গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে কয়েক দফা হামলা চালিয়েছে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ, কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এনসিপি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারলেও তাদের সমাবেশের আগে ও পরে হামলার ঘটনা ঘটে।
বুধবার (১৬ জুলাই) এনসিপির কর্মসূচিতে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের হামলা বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সম্প্রতি উত্তরবঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির জুলাই পদযাত্রায় যে জাগরণ দেখা গেছে, তাতে রাজনৈতিক ময়দানে তাদের শক্তি-সামর্থ্যের প্রতি আশার সঞ্চার হয়েছিল। জনগণের ভেতরে দলটি ক্রমশ নিজেদের ভিত্তি তৈরি করছে, এমন একটি আস্থার জায়গা তৈরি হচ্ছিল জনমনে। তবে গোপালগঞ্জের ঘটনায় সেই প্রত্যাশায় ভাটা পড়বে। গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের হামলায় কোনো ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি দলটি। তাদের শক্তি-সামর্থ্যের নাজুক দশা দেশবাসীর কাছে প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। দলটির নেতাদের সেনাবাহিনীর সহায়তা নিয়ে গোপালগঞ্জ ছাড়তে হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির এ ধরনের বেকায়দায় পড়ার পেছনে কয়েকটি কারণ আছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ২০২৪ সালে জুলাই-আগস্টে বর্তমান জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থান হয়। সে সময় তাদের যে জনপ্রিয়তা ছিল, তাতে ভাটা পড়ার প্রমাণ মেলে গোপালগঞ্জের সমাবেশে। জনপ্রিয়তা কমার কারণে তাদের কর্মসূচিতে বিপুল সংখ্যক মানুষ জড়ো করতে পারেনি দলটি।
ব্যাপক জনসমাগম ঘটাতে না পারায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ, কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা হামলার সাহস দেখায়।
এ ছাড়া দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে এনসিপির দূরত্বও আরেকটি বড় কারণ বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিএনপির কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ায় দলটির শক্তি অনেকটা কমে এসেছে। বিএনপি ছাড়া দুর্বল হয়ে পড়ায় এনসিপির ওপর হামলা করতে পতিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সাহস পেয়েছে বলেও মনে করেন বিশ্লেষকরা।
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির সমাবেশস্থলে দুই দফা হামলা, তাদের অবরুদ্ধ করার ঘটনা সারা দেশের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে উৎসাহিত করতে পারে। ফলে এ ধরনের ঘটনা সারা দেশে আরও ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর এ ধরনের ঘটনা সারা দেশে ঘটতে থাকলে দেশের রাজনীতিতে মারাত্মক অস্থিরতা তৈরি করবে। তাতে পতিত আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের ক্ষেত্র তৈরি করতে হতে পারে।
আর এক্ষেত্রে বিএনপির সঙ্গে এনসিপির দূরত্ব নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগকে এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটাতে উৎসাহিত করতে পারে বলে মনে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
অন্যদিকে বিএনপি থেকে দূরে সরে গেলে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে, জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা এটি উপলব্ধি করতে পারলে ভিন্ন দিকে মোড় নেবে দেশের রাজনীতি। ক্রমাগত বাড়তে থাকা দূরত্ব কমে আসতে পারে দল দুটির মধ্যে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার শেখ হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির অগ্রভাগে থাকা একদল তরুণ-তরুণীর নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্যসচিব আখতার হোসেন। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে রয়েছেন সামান্তা শারমিন, ডা. তাসনিম জারা, নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী, হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলমসহ জুলাই অভ্যুত্থানের সংগঠক একঝাঁক তরুণ নেতা।
বেশ কয়েকটি কারণে মাত্র এক বছরেরও কম সময়ে গণঅভ্যুত্থানের নেতাদের জনপ্রিয়তা কমে আসে। এর মধ্যে রয়েছে নিজেদের মধ্যে ঐক্যের অভাব, অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে বিভক্তি, বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অনৈক্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাদের কারও কারও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া। এ ছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের জনপ্রিয়তাও জাতীয় নাগরিক পার্টির জনপ্রিয়তার ভাটা পড়ার জন্য দায়ী বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
স্বাভাবিক সমাবেশ করতে না পারার ব্যর্থতার দায় সরকারের
গোপালগঞ্জের ঘটনা রাজনৈতিক বাঁকবদল ঘটাতে পারে কি না জানতে চাইলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক রুহিন হোসেন প্রিন্স বাংলানিউজকে বলেন, যে ঘটনা ঘটেছে, একটা রাজনৈতিক দল স্বাভাবিকভাবে সমাবেশ করতে পারল না, এর ব্যর্থতার দায় সরকারকে নিতে হবে। সরকার যদি আগে থেকে ব্যবস্থা নিতো তাহলে হয়তো এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারত না। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে একটা পরিবর্তনের পর যে নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরু হয়েছে, এ ধরনের ঘটনার মধ্য দিয়ে তা ব্যাহত করতে অপশক্তি সুযোগ নিতে পারে। এখন সবাইকে, সব দলকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে, এটা সময়ের দাবি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান বাংলানিউজকে বলেন, এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড সব সময় নিন্দনীয়। একটা রাজনৈতিক দল শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করবে, এতে বাধা দেওয়ার কিছু নেই। কর্মসূচি পালন করার আগেই উত্তেজনা তৈরি হলো, এটা ভালো না। এর ফলে কী প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে বা কী প্রভাব পড়বে এ ব্যাপারে আগাম কোনো কিছুই বলা যাচ্ছে না। এটা পরে বোঝা যাবে।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হক বাংলানিউজকে বলেন, আজকে গোপালগঞ্জের যে ঘটনা ঘটেছে সেটি অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসররা একটি রাজনৈতিক দলের প্রোগ্রামে এভাবে হামলা চালাবে, এটি নিঃসন্দেহে ভাবনার বিষয়।
গোপালগঞ্জের ঘটনা রাজনীতিতে কোনো বাঁক নিতে পারে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যেভাবে জুলাই বিপ্লবের সময় ঐক্যবদ্ধ ছিলেন এখনো সেভাবেই আছে। সুতরাং এই ঘটনায় সারাদেশের রাজনীতিতে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে এ বিষয়ে বলেন, আমরা এখনই এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না। বিষয়টি নিয়ে আমাদের দলীয় পর্যায়ে মিটিং চলছে। এ বিষয়ে পরবর্তীতে জানাতে পারবো।
এইচএ