ব্যাংকক, থাইল্যান্ড থেকে: ঢাকা থেকে গ্রামে গেলে যেমন লাগে, আমার ঠিক সেই রকম অনুভূতি হচ্ছে। হবেই বা না কেন, আমি রয়েছি ব্যাংকক থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরের একটি গ্রামে।
মনেই হয় না, এটি ব্যাংকক, থাইল্যান্ডের রাজধানী।
আমিসহ তিনজন এখানে এসেছি গত ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে। অন্য দু’জন হলেন এনজিও কর্মী রিয়াজ মনোয়ার এবং কামরুন নাহার শাহানা। আর ১১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় এসে যোগ দিয়েছেন বান্দরবানের পুলিশ সুপার কামরুল আহসান।
১০ ফেব্রুয়ারি রাত সোয়া দশটায় ইউনাইটেড এয়ারে আমরা রওনা দেই। ব্যাংককে পৌঁছাই যখন তখন রাত পৌনে তিনটা, আর ব্যংকক সময় রাত পৌনে দুইটা। পৌনে দুইটায় ব্যাংককের সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্টে পৌঁছে চোখ তো ছানাবড়া। এতো বড়, এতো সুন্দর, এতো পরিষ্কার, এতো সুন্দর স্থাপত্য (আর আমি আমার নিজ এয়ারপোর্টে দেখে এলাম একটা সাদা আর কালো বিড়াল হাঁটাহাঁটি করছে, মশার জন্য মানুষ ঠিক মতো বসতে পারছে না)। আর এতো রাতেও গিজগিজ করছে মানুষ।
এয়ারপোর্টে নেমে এক প্রান্ত থেকে হেঁটে এলাম আরেক প্রান্তে ইমিগ্রেশনের জন্য। হাজার হাজার মানুষ। লাইন ধরতে হলো। সামনে পেছনে মানুষের লম্বা লাইন। কয়েক ধাপ পেরিয়ে এলাম মুল কাউন্টারে। আমার সামনে তখনো ১০ থেকে ১২ জন। হঠাৎ করেই কাউন্টার থেকে একজন অফিসার এসে আমার সামনের লোকগুলোকে ভেতরে নিয়ে দরোজাটা আটকে দিলেন। ভাবলাম, এভাবে বোধ হয় কয়েকজন কয়েকজন করে নিয়ে কাজ শেষ করবেন। কিন্তু এমা, এ কি?
ভেতরের লোকগুলোর কাজ শেষ হবার পর টেবিলের ওপর টাঙিয়ে দেওয়া হলো, ক্লোজড। আমার পেছনে তখনও লম্বা লাইন।
চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম, সব কাউন্টারে কাজ হচ্ছে। শুধু আমি যে লাইনে দাঁড়ানো সেই কাউন্টারটাই ক্লোজ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। কিন্তু বাঙালি ধৈর্য বলে কথা, কাহাতক আর সহ্য করা যায়। আর সবচেয়ে বড় কথা, আমারটা বাদে সব জায়গায় কাজ হচ্ছে। মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হলো। একটা লাইনে যখন শ’খানেক মানুষ থাকে, তখন হুট করে কি করে কাউন্টার ক্লোজ করে দেয়?
দুই পাশের কাউন্টারে কথা বলতে চাইলাম। কিন্তু তারা পাত্তাই দিচ্ছেন না (মনে মনে ভাবলাম, ব্যাটারা, তোদের ভাগ্য ভালো, বাংলাদেশে তোদের জন্ম হয়নি, পাত্তা না দেওয়ার মজাটা বোঝাতাম)। আবার তারা ইংরজিও ঠিকমতো বোঝেন না। অবশেষে অনেক চেঁচামেচির পর দুজন লোক এসে বসলেন কাউন্টারে। আমিতো খুব খুশি। কারণ, তখন প্রথমেই আমি। পাসপোর্ট আর টিকিটের কপি দিলাম।
খুবই হতাশ হয়ে মাঝবয়সী লোকটা আমায় বললেন, আমি বহির্গমনের ফর্মটা ফিলআপ করিনি। কাগজটা হাতে নিয়ে চলে এলাম একপাশে। ফিলআপ করে আমিসহ বাকি দুজন যখন লাইনে দাঁড়ালাম, তখন আমাদের সামনে অন্তত জনা বিশেক মানুষ। হায় রে কপাল, এতোক্ষণে কখন আমার ইমিগ্রেশন শেষ হয়ে যেতো।
অবশেষে সামনে গিয়ে অফিসারকে বোঝাতে সক্ষম হলাম যে, এই লাইনের প্রথমেই ছিলাম আমি। সুতরাং, আমাদের কাজট আগে করা উচিত। ভদ্রলোক বুঝলেন, চলে এলাম সামনে। ইমিগ্রেশন শেষ করলাম।
ভেতের ঢুকলাম। আমার সঙ্গের দু’জন ততোক্ষণে বেঞ্চে বসেই ঘুম। রাত তখন হবে আনুমানিক সাড়ে ৩টা। ওখানে লাগেজ রেখে আমি ঘুরে ঘুরে দেখলাম। ইমিগ্রেশন থেকে বের হয়ে তখন আমি অনেক দূরে। হঠাৎ করেই মনে হলো, ভুল করলাম নাতো, আবার কি আমি ঢুকতে পারবো? মাথা খারাপ হয়ে গেলো। ভেতরে ঢুকতে গেলাম। গার্ড বাধা দিলো। কতো ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ইংরেজিও বোঝে না। কিভাবে কি করি? হায় হায়, এখন উপায়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম, নিজেকে গালি দিলাম, এমন বোকার মতো কাজ করে মানুষ?
