ঢাকা: মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য অভিযুক্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে বুধবার সকাল ৯ টা ১৫ মিনিটে প্রিজন ভ্যানে করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ভবনে নেওয়া হয়। সেখানে প্রথমে তাকে রাখা হয় হাজতখানায়।
সাঈদীর হাজিরা উপলক্ষে সকাল থেকেই পুরাতন হাইকোর্ট ভবনের আশেপাশে ছিলো কড়া নিরাপত্তা। রমনা এলাকার পেট্রোল ইন্সপেকটর ইমানুল হক বাংলানিউজকে জানালেন, রুটিন নিরাপত্তার পাশাপাশি অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন--দুটোই নিরাপত্তার স্বার্থে।
চার প্লাটুন পুলিশ সদস্য সেখানে দায়িত্ব পালন করছিলেন। যার মধ্যে মহিলা পুলিশ সদস্যও ছিলেন।
নীল সাদা টুপি মাথায়, হালকা খয়েরির রঙের আজনুলম্বিত পাঞ্জাবি, খয়েরি কটির ওপরে ভাজ করা ঘিয়ে রঙের শাল পরে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর হাজতখানায় কাটলো এক ঘণ্টা ১০ মিনিট। দোতালায় আদালত কক্ষে তাকে নেওয়া হলো সকাল ১০ টা ২৫ মিনিটে।
আগেই এজলাস কক্ষে আসেন চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুসহ অন্য প্রসিকিউটররা। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আইনজীবী তাজুল ইসলামসহ প্রায় ২০ জনেরও বেশি জামায়াতপন্থী আইনজীবীও হাজির ছিলেন আরও আগে থেকে।
আদালতকক্ষে ঢুকেই এজলাসে দাঁড়িয়ে সাঈদী তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলেন। এরপর এজলাসে রাখা তার জন্য নির্ধারিত চেয়ারে বসেন। ১০টা ২৯ মিনিটে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক, অপর দুই বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর এবং বিচারপতি একেএম জহির আহমেদ আদালতকক্ষে পৌঁছান। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয় আদালতের কার্যক্রম।
শুরুতেই তাজুল ইসলাম তাদের করা তিনটি আবেদনের বিষয়ে কথা বলার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেন ট্রাইব্যুনালের কাছে। ট্রাইব্যুনাল তখন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলীকে তার বক্তব্য পেশ করার জন্য বলেন।
সৈয়দ হায়দার আলী তার সাবমিশনে বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালের গত ২ নভেম্বরের আদেশ অনুযায়ী আমরা গত ২৩ ডিসেম্বর সাঈদীর বিরুদ্ধে তদন্তের অগ্রগতি-প্রতিবেদন জমা দিই। তার বিরুদ্ধে তদন্ত এখনও অব্যাহত রয়েছে। তার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে হত্যা, অগ্নি সংযোগ, ধর্ষণ, লুটপাটসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। তার নিজ এলাকা পিরোজপুরে রয়েছে তার ক্যাডার বাহিনী। তদন্তে যারা সাক্ষ্য প্রমাণ দিয়েছেন তাদের জন্য তারা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এরই মধ্যেই পিরোজপুরে ৬ টি জিডি হয়েছে। স্থানীয় পুলিশ যার তদারকি করছে। ’
সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, ‘আমরা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আটকাদেশের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করছি। ’
কতো দিন সময় প্রয়োজন, ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যানের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মাই লর্ড, আমরা ট্রাইব্যুনালকে এই বলে আশ্বস্ত করতে চাই যে, যতোটুকু সময় প্রয়োজন হবে, তার চাইতে আমরা ১ দিন, ১ ঘণ্টা, ১ মিনিট এমনকি ১ সেকেন্ডও বেশি সময় নেবো না। কারণ এই বিচারকাজ দ্রুত শেষ হোক সেটা আমরাই বেশি কামনা করি। ’
