ঢাকা : রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় পুলিশ সোর্সদের বেপরোয়া দৌরাত্মে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তারাই যেন হয়ে উঠেছে সব কিছুর কর্তা ব্যক্তি।
দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ রয়েছে, চিহ্নিত সোর্সরাই নিয়ন্ত্রণ করেন যাত্রাবাড়ী থানা, পুলিশ ও হাজতখানা। নানা রুপে আবির্ভূত হয় সোর্সরা। কখনও তারা সোর্স, কখনও তদবিরকারী দালাল, কখনও মানবাধিকার ও সংবাদকর্মী- তবে বেশিরভাগ সময় সোর্সরা নিজেদেরকে পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিতেই সাচ্ছন্দবোধ করেন।
পুলিশের কথিত নির্যাতনে নিহত কিশোর সাগরকে গ্রেপ্তার করা, হাজতখানায় নিয়ে বেদম মারপিট করাসহ ঘুষের টাকা আদায়ের ক্ষেত্রেও এই সোর্সরাই জড়িত ছিলেন বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ সদর দপ্তরের যুগ্ম কমিশনার আব্দুল জলিল যাত্রাবাড়ী থানায় এরইমধ্যে সোর্স- পুলিশের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্ত শুরু করেছেন।
পুলিশ কর্মকর্তার তদন্ত চলাকালে সরেজমিনে যাত্রাবাড়ী থানায় গিয়েও সোর্সদের দোর্দণ্ড প্রতাপের নানা নমুনা দেখা গেছে। থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মর্যাদার কর্মকর্তাদের সঙ্গে সোর্সদের গলায় গলায় ভাব। অপরাধীদের সঙ্গে নিয়েই পুলিশ কর্মকর্তারা বিভিন্ন মামলা তদন্তে যান। এ নিয়ে প্রশ্ন তুললেই দারোগাদের সোজাসাপ্টা উত্তর : ‘এরা থানার সোর্স। ’ কিন্তু এমন সোর্সের সংখ্যা কত ? এ প্রশ্নের জবাব মেলে না।
তবে সরেজমিনে খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায়, থানার তালিকাভুক্ত দুই শতাধিক অপরাধীর মধ্যে ৮০ জনেরও বেশি ‘দাগী অপরাধী’ থানার সোর্স পরিচয়ে বুক ফুলিয়ে বিচরণ করছে। তাদের ভাষায় সিনিয়র পর্যায়ের সোর্সরা হচ্ছেন, শাহীন, রবি, শহিদ, ছোট আমীর, বড় আমীর, হারুন, জামাই শাহীন, মামুন, নাজির, জহির, আব্বাস, কবীর, পেপার সাগর, কামাল জলিল, উজ্জল, আলম, রিপন প্রমুখ। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ১০/১২টি করে মামলা রয়েছে।
সোর্সরা বরাবরই থানার সিভিল টিম ও কিলো টিমের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের সঙ্গী হয়ে পুরো থানা এলাকা চষে বেড়ান। তবে থানার অফিসার ইনচার্জের (ওসি) স্থায়ী সোর্স হিসেবে আবুল ও দেলোয়ারের পরিচিতি বেশি। এরমধ্যেই এ দুই সোর্স কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন বলে জানা গেছে।
সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত অবস্থান নিয়ে থানা প্রাঙ্গনে কথিত সোর্সদের নানা হম্বিতম্বি দেখা যায়। কাকে ধরে রশিতে বাধতে হবে, কতক্ষণ আট্কে রাখা হবে, কাকে বেধড়ক মারধোর করতে হবে, কোন মামলায় কত টাকা আদায় হবে-সবই নিয়ন্ত্রণ করেন তারা।
এমনকি কার জিডি নেওয়া হবে, কার আবেদনে ঘটনাস্থলে তদন্ত টিম যাবে, কোন্ মামলার বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা রুজু হবে- এর সবই চলে সোর্সদের নির্দেশে, পরামর্শে।
ভুক্তভোগী মানুষজনের অভিযোগ, সোর্সদের সমন্বয়েই রাজধানীর যাত্রাবাড়ি থানা অপরাধ বাণিজ্যের আখড়াস্থলে পরিনত হয়েছে। চিহ্নিত অপরাধী আর দালালদের কারণে সাধারণ মানুষ থানার আশপাশেও ঘেষতে পারেন না, জানাতে পারেন না নিজেদের আর্জি।
সোর্সদের নানা অপরাধ
থানার আশেপাশেই কয়েকটি বাসাকে সোর্সরা প্রতারণা ও হয়রানির আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। পতিতাদের টোপ বানিয়ে বিভিন্ন খদ্দেরকে এসব বাসায় নেওয়া হয়, এরপর পুলিশের সিভিল টিম সেজে সোর্সরাই কথিত অভিযান চালিয়ে খদ্দেরের টাকা-পয়সা, ঘড়ি, মোবাইলসহ মূল্যবান সবকিছু ছিনিয়ে নেয়।
যাত্রাবাড়ী থানা সূত্র জানায়, চিহ্নিত অপরাধীদের বিরুদ্ধে চার হাজারেরও বেশি ওয়ারেন্ট মাসের পর মাস ধরে ফাইলবন্দী করে ফেলে রাখা হয়েছে। কোর্ট ওয়ারেন্ট তামিল করার ক্ষেত্রে পুলিশ কর্মকর্তাদের উদাসীনতার অভিযোগ রয়েছে। ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সোর্সরা মাসোহারা নিয়ে আসে-এ কারণেই দাগী অপরাধী হয়েও তারা থাকে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
র্যাব অভিযানে ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিরা মাঝে মধ্যে গ্রেপ্তার হলেও একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা উল্টো তাদের জামিনের তদবির নিয়ে ছোটাছুটি করেন।
যাত্রাবাড়ি থানার বিরুদ্ধে আরেকটি অভিনব অভিযোগ রয়েছে। থানা বোর্ডে দাগী অপরাধীদের ছবি টাঙ্গিয়ে রাখার নিয়ম পালন হয় ঠিকই-কিন্তু মাথাপিছু ২০ হাজার করে টাকা নিয়ে এসব ছবি বোর্ড থেকে উধাও করার নজির রয়েছে। পর্যায়ক্রমে দাগী আসামির ছবি সরাতে সরাতে এখন নোটিশ বোর্ড প্রায় ছবি শূণ্য হয়ে পড়েছে।
অন্য থানায় আসামি গ্রেপ্তার হলে যাত্রাবাড়ি থানা সেসব আসামির প্রিভিয়াস রেকর্ড লুকিয়ে সাদামাটা রিপোর্ট দিয়ে থাকে। এমনকি এ থানায় গ্রেপ্তার হওয়া দাগী আসামিকেও সাধারণ মামলায় চালান দেওয়ার বহু অভিযোগ রয়েছে, আর এতে ধামাচাপা পড়ে অপরাধীর অতীত অপরাধ বৃত্তান্ত।
এসব ব্যাপারে যাত্রাবাড়ী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এ কে এম আবুল কাশেম বাংলানিউজকে জানান, তিনি সদ্য বদলি হয়ে যোগদান করেছেন। ‘সোর্সদের বাড়াবাড়ি আগে থেকে চলে এসেছে’ মন্তব্য করে তিনি জানান, সোর্সদের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘চিহ্নিত সন্ত্রাসী, সমাজের দাগী অপরাধীদের কাউকে সোর্স হিসেবে ব্যবহারের কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না। কোনো পুলিশ অফিসার তা না না মানলে তার বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময় : ২২৪০ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০১০