ঢাকা: দেশের রাজনৈতিক দলগুলো বহির্বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন ও বিভিন্ন বিষয়ে সমর্থন লাভে কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। একইভাবে বেড়েছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কূটনৈতিক পর্যায়ের আগ্রহ।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বাংলানিউজকে এ বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য দিয়েছে।
সূত্র জানায়, চলতি বছরে দেশের বেশ কিছু ঘটনা, সাম্প্রতিক সাংঘর্ষিক কিছু বিষয়, গণজাগরণ মঞ্চ ও সংসদ, বিরোধীদলের অব্যাহত হরতাল কর্মসূচি এবং সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিরোধী নেতাকর্মী নির্যাতন প্রভৃতি বিষয়ে কূটনৈতিকদের আলাপচারিতা ও তৎপরতা অনেক বেড়েছে।
এ অবস্থায় দেশের বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত ইসলামীসহ বেশ কিছু ছোট রাজনৈতিক দলও দেশে প্রভাব বিস্তার ও বিদেশের সমর্থন পেতে ক্রমেই কৌশলে কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়াচ্ছে বলে সূত্রটি নিশ্চিত করে।
দেশে অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা শুধু অন্য কূটনীতিকদের সঙ্গেই নয়, সম্পর্ক উষ্ণ রেখে চলেছেন ব্যবসায়ী, শিক্ষক, আমলা ও সাবেক কূটনীতিকদের সঙ্গেও।
চলতি বছরের গত তিন মাসে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ক’টনীতিকদের ৮২ টি চা-চক্রের আয়োজন ছিলো বলে জানায় সূত্র।
ছোট ছোট এসব পার্টির আয়োজক ছিলেন হয় কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা, বিদেশি কোনো ক’টনীতিক নয়তো বিভিন্ন মহলের ব্যবসায়ীরা।
এসব পার্টি রাজধানীর বিভিন্ন কুটনীতিকের বাসা কিংবা রেষ্টুরেন্টে হয়েছে বলে দায়িত্বশীল সুত্রগুলো জানায়।
এসব ক্ষুদে পার্টির মধ্যে বিএনপি’র আয়োজনে ছিলো ২৪টি, কূটনীতিকদের ২৪ টি, জাতীয় পার্টির ৬টি, ব্যবসায়ীদের ২৩টি এবং জামায়াতের আয়োজনের পার্টি ছিলো ৫টি।
আওয়ামী লীগ নেতাদের কোনো পার্টির কথা সরাসরি জানা না গেলেও তারা যে বিভিন্ন ক’টনীতিকের পার্টিতে অংশ নেন সে তথ্য নিশ্চিত করেছে সূত্রগুলো।
দলগুলো তাদের পক্ষে বিদেশি সমর্থন আদায়ে এ পার্টির আয়োজন করে বলে সুত্র দাবি করেছে।
এসব পার্টিতে সরকারের মন্ত্রী, এমপি, উপদেষ্টারাও অংশ নেন। শুধু অংশগ্রহণ নয়, পার্টির আয়োজনেও তারা ছিলেন সক্রিয়।
সূত্র জানায়, বিরোধীদল বিএনপি’র সাবেক মন্ত্রী, উপদেষ্টা, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, জি-নাইন’র নেতারা এসব পার্টির আয়োজনে তৎপর ছিলেন।
অতি গোপনে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে জামায়াত নেতা ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ও ব্যারিস্টার আরমান করেছেন বেশ কয়েকটি বৈঠক। কোনো কোনোটির কথা গণমাধ্যমগুলোও প্রকাশ করেছে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে। এগুলোর প্রতি পাঠকদের আগ্রহও ছিলো বেশ লক্ষ্য করার মতো।
এদিকে, বিদেশিদের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক উন্নয়নে বিভিন্ন পার্টিতে কূটনীতিকদের আমন্ত্রণ করছেন ব্যবসায়ীরাও। যে দেশে ব্যবসার সম্প্রসারণে যে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ, তারা বৈঠকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন সে দেশের রাষ্ট্রদূত বা সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে।
আর এক্ষেত্রে কূটনীতিকরাও পিছিয়ে নেই। দেশের চলমান অবস্থা ও বাস্তবচিত্র এবং এসব বিষয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতামত সবটুকু জেনে নিতে কূটনীতিকরাও আগ্রহী হয়েছেন রাজনৈতিক দলগুলোকে আমন্ত্রণে। জেনে নেওয়ার চেষ্টা করছেন ভেতরের খবরগুলো।
