কৃষি বাংলাদেশের প্রধান অর্থনৈতিক খাত। দেশের বহু মানুষ এই খাতের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে এবং এটি মোট দেশজ উৎপাদনেও (জিডিপি) গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে কৃষিকে আরও সহনশীল করতে মাঠ পর্যায়ে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে। কৃষিতে বিপ্লব ঘটাতে ড্রোন, স্যাটেলাইট এবং ডিজিটাল কৃষিসেবা বিস্তারের মাধ্যমে এ খাতকে আরও গতিশীল ও টেকসই করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এসব প্রযুক্তির মাধ্যমে জমির অবস্থা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং সঠিক সময়ে সঠিক চাষাবাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে কৃষকদের। এ উদ্দেশ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ‘ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার অ্যান্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট (সিএসএ-ডব্লিউএমপি)’ বাস্তবায়ন করছে, যার মাধ্যমে কৃষি খাতকে আরও টেকসই ও জলবায়ু সহনশীল করে গড়ে তোলা হবে।
এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো— প্রকল্প এলাকায় আধুনিক ও জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে শস্য উৎপাদন ও নিবিড়তা বাড়ানো। একই সঙ্গে সেচে পানির অপচয় কমিয়ে তা আরও দক্ষভাবে ব্যবহার করা, এবং উন্নত মানের দানাদার, ডাল ও তেলজাতীয় ফসলের বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও কৃষকের মধ্যে বিতরণ করা।
২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদে দেশের আটটি বিভাগের ১৭টি জেলার ২৭টি উপজেলায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে এ প্রকল্প। যার মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ১০৬ কোটি ৭.৭৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকার (জিওবি) দিচ্ছে ২১ কোটি ২৭.৭৪ লাখ টাকা এবং বাকি ৮৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। ২০২২ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) কর্তৃক প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত এই প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি ৬৮ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৪৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার কৃষক সরাসরি এই প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছেন। পাশাপাশি আরও ৫১ হাজার কৃষক আধুনিক প্রযুক্তি ও চাষ পদ্ধতি দেখে শিখে উপকৃত হচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এই প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের কৃষি খাতে একটি বড় ধরনের বিপ্লব ঘটবে।
এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক কৃষিবিদ খন্দকার মুহাম্মদ রাশেদ ইফতেখার বাংলানিউজকে বলেন, প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য ছিল শস্য নিবিড়তায় ২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি আনা। যা বাস্তবে অধিকাংশ উপজেলায় ৫ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি প্রকল্পের বড় সফলতা।
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় আমদানি করা হয়েছে চারটি উন্নতমানের কৃষি ড্রোন। ২১ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ১৫ জন ড্রোন পাইলট তৈরি করা হয়েছে। ড্রোনগুলো দিয়ে পর্যবেক্ষণ, সার ছিটানো এবং দুর্গম হিলি অঞ্চলে কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। শুরুতে দুটি উপজেলায় পরীক্ষামূলকভাবে ড্রোন ব্যবহার শুরু হবে। মাঠ তদারকিতে ড্রোন প্রযুক্তির ব্যবহার, উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থায় ডিজিটাল প্রযুক্তির সংযোজন এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রযুক্তি সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে কৃষিকে আমরা ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করছি।
