ঢাকা, মঙ্গলবার, ৭ শ্রাবণ ১৪৩২, ২২ জুলাই ২০২৫, ২৬ মহররম ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

ছেলের শহীদের সনদ তো পাইলাম না: রায়হানের বাবা

নাসির উদ্দিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২:৫৪, জুলাই ১৯, ২০২৫
ছেলের শহীদের সনদ তো পাইলাম না: রায়হানের বাবা শহীদ রায়হান ও তার বাবা: ফাইল ফটো

সিলেট: ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ১৯ জনকে হারিয়েছে সিলেট। নিখোঁজ রয়েছেন একজন এবং আহত হয়েছেন সহস্রাধিক।

নিহতদের মধ্যে সিলেটের বিয়ানীবাজারে ৫ জন, গোলাপগঞ্জে ৭ জন, গোয়াইনঘাটে ৩ জন, সিলেট সদরে ২ জন, দক্ষিণ সুরমায় একজন এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) একজন।

নিহতদের ১৫ জন গেজেটভুক্ত হয়েছেন। এরমধ্যে শাবিপ্রবির ছাত্র রুদ্র সেন সিলেটে মারা গেলেও দিনাজপুরে গেজেটভুক্ত হয়েছেন। তবে এখনো ৪ জনের স্বীকৃতি পাওয়া যায়নি। তারা হলেন—সিলেটের দক্ষিণ সুরমার পঙ্কজ, গোয়াইনঘাট উপজেলার সুমন, নাহেদুল ও সিয়াম। শহীদ পরিবারের বর্তমান অবস্থা, প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা তুলে ‘জুলাইগাথা’য় তুলে ধরছে বাংলানিউজ।

নিহত শহীদদের অন্যতম রায়হান উদ্দিন (২১)। ২০২৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন তিনি। একটি দুর্ঘটনায় কোমরের হাড় ভেঙে যায় রায়হানের বাবা ফারুক আহমদের। সেই থেকে পড়ালেখার পাশাপাশি সংসারের চাপ সামলাতে হয়েছে রায়হানকে। ছোট ভাইকে নিয়ে বাবার চায়ের দোকান সামলাতেন তিনি। পরিবারের অন্ন সংস্থানের অন্যতম উপায় ছিল চায়ের দোকান। সিলেটের বিয়ানীবাজার পৌর এলাকায় দোকানটির অবস্থান।

চার ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয় রায়হান। জুলাইয়ে ছাত্রদের ডাকে আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। ৫ আগস্ট পুলিশের গুলিতে নিহত হন রায়হান।

আগামী ৫ আগস্ট রায়হানকে হারানোর দিন। চোখের পলকে একটি বছর গত হয়ে গেল। আজও ছেলে হারানোর শোক ভুলতে পারেননি রায়হানের বাবা। গত বছরের ৫ আগস্ট বিকেল ৫টায় বিয়ানীবাজার থানার সামনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান রায়হান। সেদিন তার ছেলেসহ আরও দুজন শহীদ হন।

বাংলানিউজের কাছে সাক্ষাৎকারে রায়হানের আন্দোলনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে তার বাবা ফারুক আহমদ বলেন, “আমার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল তেলিকান্দি গ্রামে। সিলেটে আসি ২০ বছর আগে। এখানে ফেরি করে সংসার চালাতাম। বিয়ানীবাজার পৌর এলাকার নয়াগ্রামে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে একটি ভাড়া বাসায় থাকি। এখান থেকেই ছেলেদের পড়ালেখা চালিয়েছি ফেরি করে। কয়েক বছর আগে দুর্ঘটনায় মেরুদণ্ডে আঘাত পাই। এরপর থেকে চলাচল করতে পারি না। সেই থেকে একটি চায়ের দোকান দিলে অসুস্থতার কারণে দোকানেও বসতে পারি না। গত বছরের ৫ আগস্ট আমাকে দোকানে বসিয়ে রায়হান ছাত্রদের সঙ্গে যায়। কয়েক ঘণ্টা ধরে না ফেরায় ছোট ছেলে সিয়ামকে রায়হানের খোঁজে পাঠাই। এরপর দোকানের মালিক এসে জানান, রায়হানের গুলি লেগেছে!”

