ঢাকা: হুমকির মুখে পড়েছে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এক দিকে জলবায়ুর পরিবর্তনে লবনাক্ততা বাড়ার ফলে বনের মধ্যে যেমন কমে গেছে মিষ্টি পানির উৎস, তেমনি গত ১০ বছরে বেড়েছে সামুদ্রিক ঝড় ও সাইকোনের সংখ্যা।
এই সব ঝড়ে আসলে বনের কি পরিমান বাঘ বা হরিণ ভেসে যায় তা স্থানীয় বনজীবীরা জানেনা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চোরা শিকারিদের উৎপাত ও লোকালয়ে বাঘের অনধিকার প্রবেশের মতো ঘটনা।
বুধবার বাগেরহাটে কোস্টগার্ড ও বন বিভাগ যৌথ অভিযান চালিয়ে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চারটি মাথা, তিনটি চামড়াসহ বিপুল পরিমাণ হাড়গোড় উদ্ধার করেছে।
এ ঘটনায় সুন্দরবন সংলগ্ন শরণখোলা উপজেলার বাংলাবাজার এলাকা থেকে বাঘশিকারী জামাল ফকিরকেও আটক করা হয়।
এবিষয়ে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের ডিএফও মিহির কুমার দো জানান, আটক জামাল আন্তর্জাতিক পাচারচক্রের সদস্য কিনা তা জিজ্ঞাসাবাদ করে বের করার চেষ্টা চলছে। এ ঘটনায় বন্যপ্রাণী নিধন আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
মানুষের হাতে শিকার হওয়া ছাড়াও প্রতিনিয়ত সুন্দরবনের বাঘ বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঝড় জলোচ্ছাসে ভেসে যায় সমুদ্রের বুকে।
কারণ হিসেবে সিডর পরবর্তী সময়ে সুন্দরবনের বিশাল এলাকায় প্রবেশ করা কারো পক্ষে অসম্ভব ছিল বলে জানিয়েছেন চাদঁপাই-করমজল রেঞ্জের ডেপুটি রেঞ্জার আব্দুর রব।
তিনি বলেন, ‘এসময় বনে বসবাস করাদের প্রায় সবাই সমুদ্রে ভেসে যায়। ’
কী কারণে মরছে বাঘ ?
‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আদি পেশা হারিয়ে বনজীবীরা আগ্রহী হচ্ছে বাঘ শিকারে’ বললেন-আব্দুর রব।
তিনি বলেন, ‘প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আদি পেশা হারিয়ে সুন্দরবনে ক্রমেই বাড়ছে চোরা শিকারীর সংখ্যা। ’ এ জন্য অর্থনৈতিক কারণকেই দায়ী করেন তিনি।
এর প্রমাণ মেলে চোরা শিকারীর শিকার করা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়া আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনির হাতে আটক হওয়ার পরিসংখ্যান থেকেই।
এছাড়া খাবারের অভাবে লোকালয়ে ঢুকে পড়া বাঘ হত্যার ঘটনাও বাড়ছে উদ্বেগ জনক ভাবে। কেবল সরকারি হিসেবেই গত নয় বছরে গণপিটুনিতে সুন্দরবনে বাঘ মারা গেছে ২০টি। বেসরকারি পরিবেশবিদদের মতে তা ৩০ এর কম নয়।
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের সাবেক বন কর্মকর্তা ও সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ অবনি ভুশন জানান, বন বিভাগের লোকেরা যখনই খবর পান কোনো বাঘ লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে তখনই বাঘটিকে নিরাপদে বনে ফিরে যেতে সহায়তা করার জন্য ঘটনাস্থলে ছুটে যান।
‘কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে বাঘটিকে জীবিত পাওয়া যায় না’- বলে জানান তিনি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় মানুষ সব সময়ই নিজেদের প্রাণ রক্ষার প্রস্তুতি আগে থেকেই নিয়ে রাখেন। ’
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণত রাতের বেলায় বাঘ খাবার ও পানীয় জলের সন্ধানে লোকালয়ে ঢুকে পড়লে নিরাপদে বনে ফিরে যেতে পারে। কিন্তু ঘটনা দিনের বেলা ঘটলে তা সম্ভব হয়না।
কারণ হিসেবে তারা জানান, ‘সুন্দরবন প্রাকৃতিক নিয়মেই ক্রমশ উত্তর থেকে দক্ষিণে সরে যাচ্ছে। উত্তর প্রান্তের বন সাধারণত মনুষ্য সৃষ্ট কারণেই উজাড় হচ্ছে। এতে বনের কোল ঘেঁষে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে জনবসতি ও মাছের ঘের। ফলে বাঘ অনেক সময় ভুল করেও লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। ’