কৃষিবিদ খন্দকার মুহাম্মদ রাশেদ জানান, এই প্রকল্পের মাধ্যমে একটি সমন্বিত ও বহুমাত্রিক কৃষি উন্নয়ন ধারণা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই প্রকল্পে ফার্মার্স ক্লাইমেট স্মার্ট স্কুল, ফার্মার্স ক্লাইমেট স্মার্ট ক্লাব, ক্লাইমেট স্মার্ট কৃষক, ক্লাইমেট স্মার্ট কৃষি গ্রাম, ফার্ম হাউজের বাণিজ্যিক মডেল, উৎপাদক সংঘ এবং কৃষি পণ্য সংগ্রহ কেন্দ্র— এসবকে ভিত্তি করে একটি পূর্ণাঙ্গ ও আধুনিক কৃষি কাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে।
প্রকল্পটি পরিকল্পনা করা হয়েছে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা, সেচ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, আধুনিক ও বুদ্ধিনির্ভর কৃষি সেবা, ফসলের যত্ন, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, জ্বালানি সাশ্রয় এবং আবহাওয়া, জলবায়ু ও পরিবেশের নানা দিক মাথায় রেখে।
শুধু তাই নয়, প্রকল্পের আওতায় ফলবাগান ও সৌর পাম্প কেন্দ্রিক উৎপাদকদের নিয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে উৎপাদক সংঘ। একই সঙ্গে উচ্চমূল্যের ফসল, দানাদার, ডাল ও তেলবীজ ফসলের উন্নত বীজ উৎপাদন, চারা উৎপাদন ও জৈব সার উৎপাদনভিত্তিক সংঘ গঠনের মাধ্যমে টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করা হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন কৃষিপণ্য বিপণন ব্যবস্থা সুসংহত হবে, অন্যদিকে কৃষকের ন্যায্য দাম পাওয়াও নিশ্চিত হবে। এছাড়া মাঠ তদারকিতে ড্রোন প্রযুক্তির ব্যবহার এবং ফার্মহাউজ, উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থায় ডিজিটাল প্রযুক্তির সংযোজন কৃষিকে আরও গতিশীল ও আধুনিক করে তুলবে।
কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তাদের জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়াতে প্রকল্পের আওতায় জিআইএস, প্রকিউরমেন্ট এবং তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক সুনির্দিষ্ট প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এসব প্রশিক্ষণ এই প্রকল্পের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। এ প্রকল্পটি ‘ক্লাইমেট স্মার্ট কৃষি’র একটি পরিপূর্ণ রূপায়ণ বলেও উল্লেখ করেন প্রকল্প পরিচালক কৃষিবিদ খন্দকার মুহাম্মদ রাশেদ ইফতেখার।
তিনি জানান, প্রকল্পের আওতায় মাঠ পর্যায়ে আরও চালু করা হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি কার্যক্রম। এর মধ্যে রয়েছে— সেচের পানিসাশ্রয়ী প্রযুক্তি (অল্টারনেট ওয়েটিং অ্যান্ড ড্রায়িং- এডব্লিউডি), ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন, সোলার সেচ ব্যবস্থা, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ব্যবহার এবং লবণ ও খরা সহনশীল ফসলের চাষাবাদ। ইতোমধ্যে ৩৬টি মিনি সিডলিং পলিহাউজ স্থাপন, ১৪ হাজারের বেশি কৃষি প্রযুক্তি প্রদর্শনী এবং ২ হাজার ৮৫০টি কৃষি যন্ত্র বিতরণ সম্পন্ন হয়েছে।
ক্লাইমেট স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি কমিয়ে প্রকল্পের আওতাধীন এলাকায় কৃষি উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। একই সঙ্গে কৃষকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং বিভিন্ন ধরনের শস্য চাষ পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য।
বাস্তবায়িত প্রকল্পে যে সুবিধাগুলো রয়েছে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— রাইস ট্রান্সপান্টারের মাধ্যমে ধানের চারা রোপণ; ফল বাগান; উচ্চ মূল্যের ফসল চাষ; জৈব বালাইনাশকের ব্যবহার; ভাসমান বেডে সবজি চাষ; সর্জান পদ্ধতিতে সবজি চাষ; পলিনেট হাউজ; কুল চেম্বার; ভার্মি কম্পোস্ট চেম্বার স্থাপন; বারিড পাইপ প্রযুক্তি; পলি মালচিং; এডব্লিউডি; ফিতা পাইপ; সোলার ইরিগেশন; ড্রিপ ইরিগেশন বা বিন্দু সেচ ও কম্বাইন্ড হারভেস্টার।
রাইস ট্রান্সপ্লান্টার হলো ধানের চারা রোপণের একটি যন্ত্র। এই যন্ত্রের মাধ্যমে কম সময় এবং কম শ্রমে অনেক বেশি ধানের চারা রোপণ করা সম্ভব হয়। একসঙ্গে চারা রোপণের কারণে ধানের ফলন বাড়ে এবং উৎপাদনের খরচ কমে, ফলে কৃষকরা বেশি লাভবান হন। কৃষিকে আরও যান্ত্রিক ও আধুনিক করতে প্রকল্পের আওতাভুক্ত উপজেলাগুলোয় রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ব্যবহার করে ধানের চারা রোপণ করা হচ্ছে।
বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষ বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রকল্পের আওতায় উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মোট ১৮০০টি ফল বাগান স্থাপনের ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে ইতোমধ্যে ১০৪০টি ফল বাগান তৈরি করা হয়েছে। এসব বাগানে আম, লেবু, কুল, ড্রাগন, পেয়ারা, লিচু সহ বিভিন্ন ধরনের ফল চাষ করা হচ্ছে। ফল চাষকে বাণিজ্যিক উৎপাদনের এক কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে অনেক কৃষক এখন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।
উচ্চ মূল্যের ফসল হিসেবে আদা, হলুদ, রসুন, পেঁয়াজ, গ্রীষ্মকালীন টমেটো, তরমুজ, শিমসহ মোট ২৭৩৬টি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই ধরনের ফসল (এইচভিসিএস) বাজারে ভালো দামে বিক্রি হয়। এছাড়া, জৈব কীটনাশক ব্যবহারের ফলে এসব ফসলের গুণগত মান উন্নত হয় এবং বাজারে এর চাহিদাও বেশি থাকে। এর ফলে কৃষকের আয় বাড়ে এবং তারা প্রচলিত ধান ফসলের তুলনায় এই উচ্চ মূল্যের ফসল চাষে আরও উৎসাহিত হন।
জৈব বালাইনাশক পরিবেশবান্ধব। কারণ এতে কোনো ক্ষতিকর রাসায়নিক থাকে না, তাই এটি মাটি, পানি ও বাতাসকে দূষণ থেকে রক্ষা করে। জৈব বালাইনাশকের ব্যবহার মাটির স্বাস্থ্য ভালো রাখে, ফসলের গুণগত মান বৃদ্ধি করে এবং কৃষিকে টেকসই উন্নয়নে সাহায্য করে।
ভাসমান বেডে সবজি চাষের মাধ্যমে জলাভূমির প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে প্রায় সারা বছর শাকসবজি উৎপাদন করা সম্ভব। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যা প্রবণ এবং জলাবদ্ধ এলাকায় এই পদ্ধতি টেকসই ও কার্যকর কৃষি পদ্ধতি হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ১৯০টি ভাসমান বেডে সবজি চাষ প্রদর্শনী চালানো হচ্ছে, যা কৃষকের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে ১৮০টি সর্জান পদ্ধতিতে সবজি ও ফল চাষের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে। সর্জান পদ্ধতি বিশেষ করে জলাবদ্ধ ও বন্যাপ্রবণ এলাকায় উপযোগী একটি কৃষি চাষের পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে মাটির উঁচু অংশে (সর্জান) শস্য বা সবজি চাষ করা হয় আর নিচু অংশে (পাট্টি) পানি নিষ্কাশন করা হয় বা মাছ চাষ করা যায়। সর্জান পদ্ধতিতে চাষাবাদের ফলে জমির জলাবদ্ধতা কমে, মাটির উর্বরতা ভালো থাকে এবং সেচের পানি ব্যবস্থাপনাও সহজ হয়।
পলিনেট হাউজ হলো চারা উৎপাদনের একটি নিয়ন্ত্রিত ও নিরাপদ ব্যবস্থা। এই প্রকল্পের আওতায় দেশের ২৭টি উপজেলায় ৩৬টি স্থানে মোট ৫২৪ বর্গমিটার আয়তনের পলিনেট হাউজ স্থাপন করা হয়েছে। এখানে সবজি, ফল, ফুল এবং উচ্চমূল্যের ফসলের চারা উৎপাদন করা হয়। পানি ব্যবস্থাপনা, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও রোগবালাই নিয়ন্ত্রণের জন্য এই হাউজগুলোয় উন্নত ব্যবস্থা রয়েছে। পাশাপাশি একটি প্রদর্শন স্থানও রয়েছে, যা চারা বিক্রয়ে সহায়তা করবে। প্রতিটি পলিনেট হাউজ থেকে চারা উৎপাদনের ধরন অনুসারে বছরে প্রায় ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা আয় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সাব প্রকল্প এলাকায় কিছু প্রগতিশীল কৃষকের বাড়িতে বিশেষ করে পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য কুল চেম্বার স্থাপন করা হচ্ছে। এসব চেম্বার তৈরি করার আগে কৃষক পরিবারের বাড়ির বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে ডিজাইন করা হয়।
ভার্মি কম্পোস্ট প্রযুক্তি হলো একটি জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রযুক্তি (ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি-সিএসএটি), যা টেকসই কৃষির গুরুত্বপূর্ণ উপায়। এর প্রদর্শনীর মূল লক্ষ্য হলো এই জৈব সার ব্যবহারের পরিমাণ বাড়ানো, যাতে সাব প্রকল্প এলাকায় রাসায়নিক সারের অতিরিক্ত ব্যবহার কমে এবং নিরাপদ কৃষি নিশ্চিত হয়।