অবশেষে মোক্ষম অস্ত্রটি ব্যবহার করলাম । একজন অফিসারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে মিষ্টি করে একটু হাসি দিলাম। ব্যস, আর যায় কোথায়? একটু গাইগুই করলেও বুঝলাম, পটে গেছে। কেল্লা ফতে, কাজ হয়ে গেলো। নিজে এসে ভেতরে দিয়ে গেলেন। আগের জায়গায় এসে দেখি রিয়াজ ভাই আর শাহানা আপা তখনো ঘুমাচ্ছেন। আমি তখন বসে নিঃশ্বাস নিলাম। এরা জানেনও না, কি হয়ে গেল!
চোখ বন্ধ করে বসে আছি। ভাবছি আমার বাসার কথা। আম্মুকে বলে এসেছি, এয়ারপোর্টে নেমেই ফোন করবো। কিন্তু কোনো ভাবেই পারছি না, নেটও পাচ্ছি না যে, ফেসবুকে যোগাযোগ করবো। কেবলি মনে পড়ছে, আম্মুর মুখটা। সারারাত কোনোভাবেই ঘুমাবেন না, হঠাৎ চোখ লেগে এলেও কিছুক্ষণ পর পরই মোবাইলে সময় দেখবেন। হয়তো পুরো ঘর পাঁয়চারি করছেন। চোখ বন্ধ করে মাকে বললাম, ‘‘মা..আমি ভালো আছি। শুধু তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না, তুমি কি শুনতে পাচ্ছো আমাকে?’’
যাই হোক, রাতটা কাটালাম। সকাল ৮টায় আমাদের নিতে আসবে। ৬টার দিকে ৩ নম্বর গেটের সামনে চলে এলাম। কতো ধরনের মানুষ যে দুনিয়াতে আছে তা বুঝি এয়ারপোর্টে এলেই বোঝা যায়!
৩ নম্বর গেটে বসে আছি। কতো জন কতো জনকে রিসিভ করছে, কিন্তু আমাদেরতো কেউ নিতে আসছে না। ৬টা, ৭ টা, ৮টা বেজে গেলো। কেউ নেই।
অবশেষে সাড়ে ৯টায় আলিফ এলেন আমাদের নিতে। জানলাম, ওরা রাত ৩টায় আমাদের খুঁজে গেছেন। কিন্তু তখন আমরা এখানে না থাকাতে দুই ঘণ্টা থেকে চলে গেছেন। অবশেষে গাড়িতে উঠলাম।
৩৫ মিনিট পর এলাম ক্যাম্পাসে।
সকাল গেলো, সিম কার্ডের জন্য একে বলছি, ওকে বলছি। কিন্তু সবাই ব্যস্ত। সবচেয়ে বড় কথা, ব্যাংকক সিটি থেকে আমরা রয়েছি ৩০ কিলোমিটার দূরে। একটা সিমের জন্য কে যাবে? ততোক্ষণে আমার অস্থির লাগতে শুরু করেছে, বাসার কথা ভেবে। না জানি, বাসায় সবাই কি করছে?
অসম্ভব সুন্দর দেশ থাইল্যান্ড। ছিমছাম, গোছানো। রাস্তার দুই পাশে আমাদের চেনা অনেক ফুলগাছে ফুল ফুটে আছে। রাস্তা ঘাট সব ঝকঝকে। দুই পাশে পুরোনো ধাচের একতলা কিংবা দোতলা বাড়ি। ঠিক যেন জৌলুস নেই, কিন্তু স্নিগ্ধতা আছে। আর একটি জিনিস খেয়াল করলাম, রাস্তার পাশে কোথাও কোনো ইংরেজি লেখা নেই, সব জায়গায় থাই ভাষা।
মনে পড়লো, এ রকম একটা ট্যুরিজম প্রধান দেশে ইংরেজি বাদ দিয়ে নিজেদের ভাষা সব জায়গায় ব্যবহার করেছে, আর আমরা বাঙালিরা যেন কথায় কথায় ইংরেজি বলতে না পারলে ইজ্জত যায়!
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৩
জেএ/ সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর- [email protected]; [email protected]