সৈয়দ হায়দার আলী আরও বলেন, ‘কাউকে যেন হয়রানি করা না হয়, আমরা সেদিকে পুরোপুরি সজাগ। যারা তদন্ত সংস্থায় কর্মরত আছেন, তারা তাদের কাজে দক্ষ (দে আর এফিসিয়েন্ট ফর দেয়ার জব)। ’
তিনি বলেন, ‘আমরা কমিটেড, কোনোভাবেই এই কাজে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় নেওয়া হবে না। আর তিনি একজন প্রভাবশালী নেতা। তিনি বাইরে থাকলে তদন্তকাজ ব্যাহত হবে মনে করেই আমরা তার আটকাদেশের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করছি। ’
বিডিআর বিদ্রোহের উদাহরণ:
সময় নেওয়া প্রসঙ্গে সৈয়দ হায়দার আলী তার বক্তব্যে বলেন, ‘এই সেদিন ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহের কথাই আমরা যদি বলি, তাহলেই দেখবো, এটি একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে বন্দী ছিল, খুবই ছোট, সামান্য ঘটনা। এই আধুনিক যুগে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া থাকার পরও বিডিআর বিদ্রোহের তদন্ত শেষ হয়েছে, কিন্তু বিচার শুরু হয়নি। আর মুক্তিযুদ্ধতো ৪০ বছর আগের ঘটনা। দেশে-বিদেশে অসংখ্য তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। সবটুকু সংগ্রহ করতে আমাদের সময় প্রয়োজন। ’
সাঈদী প্রভাবশালী বিশ্বনেতা!
সাঈদীর আইনজীবী তাজুল ইসলাম তার বক্তব্যে বলেন, ‘আমরা সাঈদী সাহেবের জামিনের জন্য আবেদন করছি। তিনি একাধিকবার বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। আমার জানা মতে, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে তার ভক্ত ছড়িয়ে আছে। ’
তদন্ত কর্মকর্তারা কিছু অস্পষ্ট অভিযোগের কথা তাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরেছেন এমন অভিযোগ এনে তিনি বলেন, ‘কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তারা সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে দেখাতে পারেননি। কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া তার মতো একজন নেতাকে আটকে রাখারও কোনো কারণ নেই। ’
তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ট্রাইব্যুনাল চাইলে সাঈদী যে কোনো ধরনের শর্ত মানতে প্রস্তুত। তিনি তার পাসপোর্ট জমা দিয়ে, সিকিউরিটি মানি জমা দিয়ে, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিন্ন করে, এমনকি ঘর থেকে না বের হবার শর্ত দিয়েও তার জামিনের প্রার্থনা করেছেন। ’
উনি যা উনি তাই:
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে অপরাধী বলায় তা খণ্ডন করতে আসেন তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এখনও অভিযুক্ত, অপরাধী নন। কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আমরা অপরাধী বলতে পারি না। ’
এসময় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিজামুল হক নাসিম হেসে উঠে বলেন, ‘মি তাজুল, আমরা এই বক্তব্যে কিয়ার। উনি যা উনি তাই। ডোন্ট ওরি। ’
অ্যাডভোকেট তাজুল তার বক্তব্যে বলেন, ‘মি প্রসিকিউটর তার বক্তব্যে ’৭১ সালে জামায়াতশক্তিসহ অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ব্যক্তিদের বিচারের জন্য বলেছেন। তাহলে কী এই ট্রাইব্যুনাল পলিটিক্যাল পার্টির বিচার করতে বসেছে? মানবতাবিরোধী অভিযোগের বিচারের জন্য নয়?’
