বাঞ্ছারামপুর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) থেকে ফিরে: আয়েশা বেগম ও আক্তার হোসেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার সদ্য উন্নতির ছোঁয়া লাগা গ্রাম জগন্নাথপুরের রোজগেরে এক দম্পতি।
২০০৮ সালে স্ত্রী আয়েশা বেগম উদ্যোগ নেন দীর্ঘমেয়াদি কোনও পেশায় স্বামীকে জড়ানোর। এজন্য অবশ্য তাকেও কাজে লাগতে হয়। কুমিল্লার হোমনায় বাবার বাড়িতে থাকাকালে মিষ্টির কার্টন বানানো শিখেছিলেন। সে বিদ্যা কাজে লাগানোর পরিকল্পনা নেন স্বামীর বাড়িতেও। তিনি বানাবেন আর স্বামী তা নিয়ে বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে বিক্রি করবেন। কিন্তু বাধ সাধে পুঁজি। কাঁচামাল কেনার।
একদিন সেই বাধাও দূর হলো। বসুন্ধরা ফাউন্ডেশনের সদস্য হয়ে আয়েশা বেগম ২০০৮ সালে পেলেন পাঁচ হাজার টাকা ঋণ। তাও আবার কোনওরকম সুদ বা সার্ভিস চার্জমুক্ত। সঙ্গে নিজের কিছু পুঁজি লাগিয়ে শুরু করলেন মিষ্টির কার্টন বানানো। বাঞ্ছারামপুর বাজারসহ আশপাশের বিভিন্ন বাজারের মিষ্টির দোকানগুলোতে সরবরাহ করতে থাকলেন সেগুলো।
আয়েশা বেগম ও আক্তার হোসেন জানালেন, ব্যবসার প্রসারের জন্য বসুন্ধরা ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার এবং সর্বশেষ গত ১৫ ডিসেম্বর সাড়ে সাত হাজার টাকা করে নিয়েছেন।
তারা আরও জানালেন, কারিগরের অভাব থাকায় এখন প্রতি সপ্তাহে গড়ে এক হাজার কার্টনের বেশি তৈরি করা সম্ভব হয় না। এরপরও মাসে অন্তত সাত থেকে আট হাজার টাকা আয় হয় তাদের।
আইয়ুবপুরের শিল্পী বেগম ও ফুলেছা বেগম দুই জা। দু’জনে মিলেই শ্বশুরবাড়ির ঐতিহ্যগত পেশা বাঁশ-বেতের টুকরি, খাঁচি (মুরগি রাখার খাঁচা) ইত্যাদি তৈরির ব্যবসা ধরে রেখেছেন। ফুলেছা বেগমের স্বামী মুরশিদ মিয়াও তাদের সঙ্গে কাজ করেন।
বাঁশ বেশি কিনতে পারলে পণ্য বেশি তৈরি করা যাবে। কিন্তু আর্থিক অনটনের কারণে সারা সপ্তায় দেখা যেতো, একটির বেশি বাঁশ খুঁজে আনা যেতো না। সেও বছর তিনেক আগের কথা। এখন আর সেই অবস্থা নেই। বসুন্ধরা ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে আয়েশার মতোই তিন দফা সুদমুক্ত ঋণ এনে ব্যবসা মোটামুটি জমিয়ে তুলেছেন তারা।
শিল্পী বেগম বললেন, ‘আর হউরে দো ফোলাইনের (শ্বশুরে তো পোলাপানের) লাইগ্যা (জন্য) কিচ্চু রাইখ্যা গেছে না। এক সময় অনেক কষ্ট কইরা থাকতে অইছে। এহন আল্লায় দিলে ভালাই আছি আমরা। ’
ফুলেছা জানালেন, প্রতি সপ্তায় বাঞ্ছারামপুর, সোনারামপুরসহ বিভিন্ন বাজারে অন্তত ৬০ থেকে ৭০টি টুকরি ও খাঁচি বিক্রি করেন তারা।
এভাবে বাঁশগাড়ি গ্রামের আফিয়া বেগম তাঁতের কাজ, পঞ্চমপুরের আরতি রাণী ঘোষ মুড়ির ব্যবসা করছেন। শরিয়তপুরের জ্যো¯œা বেগম রিকশা কিনে দিয়েছেন স্বামী আবুল কালামকে। তারা সবাই নিজেদের বদলে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামেও এনেছেন পরিবর্তনের ছোঁয়া। তবে এসবই হচ্ছে বসুন্ধরা ফাউন্ডেশনের সুদ ও সার্ভিস চার্জমুক্ত ঋণের বদৌলতে।
১৫ ডিসেম্বর বিকালে দূর্গারামপুর গ্রামের উত্তর পাড়ায় মোহাম্মদ ফোরকানের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন আবদুল লতিফ, আবদুল মান্নান ও কাদির মিয়া। প্রত্যেকেই বয়োবৃদ্ধ। তাদের মাঝে আলোচনা চলছে বসুন্ধরা ফাউন্ডেশনের ঋণ নিয়ে।
অনেক আগে বসুন্ধরা ফাউন্ডেশনের ঋণ নেওয়া এক সদস্যের স্বামী আবদুল লতিফ বললেন, ‘অন্য এনজিওগুলান তো ব্যবসা করে। হেই বেডা (বসুন্ধরা গ্রপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান) ব্যবসা ছাড়াই ঋণ দেয়। এইডা কয়জনে করে?’