এসব পার্টিতে যোগ দিচ্ছেন শিক্ষক ও এনজিও মালিকরাও। সবকিছু মিলে কূটনৈতিক পাড়া পুরো সময় জুড়েই সরগরম থাকছে বলে সূত্র জানায়।
প্রচারমাধ্যমের কল্যাণে এসব খবর তৎক্ষণাৎ চাউর হয়ে যাচ্ছে মানুষের কাছে। কার সঙ্গে কার বৈঠক, উদ্দেশ্য কী হতে পারে, পারস্পরিক আলোচনার সারমর্ম নিয়ে জল্পনা-কল্পনাও চলে বিভিন্ন সময়।
১৩ মার্চ রাজধানীর একটি রেস্টুরেন্টে কূটনীতিকদের সঙ্গে মির্জা ফখরুলসহ দলের ক’জন নেতার বৈঠক ব্যাপক আলোচনায় আসে। এই বৈঠকে সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখানো হয় কূটনীতিকদের।
সম্প্রতি জাতীয় পার্টি প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ চীনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে টানা দু’ঘন্টার বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকের খবর আলোচিত হয়েছে বিভিন্ন মহলে। তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু কী হতে পারে- তার সারমর্মও বোঝার চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ।
এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ইমতিয়াজ আহমেদ ২৫ মার্চ ফ্রান্স রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে এক ঘন্টা বৈঠক করেন। সে বিষয়টি নিয়েও রাজনৈতিক মহলে আলোচনা রয়েছে।
জামায়াত নেতা আবদুর রাজ্জাক কানাডার রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যে বৈঠক করেছেন তা অল্প সময়ের মধ্যেই গণমাধ্যমে এসে যায়।
এদিকে সরকারি দল সরাসরি বৈঠকের পাশাপাশি চিঠির মাধ্যমে ক’টনৈতিক যোগাযোগ বাড়াচ্ছে বলে জানিয়েছে সূত্র। সরকারি দলের হয়েই পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিপু মনি বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে বিশ্বে ১৯৩ টি দেশে চিঠি দিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে একটি সূত্র।
কুটনীতিকদের নিয়ে একটি পার্টিরও আয়োজন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এ ছাড়াও সরকারি দলের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী, পর্যটন মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী, এইচটি ইমাম, তৌফিক-ই-এলাহী ও ড মশিউর রহমান সংশ্লিষ্ট ছিলেন এ ধরনের বৈঠকে।
বিএনপিও একই ভাবে বাংলাদেশের সম্প্রতিক ঘটনা তুলে ধরতে সম্প্রতি একটি পার্টি দিয়েছেন বিশ্বের কুটনৈতিকদের সম্মানে। চলতি মাসে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যোগ দেন আরো দুটি পার্টিতে।
বেশ কয়েকটি পার্টি দিয়েছেন ভারতীয় হাই কমিশনার পঙ্কজ শরণ ও মার্কিন রাষ্ট্রদুত ড্যান ডব্লিউ মজীনা।
বসে নেই সাবেক ক’টনীতিকরাও। গত ২২ মার্চ রাতে মোহাম্মদপুর ইকবাল রোডের ইনাম আহমেদ চৌধুরীর বাসায় কূটনৈতিকদের সৌজন্যে একটি পার্টির আয়োজন ছিলো। টানা দুই ঘণ্টার এই পার্টিতে
বিএনপির ব্যারিস্টার মওদুদ, ফখরুল ছিলেন। আর ছিলেন মার্কিন, ব্রিটিশ, ফান্স, জার্মান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, নরওয়ে, দক্ষিণ কোরিয়াসহ ১২টি দেশের রাষ্ট্রদূত।
২১ মার্চ বিশিষ্ট সাংবাদিক এনায়েত উল্লাহ খান একটি পার্টির আয়োজন করেন তার বারিধারার বাসায়। এ পার্টিতে অংশ নেন বেশ কয়েকজন শিক্ষক, ব্যবসায়ী। ছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূতও।
২০ মার্চ মার্কিন রাষ্ট্রদূত একটি পার্টির আয়োজন করেন গুলশানের বাসায়। পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন, কান্ট্রি ডিরেক্টর ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, কান্ট্রি ডিরেক্টর ইউএনডিপি, কান্ট্রি ম্যানেজার কনকো ফিলিপ, কান্ট্রি ডিরেক্টর সেভরন, এমডিজি এনার্জি নওশেদ আলী, জার্মানি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও নরওয়ের রাষ্ট্রদূত ছাড়া বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। প্রফেসর সাইফুল ইসলাম, প্রফেসর সদরুল ইসলাম, ফারুক সোবহানও ছিলেন ওই বৈঠকে। বৈঠকটি সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত চলে।