গণপিটুনিতে বাঘ মারা যাওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয় বলেই দাবি অবনি ভুশনের। তবে ইদানিং এ অনাকাংখিত ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
খুলনা বনবিভাগের উপ বন কর্মকর্তা জহির উদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘সাধারণত জঙ্গলের পাশের খাল বা নদীর ওপর পাড়ে গবাদি পশু দেখেই বাঘ লোকালয়ে প্রবেশ করে। ’
তাছাড়া বাঘ যেহেতু এক একটি অঞ্চলে একা থাকতে পছন্দ করে, তাই বাচ্চা বড় হওয়ার পর নতুন এলাকার সন্ধানে কখনো বাচ্চা আবার কখনো বাঘিনি বেরিয়ে পড়ে।
আর্ন্তজাতিক পরিবেশ সংরক্ষন ইউনিয়ন, আইইউসিএন এর লাল তালিকা অনুযায়ী পৃথিবীতে বর্তমানে আড়াই হাজার বাঘ আছে। আর বাংলাদেশে এর সংখ্যা মাত্র ২০০। কিন্তু ২০০৪ সালে বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী এ সংখ্যা ৪৪০।
বাংলাদেশের বাঘ বিশেষজ্ঞ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনিরুল ইসলামের মতে, দেশে যে পরিমান বাঘই থাকুকনা কেন, দ্রুত তার সংখ্যা কমছে। এর কারণ হিসেবে তিনি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জলবায়ুর পরিবর্তনকেই দায়ী করেন।
তিনি বলেন, ‘এর প্রভাবে প্রথমত একদিকে বন ধ্বংস হচ্ছে এবং ধ্বংস হওয়া এলাকায় নতুন বসতি গড়ে উঠছে। এতে বনের ওপর নিভর্রশীল মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে বাঘের স্বাভাবিক চলাচলের জায়গা দ্রুত সংকুচিত হচ্ছে। অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার পর হঠাৎ করেই বাঘের লোকালয়ে আসার সংখ্যা বেড়ে গেছে।
এর কারণ হিসেবে তিনি জানান, এ দুর্যোগে নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় জোয়ারের পানি দ্রুত জঙ্গলে প্রবেশ করছে এবং বের হতে পারছেনা। ফলে বনের মিষ্টি পানির পুকুরগুলো নোনা পানিতে ভরে যাওয়ায় বাঘ মিষ্টি পানির আশায় লোকালয়ে প্রবেশ করে।
সুন্দরবনে বাঘ শিকার
শরনখোলা রেঞ্জের এক বন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সুন্দরবনে বাঘসহ অন্যান্য প্রাণী শিকার বেড়েছে।
তিনি বলেন, আগে সুন্দরবনে প্রচুর পরিমানে মাছ পাওয়া যেতো। এখন লবনাক্ততার কারণে সে অবস্থার পরিবর্তন এসেছে। মাছ ধরা ছেড়ে মাঝিরা চোরা শিকারি হচ্ছে। লবনাক্তার কারণে গোলপাতা ও গরান বন ধ্বংসের পথে, ফলে বাওয়ালীরাও মাঝিদের পথ অনুসরন করছে।
আর্ন্তজাতিক বাজারে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়ার চড়া মূল্য থাকায় এখন চোরা শিকারিদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে সুন্দরবনের বাঘ। ১৯৮০ সাল থেকে বাঘের চামড়া উদ্ধার শুরু হওয়ার পরই বোঝা যায় এর চাহিদা আকাশচুম্বি। ২০০৪ সাল পর্যন্ত বন বিভাগ ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কছে ধরা পড়েছে শতাধিক বাঘের চামড়া।
খুলনা বিভাগীয় উপবন কর্মকর্তা জহির উদ্দিন আহমেদ আশঙ্কা করেন, ‘সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জ সংলগ্ন গ্রামগুলোতে একাধিক সংঘবদ্ধ বাঘ শিকারী দল রয়েছে। ’
স্থানীয় সূত্র জানায়, এদের অবস্থান বরগুনা জেলার পাথরঘাটার চরদুয়ানী, সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বাগেরহাট জেলার শরনখোলা, রামপাল, মোংলা, মোরেলগঞ্জ, পশ্চিম বিভাগের সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি, শ্যামনগর, কালিগঞ্জ, খুলনা জেলার পাইকগাছা, দাকোপ ও কয়রা উপজেলায়।
বাঘ শিকারীরা জেলে সেজে বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে বনে যায়। এরপর খাদ্যে বিষ মিশিয়ে, ফাঁদ পেতে, বন্দুক দিয়ে গুলি করে বাঘ হত্যা ঘরে। বাঘ শিকারিরা বাঘ হত্যার পর স্থানীয় পদ্ধতিতেই বাঘের চামড়া সংরক্ষণ করে। পরে তা পাচারকারী চক্রের সাহায্যে বিদেশে পাচার হয়। স্থানীয়ভাবে একটি চামড়ার জন্য শিকারিরা দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা পেলেও বিদেশে একটি চামড়া ১০ লাখ টাকায় বিক্রি হয়।
