রাজশাহী থেকে : বিসিক মঠপুকুর এলাকার ঝুপরি-বস্তিসহ শুধু রাজশাহী জেলাতেই অন্তত পাঁচটি কারখানায় ভেজাল সার তৈরির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব কারখানায় সপ্তাহে পাঁচ থেকে সাত টন সার।
গ্যাস্টার কোম্পানির নিজস্ব বিক্রয়কর্মীর মাধ্যমে ডিলারদের দোকানে দোকানে পৌঁছে দেওয়া হয় এসব ভেজাল সার। আর ভেজাল সার ও নকল কীটনাশক বাজারজাত করে প্রতারক চক্রটি প্রতি মাসেই ৪০/৪৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
গ্যাস্টারের ভেজাল কারখানার কেয়ারটেকার আমজাদ আলী মোহনপুর থানায় গ্রেপ্তারের হওয়ার পর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এসব কথা ফাঁস করে দেন।
তিনি জানান, গ্যাস্টারের মালিক নজরুল ইসলাম রহমত তার চার ছেলেকে নিয়েই ভেজাল সার কারখানাগুলো পরিচালনা করেন। রহমতের বড় ছেলে আব্দুল কুদ্দুস কথিত কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি বোয়ালিয়া থানার আহম্মদনগরের ৪৪ নম্বর বাড়িতে সাইনবোর্ডহীন অস্থায়ী অফিস বানিয়ে নিয়ন্ত্রণ করেন গ্যাস্টার সারের মার্কেটিং বিভাগ।
আমজাদ আলীর উদ্বৃতি দিয়ে মোহনপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহসান হাবিব বাংলানিউজকে জানান, গ্রেপ্তার আমজাদ আলী এরই মধ্যে রাজশাহীর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
ওসি আরও জানান, বারবার অভিযানে গ্যাস্টারের মূল সার কারখানাটি চিহ্নিত হওয়ায় চক্রের সদস্যরা ভিন্ন কৌশলে মাঠে নেমেছে। তারা শহরে ও গ্রামে ভাড়ায় নেওয়া বাড়িঘরে আরও পাঁচটি কারখানা স্থাপন করেছে। সেসব কারখানায় গোপনে চলছে ভেজাল সার তৈরির কাজ। রাজশাহী মহানগরের শালবাগান, মৌগাছী, বিসিক শিল্পনগরের মথুরডাঙ্গা, খড়খড়ি ও বাঘমারার একটি গ্রামে এ সার কারখানাগুলো বসানো হয়েছে বলেও আমজাদ আলী পুলিশকে জানিয়েছেন।
ওসি আহসান হাবিব জানান, প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে গ্যাস্টারের প্যাকেটজাত সার বিভিন্ন নামীদামী কোম্পানির কার্টনে ভরে দোকানে দোকানে পাঠানো হচ্ছে। পুলিশ এরইমধ্যে অভিযান চালিয়ে গ্যাস্টার কারখানা থেকে ঢাকার এসএফ এগ্রো কোং ও রিমন এগ্রো কেয়ার নামে দু’টি কোম্পানির বিপুল পরিমাণ প্যাকেট, কার্টন আটক করে। তবে পুলিশ ভেজাল সার তৈরির পাঁচটি চিহ্নিত কারখানায় অজ্ঞাত কারণে অভিযান চালাচ্ছে না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগী কৃষকরা।
গ্যাস্টার কর্মকর্তাদের বক্তব্য
ভেজাল সার প্রস্তুতের ব্যাপারে গ্যাস্টার কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল কুদ্দুস (৪৫) বাংলানিউজকে জানান, তাদের তৈরি সারের শতভাগ কার্যকারিতা রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘একটা লাইসেন্সের জন্য রাজশাহীর কৃষি অফিস থেকে শুরু করে ঢাকার খামারবাড়ি পর্যন্ত অনেক ছোটাছুটি করেছি, কোনো ফায়দা হয়নি। বরং ঘাটে ঘাটে শুধু টাকা খরচ হয়েছে। ’
এক প্রশ্নের জবাবে আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ‘সরকারি ট্যাক্স নিতে হলে আগে আমার কারখানার লাইসেন্স পৌঁছে দিতে হবে। ’
অনুমোদনহীন সার কারখানা স্থাপন প্রসঙ্গে গ্যাস্টার কারখানার মূল নিয়ন্ত্রক নজরুল ইসলাম রহমত (৬২) বলেন, ‘কৃষি ক্ষেত্রে সহায়তার উদ্দেশে সার তৈরির জন্য লাইসেন্স নিলেও চলে, না নিলেও চলে। বাড়ি বাড়ি পর্যায়ে সার উৎপাদন করলেও বাধা দেওয়ার কিছু নেই। ’
তিনি পাল্টা প্রশ্ন তোলেন, আমি কি পয়জন (বিষ) বানাইতেছি, নাকি বোমা বানাইতেছি ? সরকার প্রয়োজন মনে করলে আমাদের কার্যক্রম দেখে শুনে লাইসেন্স দিক।
এক প্রশ্নের জবাবে রহমত ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলেন, ‘ট্যাক্স দেই না বলেই তো কারখানার সামনে একটা সাইনবোর্ডও লাগাইনি। এরপরও আপনারা (সাংবাদিকরা) খোঁচাখুচি করলে ট্যাক্স দিয়ে দিবো....। ’
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, নজরুল ইসলাম রহমতের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা না থাকলেও নিজেকে তিনি কেমিক্যাল বিজ্ঞানী বলে দাবি করেন। চীনের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে রহমত কেমিক্যাল বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথাও প্রচার করেন তিনি। তবে রহমত প্রশিক্ষণ নেওয়া সংক্রান্ত কোনো প্রমান বাংলানিউজকে দেখাতে পারেননি। তিনি শুধু বলেন, ‘কেমিক্যালের সব বিষয়েই আমার প্রশিক্ষণ নেওয়া আছে-গবেষণার গোপন ব্যাপার কাউকে আমি বলতে বাধ্য নই। ’
কৃষি কর্মকর্তা যা বললেন
নকল কারখানা স্থাপন ও ভেজাল সারে বাজার সয়লাব হওয়া প্রসঙ্গে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক অসীম কুমার জানান, ভেজাল সার বিক্রি বন্ধের জন্য মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের সার্বক্ষণিক নজরদারি রয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানও চালানো হচ্ছে নিয়মিত।
গ্যাস্টারের সার কারখানাটি কৃষি কর্মকর্তাদের তৎপরতার কারণেই সর্বপ্রথম আবিস্কৃত হয় বলে তিনি দাবি করেন।
তিনি জানান, গত পাঁচ বছরে অন্তত আট দফা অভিযান চালিয়ে ওই কারখানা বন্ধও করে দেওয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে কৃষি বিভাগ থেকে মামলাও করা হয়েছে।
‘কিন্তু চক্রটি বারবারই স্থান পরিবর্তন করে চুপিসারে ভেজাল সার প্রস্তুতের কাজ চালায়’ বলেও মন্তব্য করেন কৃষি উপ-পরিচালক অসীম কুমার।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১০