একই দিনে সকাল সোয়া ৯টা থেকে সোয়া ১০টা পর্যন্ত ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার।
১৯ মার্চ বিকেল ৫টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনারের বাসায় একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।
১৩ মার্চ বিএনপির পক্ষ থেকে কূটনৈতিকদের সম্মানে আরও একটি পার্টি আয়োজন করা হয়।
বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে ২৭ মার্চ বুধবার রাতে রাজধানীতে ২টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। একটি করেছেন মহাজোটের শরীক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আরেকটি বৈঠক হয়েছে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনার বাসায়। এ দু’টি বৈঠকেই দেশের চলমান রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয় বলে বৈঠক সূত্র জানিয়েছে।
জানা যায়, সন্ধ্যা ৭টায় গুলশানের একটি রেস্টুরেন্টে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল, ইউএসএইড ও ইউকে এইডে কর্মরত ৭/৮জন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেন। এটি চলে পৌনে ৯টা পর্যন্ত। এতে এরশাদের সঙ্গে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দীন আহমেদ বাবলু উপস্থিত ছিলেন।
প্রেসিডিয়াম সদস্য ও এরশাদের রাজনৈতিক উপদেষ্টা জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু বৈঠকের সত্যতা স্বীকার করে বাংলানিউজকে বলেন, ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের কেন্দ্রীয় প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। আজকের বৈঠককে সৌজন্য সাক্ষাত বলা যেতে পারে।
এদিকে এর আগে সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৮টা পর্যন্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় চা-চক্র অনুষ্ঠিত হয়। এতে খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, বন ও পরিবেশ হাসান মাহমুদ, প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুত উপদেষ্টা তৌফিক এ এলাহী চৌধুরী, নারী ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী শিরীন শারমীন চৌধুরী, ইউএসএইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ইশরাত জাহান, রেক্টর ফরিদ উদ্দীন বেশ কয়েকজন অংশ নেন।
দু’টি বৈঠকে বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি, ভবিষ্যত সঙ্কট থেকে উত্তরণ, বিরোধীদলের সঙ্গে সংলাপ, সহিংস রাজনীতির নানা বিষয় উঠে আসে বলে দায়িত্বশীল সূত্রের দাবি।
এর আগে, ২৬ ফ্রেরুয়ারি মার্কিন রাষ্ট্রদুতের পার্টিতে তার বাসায় যোগ দেন বিএনপি নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, , সাবেক কুটনীতিক ফারুক সোবহান, হুমায়ুন কবির, ব্যবসায়ী নেতা এ কে আযাদ, এক্স প্রেসিডেন্ট এ্যমাচাম ফরেষ্ট কুকসান মার্কিন ব্যবসায়ীসহ বেশ কয়েকজন দেশি বিদেশি ব্যবসায়ী।
২৫ ফ্রেরুয়ারী দীপু মনির চিঠি দেওয়ার পরদিন ভারতীয় হাইকমিশনারের বাসায় ২০ কূটনীতিককে নিয়ে একটি পার্টি দেওয়া হয়।
২৫ ফেব্রুয়ারি জি-৯ এর সাইফুল ইসলাম গুলশানের হোটেলে একটি পার্টি দেন। এতে ছিলেন শমসের মবিন চৌধুরী, আমীর খসরু মাহমুদ, শফিক রেহমান, ড. এম ওসমান ফারুক, ইউকে’র ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত, জামান, ফ্রান্স, শ্রীলংকা, দক্ষিণ কোরিয়া, সুইডেন, নরওয়ে, নেদারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, ইউএস দূতাবাসের কর্মকর্তা, ইইউ কর্মকর্তা ও এডিবি’র কান্ট্রি ডিরেক্টর।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৮ ঘন্টা, মার্চ ২৭, ২০১৩
এমএম/এসকেএস