ইট মাইট অর মাইট নট বি ট্রু:
সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া সাঈদীকে আটক রাখার বিরুদ্ধে তাজুল ইসলাম বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনের কোথাও তার বিরুদ্ধে স্পেসিফিক অভিযোগ নেই। সবই অভিযোগ। তখন ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান তাকে বলেন, ‘ইট মাইট অর মাইট নট বি ট্রু। ’
বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম তাজুল ইসলামকে বলেন, তদন্তে আছে, তার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পিরোজপুরে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যাকাণ্ড চালায়। তখন তাজুল ইসলাম সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, ‘জামিনের প্রশ্নে ট্রাইব্যুনাল স্যাটিসফায়েড হলে জামিন দিতে পারেন। ’
তখন ট্রাইব্যুনালের আরেক বিচারপতি একেএম জহির আহমেদ বলেন, ‘আপনি শুধু যুগোশ্লাভিয়ার কথা বল্লেন, রুয়ান্ডার কথাতো বললেন না। রুয়ান্ডায় সাসপেকটেড লোককেও আটক রাখা হতো। আর আমরা কোনো আন্তর্জাতিক আইনে এই বিচার করছি না। আমাদের নিজস্ব আইনে এই বিচার হচ্ছে। বিশ্বের একেক দেশে একেক রকম আইন। ’
তাজুল ইসলাম তার বক্তব্যে আরও বলেন, তদন্ত সংস্থার তদন্ত কাজ পরিচালনার সময় তারা পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে ক্ষমতাশীন দলের ক্যাডার বাহিনী দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়েই আওয়ামী লোকদের কাছ থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন বলে পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকার কাটিংও ট্রাইব্যুনালে জমা রয়েছে।
তখন একেএম জহির আহমেদ সেই পত্রিকার কাটিং ধরে প্রশ্ন করেন, ‘এখানে একটি মাত্র পত্রিকার কাটিং রয়েছে। আপনি কী আরও কোনো পত্রিকার কাটিং দেখাতে পারবেন যেখানে এই কথা লেখা রয়েছে?’
‘অল আর রাবিশ!’ প্রসঙ্গ
সৈয়দ হায়দার আলী যখন সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে বক্তব্য রাখছিলেন তখন অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলে উঠলেন ‘অল আর রাবিশ’। এই বাক্যটি নিয়ে একটু বাক বিতণ্ডারও সৃষ্টি হয় এজলাসকক্ষে।
সৈয়দ হায়দার আলী আবার বক্তব্য দিতে উঠে বলেন, ‘রাবিশ’ শব্দটি চয়ন করা উচিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ কোনো সাধারণ ঘটনা নয়, আর এটা কোন ক্রিমিনাল কেইস নয়। ’ এই ধরণের শব্দ যাতে এই এজলাসে উচ্চারণ করা না হয় সেজন্য তিনি ট্রাইব্যুনালের কাছে আবেদন জানান। তিনি বলেন, ‘হাজার হাজার বছর ধরে বাঙালি স্বাধীন ছিল না, আজ বাঙালি স্বাধীন। আর এজন্য অনেক ত্যাগ করতে হয়েছে। সেটা কতোটা তা আমরা জানি না। ’ এ প্রসঙ্গে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের একটি উক্তির কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘রাবিশ’ শব্দটি কোন ভাবেই ঠিক নয়।
তিনি জামায়াতের আইনজীবীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদনটি ভালো করে পড়–ন, দেখুন, ওখানে কি লেখা আছে। ওখানে লেখা আছে, কখন, কতো তারিখে সাঈদী কী করেছেন। ’
তাজুলের বক্তব্যে হৈ চৈ
তাজুল ইসলাম তার ফিরতি বক্তব্যে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। এসময় প্রসিকিউটরার হৈ চৈ করে উঠলে নিজামুল হক নাসিম বলেন, ‘তাকে (তাজুল ইসলাম) বলতে দিন। ’
তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করছি, প্রসিকিউটররা বার বার একটা ইমোশোনাল ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরি করছেন। ’ তিনি বলেন, ‘দিস ইজ কোর্ট। উই আর প্রফেশনালস। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো কথা নেই। কিন্তু এখানে আবেগ দিয়ে কিছু হবে না। আমাদের লিগ্যাল পয়েন্ট দিয়ে কাজ করতে হবে। আবেগের উর্ধ্বে উঠে এই বিচারকাজ কংক্রিট ভাবে সম্পন্ন করতে হবে।
আদালতের আদেশ:
শুনানি শেষে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আটক রাখার নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। ওই দিনে তাকে আদালতে হাজির করারও নির্দেশ দেওয়া হয়।
সাঈদীর জামিন আবেদন নাকচ করে দেন আদালত।
এছাড়া আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সাঈদীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন।
বাংলাদেশ সময় ২০৩৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১০