ঢাকা: জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রথম যে বিষয়টি উঠে আসে, তা হলো নদ-নদী দিয়ে ঘেরা বনাঞ্চল বাঁচলেই বাঁচবে আমাদের পরিবেশ-প্রতিবেশ। কিন্তু সম্প্রতি বাগেরহাটের রামপালে পরিকল্পিত কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প আমাদের দেশের দক্ষিণে অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম ম্যনগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে বাগেরহাটের রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে উভয় দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে গত ২০ এপ্রিল তিনটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি তিনটি হলো বিদ্যুৎ ক্রয় (পিপিএ), প্রকল্প বাস্তবায়ন (আইএ) ও যৌথ বিনিয়োগের সম্পূরক-সংক্রান্ত চুক্তি। চুক্তিটি স্বাক্ষরের সময় পরিবেশবাদীরা প্রবল প্রতিবাদ করেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনকে চ্যালেঞ্জ করে করা তিনটি রিট হাইকোর্টে বিবেচনাধীন থাকা অবস্থায় চুক্তি করলো সরকার।
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে যেসব বিপর্যয় ঘটবে, সেগুলো সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের হুমকিস্বরূপ। রামপালসহ ২০ কি.মি. বিস্তৃত এলাকায় জীববৈচিত্র্য অর্থাৎ গাছ-পালা, ঝোঁপ-ঝাড়, বনজ গাছ-গাছালি, বন্যপ্রাণী, মাছ, সাপ, মাটি ও পানিতে জন্ম নেওয়া জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীসমূহ সময়ের বিবর্তনে ধ্বংস হয়ে যাবে। বায়ুদূষণকারী বিষাক্ত বর্জ্য উদগীরণের ফলে বনজ গাছ-গাছালি ধ্বংস হবে, এদের বংশবৃদ্ধি প্রচণ্ডভাবে হ্রাস পাবে এবং ওই এলাকায় ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবে।
অপরদিকে এই প্রকল্প রামসার কনভেনশনের পরিপন্থী। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সংস্থা রামসার কনভেনশন কর্তৃপক্ষের উদ্বেগ রয়েছে। বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক জলাভূমিগুলোকে ‘রামসার এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সুন্দরবন ও টাঙ্গুয়ার হাওর রামসার এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করে। স্বাক্ষরকারী প্রতিটি রাষ্ট্র নিজ দেশের রামসার এলাকাগুলোর প্রতিবেশ ব্যবস্থা সংরক্ষণ করতে বাধ্য। বিশ্বের ১৬০টি দেশের ১ হাজার ৯৭০টি প্রাকৃতিক জলাভূমি রামসার এলাকা হিসেবে চিহ্নিত।
১৯৭২ সালে ইরানের রামসার শহরে একটি সম্মেলনের পর বিভিন্ন দেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। সুন্দরবন এলাকায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ সম্পর্কে সরকারের কাছে বিস্তারিত তথ্য চেয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা রামসার কনভেনশন কর্তৃপক্ষ। তারা সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। তারা মনে করে, এই স্থাপনাটি হলে তা সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর হবে। তারা এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান জানতে চেয়েছে। ২২ জুন ২০১১ তারিখে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে সুন্দরবনের এত কাছে ১৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের আগে কোন ধরনের পরিবেশগত সমীক্ষা করা হয়নি বলে অভিযোগ করে। আর তার পরপরই সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করার জন্য সরকার অনেকটা তাড়াহুড়া করে এই প্রকল্পের পরিবেশ প্রতিক্রিয়া যাচাই বা ইআইএ প্রতিবেদনটি করিয়ে নেয়।