তিনি আরও বলেন, ‘এই কিস্তি (ঋণ) দেওনে অনেক উপকার অইতাছে। কেউ বাছুর কিনতাছে, কেউ হাঁস-মুরগি কিনতাছে, দোহানে (দোকানে) মাল উডাইতাছে। ’
কাদির মিয়া যোগ করেন, ‘এর লাইগ্যা তো আল্লায় হেরে দিছেও। শাহ আলম সাবও (আহমেদ আকবর সোবহান) এলাকার লাইগা অনেক কিছু করছে। ’
২০০৫ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের কার্যক্রম এখন বাঞ্ছারামপুর উপজেলার নয়টি ইউনিয়নের ৪৮টি গ্রামে চালিয়ে আসছে বসুন্ধরা ফাউন্ডেশন।
বসুন্ধরা গ্রপের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) ও ফাউন্ডেশনের সমন্বয়ক ময়নাল হোসেন চৌধুরী বাংলানিউজকে জানান, ৩৩টি স্কিমের আওতায় বিতরণকৃত এ ঋণের বিনিময়ে দরিদ্রদের কাছ থেকে আমানত হিসেবে কোনও অর্থ নেওয়া হয় না। ঋণ বিতরণের তিন মাস পর থেকে ৫০ সপ্তাহে কিস্তিতে এসব অর্থ আদায় করা হয়।
গত ১৫ ডিসেম্বর সর্বশেষ ২৩ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে আগে ঋণ নিয়ে পূর্ণ পরিশোধ করা ২৪০ জনকে সাড়ে সাত হাজার এবং পুরোপুরি নতুন ১০০ জনকে পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। এদিন ফাউন্ডেশনের তহবিলে নতুন করে ২০ লাখ টাকা দেন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান।
এটি ছিল এ প্রকল্পের ২১তম ঋণ বিতরণ অনুষ্ঠান। এর আগে ২০ বারে দুই হাজার ৮০৭ জন উপকারভোগীর মধ্যে মোট এক কোটি ৫৩ লাখ ৬২ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে দুই হাজার ১৯৭ জন উপকারভোগী কোনও ব্যতিক্রম ছাড়াই এক কোটি ২২ লাখ ৮৭ হাজার ৫০০ টাকা পরিশোধ করেছেন।
বুধবারের ঋণ বিতরণের ফলে এখন ৯৫০ জনের কাছে থাকা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
ময়নাল হোসেন চৌধুরী জানান, ফাউন্ডেশনের এ ঋণ প্রকল্পের প্রকৃত মূলধন ২৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ঘূর্ণায়মানভাবে এখন এক কোটি ৪৪ লাখ ৬২ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে।
পর্যায়ক্রমে উপজেলার সব ক’টি (১৩টি) ইউনিয়নের ১১৮টি গ্রামে, এমনকি সরকারের অনুমতি নিয়ে সারাদেশে এ কার্যক্রম ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলেও তিনি জানান।
বাংলাদেশ সময়: ১১২২ ঘণ্টা, ২১ ডিসেম্বর, ২০১০