ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

যেভাবে রক্ষা পেলো ‘উপবন’, বাঁচলো শত জীবন

সাব্বির আহমদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪৭ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০১৩
যেভাবে রক্ষা পেলো ‘উপবন’, বাঁচলো শত জীবন

(এডিটর-ইন-চিফ ও হেড অব নিউজের উদ্দেশে লেখা চিঠি)
সিলেট: গভীর রাত। গভীর ঘুমে মানুষ।

দূরপাল্লার বাসে যারা যাত্রী তারাও থাকেন ঘুমে। ট্রেনের শত শত যাত্রী তখন ঘুমে আচ্ছন্ন। কেউ হয়ত হেলে পড়ছেন পাশের জনের ওপর। কেউ ধাক্কা খেয়ে চোখ খুলে আবার ঢলে পড়ছেন। ঝক ঝকা ঝক শব্দে রাতের নিস্তব্ধতা পেরিয়ে ট্রেন চলছে তো চলছেই।

ট্রেনটির নাম ‘উপবন’। রাতে ঢাকা থেকে ছেড়ে ভোরে তার সিলেটে পৌঁছানোর কথা। সেই ট্রেনে আছেন শত শত যাত্রী। হরতালের কারণে ট্রেনের যাত্রী সংখ্যা আরও বেড়েছে। কারণ, সাধারণত পিকেটাররা ট্রেন থামিয়ে ভাঙচুর করবে না, এমনটিই তাদের ধারণা।
 
ট্রেনটির চালক ও এর পাঁচ শতাধিক যাত্রী তখনও জানতেন না যে, তাদের জীবন কতটা মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে!
রাত তখন সাড়ে ৩টা। বাংলানিউজের সংবাদ দেওয়া শুরু হবে যখন যা ঘটে, তখনই তা দিয়ে। এমন প্রস্তুতি নিয়ে বাসায় আমি তখন ঘুমিয়ে পড়েছি। ভোরে বের হতে হবে হরতালের সংবাদ সংগ্রহ করতে। বালিশের পাশে রাখা আছে মোবাইল ফোনটাও।

ঘড়ির কাঁটায় যখন ৩টা বেজে ১৫ মিনিট তখন একটি কল এলো আমার মোবাইল ফোনে। ঘুম ভেঙে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ফোনটি তুলে কানে ধরলাম। ও প্রান্তে থেকে একজন বললেন, ‘‘আমি অমুক বলছি, কুলাউড়া থেকে। ’’

আমি বললাম- জ্বি, বলুন। তিনি বললেন, ‘‘কিছু দৃর্বৃত্ত হরতালের স্লোগান দিয়ে বরমচাল-কুলাউড়া এলাকায় রেললাইন উপড়ে ফেলেছে। একটু পরে এ লাইন দিয়ে উপবন আসবে ঢাকা থেকে। ’’

এবার আমি উৎকণ্ঠার সঙ্গে তার কাছে জানতে চাইলাম, “আপনি সত্যিই বলছেন তো?” তিনি বললেন, ‘প্রাকৃতিক প্রয়োজনে সাড়া দিতে বের হয়ে দৃষ্কৃতিকারীদের রেল উপড়ে ফেলার ঘটনাটি দেখেছি। তাই, আমি নিশ্চিত। ”
 
এবার আমি বললাম, ‘‘আপনার মোবাইল ফোনটি হাতে রাখুন। আমি আপনাকে ফোন দিচ্ছি বলেই লাইন কেটে দিলাম।

তখন ঘড়ির কাঁটায় ৩ টা ১৭ মিনিট হবে।

মহূর্তেই অনেক ভাবনা এলো। এই ইন্টারসিটি রেলে আমিও একসময় যাত্রা করেছি। হয়ত শত শত রেলযাত্রীর মতো ঘুমিয়ে পড়েছি কতোবার। আর এভাবে আমিও দুর্ঘটনায় পড়তে পারতাম! ভাবতেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল!
Moulvibazar-Train-01
শত শত মানুষের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন! এখানে মানবিকতার প্রশ্ন জড়িত। এখানে আমার সাংবাদিকতার চেয়ে মানবধর্মটিই বড় মনে হলো!