সরকারের নিজস্ব একটি সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস (সিইজিআইএস) ‘প্রাথমিক পরিবেশগত সমীক্ষা’ চালায়। এটি সরকারের পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি প্রকল্প, যা এই দপ্তরের একটি উইং হিসেবে কাজ করে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার নিজেকে নিজে কিভাবে সার্টিফিকেট দেয়? সিইজিআইএস’র প্রতিবেদনকে যথাযথ মানের নয় বলে মনে করছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী।
তিনি বলেন, “চুক্তিটি করার আগে যেখানে এই পাওয়ার প্ল্যান্টটি করার পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেই স্থানটি সম্পর্কে ও তার আশেপাশে কি ধরনের প্রভাব পড়বে, কোন ধরনের পরিবেশগত বিপর্যয়ের আশঙ্কা আছে কিনা এইসব বিষয়গুলো নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ এবং দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা করা উচিৎ ছিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। যা না করে শুধুমাত্র দায়সাড়া একটা সমীক্ষা রিপোর্ট দাখিলের জন্যই এই কাজটি করেছে সরকার। ”
তিনি আরও বলেন, “কোন পূর্ণাঙ্গ স্টাডির আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে, যেকোনো মূল্যেই তারা এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি করবেন। যদিও তারা মুখে বলছেন পরিবেশের ব্যাপারটা তারা মাথায় রাখছেন কিন্তু আসলে পরিবেশটা তার কাছে মুখ্য নয়, এখানে মুখ্য হচ্ছে তার প্ল্যানটাকে এখানে প্রতিষ্ঠা করা। ” এই প্লান্টটি গোপালগঞ্জ কিংবা শরীয়তপুরের দিকে করা যেতে পারে বলে প্রস্তাবনা দেন অধ্যাপক হারুন চৌধুরী তার নিজস্ব ইআইএ রিপোর্টে।
আর তাছাড়া, রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির পানি আসবে সংলগ্ন পশুর নদী থেকে। এ জন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনাকারীদের লবণাক্তমুক্তকরণ প্ল্যান্ট বসানোর প্রয়োজন পড়বে। পশুর নদী এমনিতেই শুকিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে যদি এ নদী থেকে পানি প্ল্যান্টে টেনে নেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে নদীর উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর সেচ কাজ বিঘ্নিত হবে। এই নদী সুন্দরবনের অনেকখানি অংশের জীবন প্রবাহকে টিকিয়ে রেখেছে। নদীটি শুকিয়ে যেতে থাকলে মারা পড়বে সুন্দরবনের অসংখ্য প্রাণী। এছাড়াও পশুর নদীর গভীরতা সর্বত্র বড় জাহাজের জন্য উপযুক্ত না হওয়ার কারণে প্রথমে বড় জাহাজে করে কয়লা সুন্দরবনের আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত আনতে হবে, তারপর আকরাম পয়েন্ট থেকে একাধিক ছোট লাইটারেজ জাহাজে করে কয়লা মংলা বন্দরে নিয়ে যেতে হবে। এছাড়া আকরাম পয়েন্টে যে কয়লা বড় নৌযান থেকে ছোট নৌযানে স্থানান্তরিত করা হবে তাতে সুন্দরবনের বন এবং পশু-প্রাণীর কী ক্ষতি হবে তা বিস্তারিত সমীক্ষা করা হয়নি। কারণ যখন এই কয়লা স্থানান্তরিত করা হবে তখন কি পরিমাণ সুরক্ষা অবলম্বন করা হবে, তার কোন পরিকল্পনা সামনে আনেনি সরকার। এভাবেই নদীর পানি প্রতিদিন অনুমানের থেকেও বেশি পরিমাণে দূষিত হবে। যা হিসাবে ধরাই হচ্ছে না।
