ঢাকা: বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হকের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মাহমুদুর রহমান বাবু একসময় শিবিরের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে পরিচিত বাবু এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন নিজ জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, সুযোগ পেয়ে মাহমুদুর রহমান জামায়াত-শিবিরকে পুনর্বাসনের কাজে মাঠে নেমেছেন। তার কারণে বর্তমান সরকারের সময়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে জামায়াত-বিএনপির লোকজন বেশি চাকরি পেয়েছে। তার কারণেই প্রকৃত আওয়ামী লীগাররা এখন কোনঠাসা, ক্রমেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে দলীয় কর্মকাণ্ডে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মাহমুদুর রহমান শিবগঞ্জের রাধাকান্তপুর ফাজিল মাদ্রাসা থেকে আলিম পাশ করেন। এই মাদ্রাসায় পড়ার সময় তিনি ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ওই সময়ে জামায়াত-শিবিরের বিভিন্ন মিছিল সমাবেশেও ছিলেন অগ্রভাগে।
আলিম পাশের পর তিনি চলে যান ঢাকায়। সেখানে গিয়ে শিবিরের পরামর্শেই ‘গুপ্তচর’ হিসেবে ছাত্রলীগে যোগদান করেন। ঢাকায় ছাত্রলীগের রাজনীতি করলেও ঠিকই শিবিরের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। এমনকি এলাকায় গেলে জামায়াত-শিবির নেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠকও করতেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও বর্তমান বিনোদপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, মাহমুদুর রহমান যে ছাত্রশিবির করতেন সে কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
তিনি বলেন, “মাহমুদুর রহমান রাধাকান্তপুর মাদ্রাসায় পড়ার সময় ছাত্রশিবির করতেন। আমি তাকে অনেকবার বিভিন্ন মিছিল মিটিংয়ে অংশ নিতে দেখেছি। তিনি এখনও জামায়াত-শিবিরের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন। ”
জামায়াত-শিবিরের জড়িত বলেই তিনি এবার ওই রাধাকান্তপুর মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হয়েছেন বলেও অনেকে জানিয়েছেন। শিবগঞ্জে এলে মাদ্রাসায় বসেই জামায়াত নেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠকে অংশ নেন।
শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মির্জা শাহাদাৎ খুররম বাংলানিউজকে জানান, তিনি ঢাকায় গিয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে অংশ নেন। এলাকায় তিনি শিবিরের করতেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আমি কিছু বলতে পারব না। ”
চাপাইনবাবগঞ্জ শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মাহমুদুর রহমানের পরিবার আগাগোড়াই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাবা মোস্তাফিজার রহমান ছিলেন শান্তি বাহিনীর সদস্য। আর চাচা মাঈদুর রহমান রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন। এমনকি তার মা-ও জামায়াতের নারী কর্মী বলেও অভিযোগ করেন অনেকে।
এ প্রসঙ্গে এপিএস মাহমুদুর রহমান বলেন, তারা বাবা শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন না। তাদের এলাকায় মাহিদুর রহমান নামের একজন রাজাকার ছিলেন, যাকে স্থানীয়রা তার চাচার নামের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে।
জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কথা সরাসরি অস্বীকার না করে বলেন, “আমি মাদ্রাসায় বেশি দিন পড়িনি। পড়েছি ঢাকা কলেজে। সেখানেই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে অংশ নেই। ”
মাদ্রাসায় পড়ার সময় ছাত্রশিবির করতেন কিনা এ প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া হলে অনেকটা ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, “বাংলানিউজের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। ”
আপনার বিরুদ্ধে উৎকোচ নিয়ে নিয়োগ বাণিজ্য পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে—এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, “আজেবাজে কথা লিখলে আমিও ছেড়ে কথা বলব না। এর আগেও আমার নামে একটি পত্রিকা এমন কথা লিখেছিল, পরে প্রতিবাদ ছাপাতে বাধ্য হয়েছে। ”
২০১০ সালের এপ্রিল মাসে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হকের বাড়িতে এক অনুষ্ঠানে এপিএস মাহমুদুর রহমান শিবিরকর্মী দাবি করে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা তাকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবি জানান।
ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী মাহমুদুর রহমান এপিএস হওয়ার পর মন্ত্রীর আর্শিবাদে চাঁপাইনবাবগঞ্জে বেশ গুরুত্ব পেয়েছেন। নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটিপতি বনেছেন।
তার প্রভাবেই শিবগঞ্জের কয়েকশ জামায়াত-বিএনপি সমর্থক সরকারের বিভিন্ন বিভাগে চাকরি বাগিয়ে নিয়েছেন।
বর্তমান সরকারের সময়ে পুলিশ, বিজিবি, আনসার, স্বাস্থ্য, খাদ্য, গ্যাস, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, ফায়ার সার্ভিস, প্রাথমিক শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিবগঞ্জ এলাকার যত লোকের চাকরি হয়েছে তাদের বড় অংশই জামায়াত-শিবির ও বিএনপি সমর্থক বলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা দাবি করেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, চাকরির জন্য প্রতিমন্ত্রীর সুপারিশ পাঠানোর ক্ষেত্রে এপিএস বাবু দলের কোনো নেতাকর্মীর মতামত ও সুপারিশ কখনই নেননি। একেকজনের চাকরির জন্য বাবু কমপক্ষে দুই লাখ থেকে ছয় লাখ টাকা করে নিয়েছেন।
শিবগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডের কাছে তাদের ভাঙাচোরা বাড়িটি ভেঙে পাঁচতলা ভিত দিয়ে নতুন বাড়ি নির্মাণ শুরু করেছেন। বর্তমানে বিশাল গেটের বাড়িটির একতলার নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। চলছে দোতলার কাজ।
এই বাড়ির পেছনেও আরেকটি বাড়ি নির্মাণ করছেন। সেটিরও একতলার নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। বাড়ির সামনে একটি মার্কেটও নির্মাণ করছেন বাবু। এলাকার নেতাকর্মীরা জানান বাবু ঢাকার উত্তরা এলাকায় ৫ কাঠা জমি কিনেছেন।
আওয়ামী লীগের আদর্শবিরোধী ঘরানায় বেড়ে উঠা বাবুকে দলের নেতাকর্মীরা কখনোই নিজেদের লোক মানতে পারেন না।
এ কারণে প্রতিমন্ত্রী নিজের এলাকার দলীয় ত্যাগী নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত-শিবির শিবগঞ্জ এলাকায় প্রতিমন্ত্রীর বাড়িতে হামলা ও পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি কার্যালয় জ্বালিয়ে দিলেও নেতাকর্মীরা প্রতিরোধ করতে আসেননি। অতীতে যে কোনো সময়ের চেয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা শোচনীয় বলে দাবি তাদের। যে কারণে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়ের পর জামায়াত-শিবির ধারাবাহিকভাবে তাণ্ডব চালাতে পেরেছে। আওয়ামী লীগ কোনো প্রতিরোধ গড়তে করতে পারেনি, পারছে না।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৭, মার্চ ৩১, ২০১৩
ইএস/আরআর