প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি সাবপ্রকল্প এলাকায় মোট ৫৭টি স্থানে বিনামূল্যে বারিড পাইপ ইরিগেশন সিস্টেম স্থাপন করা হচ্ছে। এই প্রযুক্তি সেচের পানি সাশ্রয় করে, কারণ ভূগর্ভস্থ পাইপের মাধ্যমে সরাসরি ফসলের জমিতে পানি পৌঁছে দেয়।
পলি মালচিং পদ্ধতিতে মাটির ওপর প্লাস্টিকের পাতলা শিট দিয়ে একটি ঢাকনা তৈরি করা হয়, যা মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখে এবং আগাছা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। প্রকল্পভুক্ত উপজেলাগুলোয় মোট ২৭৩৬টি উচ্চমূল্যের ফসল চাষের সময় এই পলি মালচিং প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে।
প্রকল্পভুক্ত উপজেলা মেলায় মোট ১৫২০টি অল্টারনেট ওয়েটিং অ্যান্ড ড্রায়িং (এডব্লিউডি) পদ্ধতির সেচ প্রদর্শনী স্থাপন করা হবে। এডব্লিউডি হলো কৃষিতে একটি কার্যকর সেচ প্রশমন কৌশল, যা বিশেষ করে দরিদ্র কৃষকদের জন্য সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য। এই পদ্ধতি ব্যবহারে ফলনে কোনো ক্ষতি না হয়ে প্রায় ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত পানি সাশ্রয় করা যায়।
ফিতা পাইপ ব্যবহার করে দীর্ঘ দূরত্বে পানি সরবরাহ করা হয়। এটি সেচের জন্য একটি সহজ, পানি অপচয় কমানো এবং খরচ সাশ্রয়ী পদ্ধতি। প্রকল্প এলাকার ২২৮টি স্থানে ফিতা পাইপের মাধ্যমে সেচের পানি সরবরাহ করা হবে। প্রকল্প এলাকায় ১৯টি সার প্রকল্প এলাকার ৫৭টি স্থানে বিনামূল্যে ৫৭টি সৌর শক্তি চালিত সেচ সিস্টেম স্থাপন করা হবে। এই পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির মাধ্যমে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে, কার্বন নিঃসরণ কমবে এবং সেচের খরচও কমবে।
ড্রিপ ইরিগেশন বা বিন্দু সেচ হলো সেচের সর্বোত্তম ও দক্ষ পদ্ধতি। এতে পানি কোনো অপচয় ছাড়াই সরাসরি ফসলের মূলের কাছে পৌঁছে যায়, যা পানি সাশ্রয় করে এবং ফসলের ভালো বৃদ্ধি নিশ্চিত করে। প্রকল্প এলাকায় বিনামূল্যে ৫৭টি ড্রিপ ইরিগেশন সিস্টেম স্থাপন করা হবে। এবং সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ৫৭টি ফার্মারকে ভর্তুকি মূল্যে ৫৭টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার সরবরাহের পরিকল্পনা রয়েছে। এর ফলে ফার্মহাউজভুক্ত কৃষকসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার কৃষকরা স্বল্পমূল্যে ধান সংগ্রহ ও মাড়াইয়ের কাজ করতে পারবেন।
কৃষির আধুনিকীকরণে তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে মাঠ পর্যায়ের তদারকির সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে মাঠের ফসলের অবস্থা পর্যবেক্ষণ, তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ড্রোন প্রযুক্তি, জিআইএস, রিমোট সেন্সিং এবং স্বয়ংক্রিয় তদারকি টুল ব্যবহার করা হবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ফার্মের হিসাব-নিকাশ, কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার, ফার্মের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ এবং বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করার জন্য একটি সমন্বিত ফার্ম হাউজ ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ তৈরি করা হবে। এছাড়া, কৃষকদের কাজ সহজ করতে কিছু গাণিতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী অ্যাপসও তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে চাষাবাদের ধরন বদলানো হবে, চাষের প্রতিটি ধাপে মান বৃদ্ধি করা হবে, ফসল সংগ্রহ ও কৃষিপণ্যের বিপণন ব্যবস্থা উন্নত করা হবে। এর ফলে কৃষকদের পারিবারিক আয় বাড়বে, তাদের ক্রয় ক্ষমতা উন্নত হবে এবং সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই প্রকল্প থেকে পাওয়া শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতের টেকসই কৃষি নীতিমালায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়া, বাংলাদেশের ২০৪১ সালের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এই প্রকল্প একটি কার্যকর মডেল হিসেবে কাজ করতে পারে।
এসএমএকে/এমজে