এমন চিন্তা করে নিউজ করার কথা একেবারেই ভুলে গেলাম। আমার কাছে তখন শত শত মানুষের জীবন বাঁচানোর তাগিদ।

সঙ্গে সঙ্গে আমি ফোন দিলাম সিলেট রেল স্টেশনের জিআরপি থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আলমগীর হোসেনের মোবাইল ফোনে।

বাংলানিউজের জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে তার সঙ্গে অসংখ্যবার কথা হয়েছে। সেই সুবাদে আমার নম্বরটি তার মোবাইলে ফোনে সেভ করা আছে, সেটা জানি।

তখন তিনিও ঘুমাননি। আমার ফোন কলের প্রথম কলটি ধরেই তিনি জানতে চাইলেন কেন ফোন দিয়েছি। তাকে তড়িঘড়ি  ঘটনাটি জানালাম। তিনিও চিন্তিত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে কুলাউড়া জিআরপি পুলিশের ওসি স্বপন বড়ুয়াকে ফোন দিয়ে বিষয়টি জানালেন।

আমিও স্বপন বড়ুয়ার ফোন নম্বর তার কাছ থেকে সংগ্রহ করে ফোন দিলাম। স্বপন বড়ুয়া ছুটে গেলেন স্টেশনে।
স্টেশন মাস্টার তাকে জানালেন, ‘‘না তো, এ রকম কোনো সংবাদ পাইনি তো! তাহলে তো খোঁজ নিতেই হবে!’’
এবার আমার মোবাইল ফোনে কল এলো স্বপন বড়ুয়ার।

ফোন করে তিনি আমাকে বললেন, “দেখুন, এ রকম অনেক ভুয়া ফোন আসতে পারে। কেউ ভুয়া সংবাদ দিয়ে পুলিশকে হয়রানিও করতে পারে। ’’

আমি তাকে আমার পরিচয় দিয়ে বললাম, ‘‘দেখুন, এখানে অনেক মানুষের জীবন-মৃত্যুর ঘটনা। আপনারা দ্রুত কিছু একটা করুন, দয়া করে!’’

এবার তিনি বললেন, ‘‘আপনি যে স্পটের কথা বলছেন, সেখানে যেতে অনেক সময় লাগবে। আমাদের ট্রলিও নেই। তাই, টর্চ হাতে করেই লোক পাঠাচ্ছি। ’’

আমি তখন বিছানা ছেড়ে চেয়ার-টেবিলে এসে বসে গেলাম। খুবই চিন্তিত! মনটাও অস্থির হয়ে আছে। সেই সঙ্গে উৎকণ্ঠাও। কারণ, এখানে শত শত মানুষের জীবনের প্রশ্ন!

কিছু সময় পর আবার ফোন দিলাম স্বপন বড়ুয়াকে। তিনি বললেন, ‘‘আমরা খোঁজ নিচ্ছি। আপনাকেও জানাবো। একই সঙ্গে ট্রেনটিকে খুবই আস্তে চালিয়ে আসতে বলা হয়েছে। কারণ, সত্যিই যদি এ রকম হয়, তাহলে তো শত শত প্রাণ যাবে। কারণ, এই পথে ট্রেন দ্রুতগতিতে চলে। ট্রেনটি এখন খুবই ধীরে ধীরে আসছে, যাতে করে দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। ’’

এরই মধ্যে ‘‘গভীর রাতে রেললাইন উপড়ে ফেলেছে হরতাল সমর্থকরা’’- আমার সোর্সের বরাত দিয়ে একটি নিউজ লিখে ফেললাম।
Moulvibazar-Train-02
৩টা বেজে ৪৭ মিনিটে অফিসে নিউজটি ই-মেইলে পাঠিয়ে দিয়ে নিউজরুমে ফোন করি। ফোন ধরে নিউজটি মেইলে এসেছে বলে আমাকে নিশ্চিত করা হয়।

এর পর ভোর রাত সাড়ে ৪টায় স্বপন বড়ুয়াকে ফোন দেওয়া মাত্রই তিনি বললেন, ‘‘মাত্র দুই মিনিট আগে ট্রেনটির ইঞ্জিনসহ ৬টি বগি লাইনচ্যূত হয়েছে। ট্রেনটি ধীরে ধীরে আসতে বলায় বড় ধরনের প্রাণহানি থেকে বাঁচা গেছে। তবে যাত্রীরা সামান্য আহত হয়েছেন। পরে ফোন দিচ্ছি। উদ্ধার কাজে যাচ্ছি” বলেই ফোন লাইন কেটে দিলেন তিনি।

সঙ্গে সঙ্গে ‘ট্রেন লাইনচ্যুত’ নামে একটি নিউজ স্বপন বড়ুয়ার বরাত দিয়ে লিখে ফেলি।

রাত ৪টা ৫৪ মিনিটে নিউজটি অফিসে পাঠিয়ে ফোন দেই। ও প্রান্ত থেকে বলা হয়- ‘মেইল এসেছে’। এর মাধ্যমে এ ঘটনা প্রথম বাংলানিউজ ব্রেকিং নিউজ করে; যা অন্য মিডিয়া অনেক পরে বাংলানিউজের মাধ্যমে জানতে পেরে তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে নিউজ করে।

