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কার্যকর মশা নিধন ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। তা না হলে ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তার এবং মৃত্যু আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বাংলানিউজকে বলেন, আরও তিন মাস আগেই বলেছিলাম-এই বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হবে। দেশের ৬৪ জেলাতেই ব্রুটো ইনডেক্স ২০-এর ওপরে। নিশ্চিত করে বলা যায়, আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ভয়াবহ রূপ নেবে।  

আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, এখনও আমরা ডেঙ্গুর আসল প্রকোপ দেখিনি-শুধু শুরুটা দেখছি। এখন থেকেই মশার উৎস ধ্বংস, লার্ভা ম্যানেজমেন্ট এবং জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো না গেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।  

আরকেআর/এমইউএম/এসআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।