১৩২০ মেগাওয়াটের জন্য প্রতিদিন প্রায় ১৩ হাজার টন কয়লা প্রয়োজন। অর্থাৎ দ্বিতীয় পর্যায়ের শেষে ২৬ হাজার টন কয়লা প্রয়োজন পড়বে। এর জন্য সুন্দরবনের ভেতরে হিরণ পয়েন্ট থেকে আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার নদীপথে বড় জাহাজ বছরে ৫৯ দিন এবং আকরাম পয়েন্ট থেকে মংলা বন্দর পর্যন্ত প্রায় ৬৭ কিলোমিটার পথ ছোট লাইটারেজ জাহাজে করে বছরে ২৩৬ দিন হাজার হাজার টন কয়লা পরিবহন করতে হবে। কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ থেকে কয়লার গুঁড়া, টুকরো কয়লা, তেল, জাহাজের দূষিত পানিসহ বিপুল পরিমাণ বর্জ্য নিঃসৃত হয়ে নদী-খাল-মাটিসহ গোটা সুন্দরবন দূষিত করে ফেলবে।
এরসাথে আরো যোগ করতে চাই, সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে নদীর আরো ক্ষতি হবে এই কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে। কয়লার দ্বারা সৃষ্ট বায়ু দূষণের কারণে সুন্দরবন এলাকায় এসিড বৃষ্টি হবে, যা নদীর পানির গুণাগুণ নষ্ট করবে। নদীর ভূমিতলের ঋণাত্মক পরিবর্তনের ফলে চিংড়িসহ অন্যান্য মাছের সংখ্যা প্রচণ্ড হ্রাস পাবে। কয়লা থেকে উদ্ভূত বর্জ্য মাছের খাদ্যের সাথে বিক্রিয়া করে তা প্রভাবিত করার ফলে এ মাছ খেলে মানুষ ক্যান্সারসহ অন্যান্য দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হবে। এরইসাথে পৃথিবীর বিরল প্রজাতির ইরাবতী ডলফিন হারিয়ে যাবে, মরে যাবে পশুর নদী, বাড়বে খুলনা অঞ্চলের লবণাক্ততা। মিঠাপানির উৎস হারিযে যাবে আর ক্রমেই বাঘ পড়বে বিপদে। পানির সন্ধানে হয় বাঘকে লোকালয়ে আসতে হবে, অথবা বাংলাদেশের সীমান্ত ত্যাগ করে চলে যেতে হবে ভারতের প্রান্তে। কয়লা থেকে উদগত আর্সেনিক দ্বারা ভূমি জলে আর্সেনিক দূষণ শুধু বৃদ্ধিই পাবে না, তা তরান্বিতও হবে।
রামপালের অধিবাসীরাও খুব ভালো করে জানেন, এ ধরনের বিদ্যুৎ প্রকল্প তাদের এলাকায় কি ধরনের দূষণ সৃষ্টি করবে। পরিবহনে, বাজারে, কিংবা মাঠে মুজিব চাচা, নুরুল ভাই অথবা তাজউদ্দিনরা ক্ষোভের আগুনে ফেটে পড়ছে। খুলনার বিগত মেয়র খালেক তালুকদারের রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ২০১০ সাল থেকে ওই অঞ্চলে ব্যক্তিগত চিংড়ি ঘের- কৃষি জমি দখল প্রক্রিয়া শুরু করে দুর্বৃত্তরা। তখনও পর্যন্ত কোন ধরনের বিদ্যুৎ প্রকল্পের চুক্তি হয়নি। গৌরম্ভা ইউনিয়নের জাহিদ বললেন, তিনি খুব ভালোমতই জানেন, এখানে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প হলে আশেপাশের দখল না হওয়া ঘেরের মালিকরাও চিংড়ি চাষ করতে পারবে না, কারণ বায়ু তখন চরম মাত্রায় দূষিত হবে। পানি হয়ে যাবে চাষের অযোগ্য। ধান চাষের মতো উর্বরতা খুঁজে পাওয়া যাবে না ফসলি জমিতে। অতঃপর সবাইকেই আজ হোক, কাল হোক এলাকা ছাড়তেই হবে। যা হতে দেয়া যায় না। তারা প্রত্যেকেই জানে, পশুর নদীর পানি দূষিত হয়ে আরেকটি বুড়িগঙ্গা সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। এই দূষণই সুন্দরবন ধ্বংসের সূচনা করবে। আর ওদিকে ভূগর্ভস্থ পানি ওঠানোর ফলে দক্ষিণের সেই অঞ্চলগুলোর পানির লবণাক্ততা বেড়ে অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাবে, এটাও স্থানীয়রা উপলব্ধি করতে পারছে। কিন্তু কংক্রিটের শহরে বসে বিজ্ঞজনেরা এর ভয়াবহতা জেনেও অনড় বসে আছেন শুধুমাত্র ভারতের আবদার পূরণের উদ্দেশে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৫ ঘণ্টা, জুলাই ১২, ২০১৩
সম্পাদনা: এম জে ফেরদৌস, নিউজরুম এডিটর