এদিকে, আমি বিষয়টি বড় ঘটনা হওয়ায় ৫টা ২৪ মিনিটে বাংলানিউজের এডিটর-ইন-চিফ আলমগীর হোসেন ভাইকে এসএমএস করে জানাই।

সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফিরতি এসএমস পাঠান। আমার কাছে- ‘ওকে ’ লেখা এসএমএস পাঠান তিনি। খুব আশ্চর্য হতে হয়, বিশ্বের মিডিয়ায় এটি খুবই ব্যতিক্রম যে, এত রাতেও সজাগ আছেন এডিটর-ইন-চিফ। শুধু সজাগই নন তার ‘ওকে’ লেখা এসএমএস নিউজ দ্রুত পাঠাতে একধরনের তাগিদও ছিল, যা আমি অনুভব করলাম।

বুঝলাম, আমার এসএমএস পেয়ে হয়ত তিনি ইতোমধ্যে নিউজ রুমের সঙ্গে কথা বলে ফেলেছেন। বাংলাদেশে এ রকম এডিটর-ইন-চিফ পাওয়া আর কতজন সাংবাদিকের ভাগ্যে জুটেছে, আমি জানি না!

তবে বলবো, আলমগীর ভাইয়ের কাছ থেকে এ রকম উত্তর পাওয়া নতুন কোনো কিছু নয়। আরও অনেকদিন গভীর রাতে তাকে এসএমএস করার সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর এসেছে তার কাছ থেকে।

বাংলাদেশে অনলাইন জার্নালিজমের তিনি শুধু পথিকৃৎ নন, তিনি বাংলাদেশের প্রথম কোনো অনলাইন নিউজ পোর্টালের সদা সক্রিয় নিউজ রুম চালুর পথিকৃৎও!

এবার আসি, বাংলানিউজের হেড অব নিউজ মাহমুদ মেনন ভাইয়ের কথায়। মনে আছে, বাংলানিউজে ২০১১ সালের জুন মাসে আমার যখন নিয়োগ হয়েছিল, তখন মেনন ভাই একটি কথা বলেছিলেন- ‘‘সাব্বির!

বাংলানিউজের কাজ সব সময়। বাংলানিউজের সাংবাদিকদের ঘুম নেই, থাকতে নেই, ২৪ ঘণ্টার সাংবাদিক। ”
তাৎক্ষণিক আমি খুবই চিন্তিত হয়েছিলাম। আর মনে মনে ভেবেছিলাম- তাহলে কি আমি রাতে আর ঘুমাতে পারবো না! পরক্ষণেই তিনি বললেন, “ঘুমানো যাবে। তবে সে ঘুমও যেন জেগে জেগে ঘুমানোর মতো হয়!’’
মঙ্গলবারের (সোমবার দিনগত রাত) ঘটনাটি সে রকমই। আমি ঘুমিয়েছিলাম ঠিকই! কিন্তু জেগে ঘুমানোর মতোই!

আজ আমার এতই আনন্দ লাগছে যে, অতীতে কোনো নিউজ করে এত আনন্দ আমি আর পাইনি। সত্যিই তো এত মানুষের জীবন মরণ ছিল একটি তথ্যের ভেতরে লুকানো!

আমি বিষয়টি প্রথম জেনেই পুলিশকে জানানোর কারণে ট্রেনটি ধীরে ধীরে আসতে বলা হয়। আর এ জন্য ট্রেন বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেলো। বেঁচে যায় অনেকগুলো প্রাণ!

ভোরে জিআরপি সিলেট রেল স্টেশনের ওসি ও কুলাউড়ার জিআরপি পুলিশের ওসি দুজনই ফোন করে আমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে, বললেন- ‘‘আপনার তথ্য পেয়ে ট্রেনটি ধীরে ধীরে আসতে বলায় আজ বড় দুর্ঘটনা থেকে বাঁচলো একটি ট্রেন! বাঁচলো শত শত যাত্রীর জীবন! কারণ, ২০ ফুট রেললাইন উপড়ে ফেলায় এ দুর্ঘটনায় কত যে প্রাণহানি হতো, তা সহজে অনুমানও করা যাবে না।

এদিকে, ১২ ঘণ্টা পর মঙ্গলবার বিকেলে ট্রেন উদ্ধার ও রেললাইন মেরামত করে যোগাযোগ স্বাভাবিক করা হয়। আর আমি আমার ছোট্ট সাংবাদিকতা জীবনে একটি বড় তৃপ্তি লাভ করলাম!

এই অনুভূতিগুলো আমার প্রিয় এডিটর-ইন-চিফ ও হেড অব নিউজের কাছে শেয়ার করলাম। ধন্যবাদ।

সাব্বির আহমেদ
স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, সিলেট

বাংলাদেশ সময়: ০৭৩৫ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০১৩
সম্পাদনা: আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।