“খবর পেয়ে ছুটে যাই হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে দেখি অনেক লোকজন গুলিবিদ্ধ। তখন কেউ আমাকে ছেলের লাশ দেখতে দেয়নি। অন্য একটি গাড়ি দিয়ে নিথর দেহ বাসায় নিয়ে আসা হয়। প্রায় মাগরিবের সময় প্রতিবেশীরা আমাকে বাসায় নিয়ে আসেন। তখন বারান্দায় রাখা সন্তানের লাশ দেখে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমার বাপজান বুকে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। পরে স্থানীয় কাউন্সিলর সায়েক আহমদসহ অনেকের সহযোগিতায় ছেলের লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করি। ”

ছেলে আমার কোনো রাজনীতি করতো না জানিয়ে রায়হানের বাবা আরও বলেন, “সে বিএনসিসির এক্স ক্যাডেট ছিল। পাশাপাশি আনসারের ট্রেনিং নিয়েছে। পড়ালেখার পাশাপাশি কম্পিউটার শিখেছে। ছেলেকে হারানোর এক বছর পার হতে চললেও মনে হয়, এই বুঝি রায়হান এসে বাবা বাবা করে ডাকছে!”

ফারুক আহমদ বলেন, “ছেলের কারণে সবাই একটু-আধটু খবরাখবর রাখছে। সরকারি-বেসরকারি সহায়তা হিসেবে জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা, জেলা পরিষদ থেকে ২ লাখ টাকা এবং জামায়াত ও বিএনপি থেকেও অর্থ সহায়তা পেয়েছি। ”

তিনি বলেন, “বর্তমান ইউনূস সরকার ভালো, কিন্তু ছেলের শহীদের সনদ তো পাইলাম না। ছেলেকে ফিরে পাব না জানি, অন্তত একটি স্বীকৃতি থাকুক, ছেলেটি দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। আর যারা গুলি করে আমার কলিজার টুকরা সন্তানকে হত্যা করেছে, তাদের বিচার দেখে যেতে চাই। ”

উল্লেখ্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত বছরের ১৮ আগস্ট সিলেটে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে পানিতে পড়ে মারা যান শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রুদ্র সেন (২২)। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলন চলাকালে সিলেটে এটিই প্রথম মৃত্যু। এরপর ১৯ জুলাই নগরের কোর্ট পয়েন্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সাংবাদিক আবু তাহের মো. তুরাব।

৫ আগস্ট পুলিশের গুলিতে নিহত গেজেটভুক্ত সাতজন শহীদ গোলাপগঞ্জ উপজেলার। তারা হলেন—কামরুল ইসলাম পাবেল (২০), নাজমুল ইসলাম (২২), জয় আহমদ (১৮), মিনহাজ আহমদ (২২), তাজ উদ্দিন (৩৫), গৌছ উদ্দিন (৩২) ও সানি (১৯)। একই দিনে শহীদ হন বিয়ানীবাজার উপজেলার আরও ৪ জন। তারা হলেন—রায়হান উদ্দিন (২১), ময়নুল ইসলাম (৩৫), তারেক আহমদ (২৩) এবং রায়হান উদ্দিন (২১)।

সোহেল মারা যান গত বছরের ২০ জুলাই। সিলেট সদরের ওয়াসিম ১৯ জুলাই ঢাকার বাড্ডায় এবং ২ আগস্ট হবিগঞ্জ সদরে মারা যান সিলেট সদরের মোস্তাক আহমদ (২৩)। তাদের নামও সিলেটে গেজেটভুক্ত হয়েছে।

এ ছাড়া ৪ আগস্ট গোয়াইনঘাটে নিহত সিয়াম (১৪), সুমন মিয়া (২৫), নাহিদুল ইসলাম (২২) এবং দক্ষিণ সুরমার পঙ্কজ কুমার করের (২২) নাম এখনো তালিকাভুক্ত হয়নি।

এনইউ/এমজেএফ/জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।