২০০৪ সালের ২৫ আগস্ট বরগুনা জেলার পাথরঘাটা নলী গ্রামের বেলায়েত তালুকদারের বাড়ি থেকে নয় ফুট এক ইঞ্চি লম্বা ও তিন ফুট চওড়া একটি রয়েল বেঙ্গল বাঘের চামড়া আটক করা হয়। চামড়াটিতে কমপক্ষে পাচঁটি গুলির দাগ ছিল।
ওই বছরই পুলিশ সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের শরনখোলা উপজেলার রাজৈর গ্রাম থেকে বাঘ ও হরিণ পাচার দলের নেতা আব্দুল মতিন গাজীকে হরিণের শিং ও অন্যান্য প্রানীর অঙ্গ প্রতঙ্গসহ আটক করে। সে সময় ২টি বাঘ ও ১৩টি হরিণের চামড়াসহ তার সহযোগিরা পালিয়ে যায়।
২০০২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর চাঁদপাই রেঞ্জের জংড়ায় শিকারি ও বনরক্ষীদের বন্দুকযুদ্ধের পর বনরক্ষীরা একটি মৃত বাঘ উদ্ধার করে। একই বছর ২৭ জুলাই সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার গাগরামারী খেয়াঘাট থেকে একটি বাঘের চামড়া উদ্ধার করে বনবিভাগ। একই দিন কালিগঞ্জের সোতপুর সেতুর নিকট থেকে বিডিআর সদস্যরা ১২টি বাঘের চামড়া উদ্ধার করে।
২০০০ সালের পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার মাছুয়া, ১৯৯৯ সালের ২০ জুলাই সাতক্ষীরা এবং ১৭ আগস্ট সাতক্ষীরা থেকে ঢাকাগামী বাস থেকে বিডিআর সদস্যরা একটি করে বাঘের চামড়া উদ্ধার করে।
বনরক্ষীরা ১৯৯৮ সালের ৩০ জুলাই সুন্দরবন সংলগ্ন খোলপেটুয়া নদী থেকে চারটি, ১৯৯৪ সালের ৭ নভেম্বর শরনখোলা উপজেলার সাউথখালি ইউনিয়নের বগি গ্রাম থেকে একটি, ৯ নভেম্বর ইছামতি নদী থেকে তিনটি বাঘের চামড়া উদ্ধার করা হয়।
১৯৯১ সালের জুলাই মাসে যশোর থেকে ঢাকাগামী বাস থেকে চারটি বাঘের চামড়া উদ্ধার করা হয়। ১৯৯২ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকার গাবতলি বাসস্ট্যান্ড থেকে ১০টি এবং একই মাসে যশোর থেকে ঢাকাগামী বাস থেকে আরো একটি বাঘের চামড়া উদ্ধার করা হয়।
বিগত ১৮ বছরে প্রায় শতাধিক বাঘের চামড়া আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বন বিভাগের হাতে আটক হয়েছে। কিন্তু পাচারকারী দলের নেতারা সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।
স্থানীয় সূত্রমতে আর্ন্তজাতিক পাচারকারীরা ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে তাদের নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে। এদের সেকেন্ড ইন কমান্ডরা থাকে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও বরিশালে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে বসে এ সকল চামড়ার হাট।
পরিবেশবাদিদের মতে ১৯৭৫ সালের পর সুন্দরবনে আর বাঘ বাড়েনি। কিন্তু প্রাকৃতিক কারণে মারা গেছে বছরে প্রায় দুইটি করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। চোরা শিকারিদের হাতে বছরে মারা পড়ে প্রায় ১০টি বাঘ। কিন্তু বন বিভাগ এ সংখ্যা তিন থেকে চারটি বলে জানিয়েছে।
বাঘ নিয়ে কাজ করে খুলনার এমন একটি সেচ্ছাসেবী সংগঠন তাদের নিবন্ধে উল্লেখ করে, ১৯৮১ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত বিভিন্নভাবে সুন্দরবনের ১২০টি বাঘ হত্যা হয়েছে। বন বিভাগের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৮১ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত ৫৩ টি বাঘ শিকার করা হয়েছে। ১৯৮১, ৮২, ৮৪, ৮৫, ৮৭ ও ১৯৯৫ সালে কোন বাঘ শিকার হয়নি।
১৯৮৩ সালে তিনটি, ১৯৮৬ সালে ২টি, ১৯৮৮ সালে ১টি, ১৯৯০ সালে ২টি, ১৯৯১ সালে ৪টি, ১৯৯২ সালে ১টি, ১৯৯৩ সালে ৪টি, ১৯৯৪ সালে ২টি, ১৯৯৬ সালে ৫টি, ১৯৯৭ সালে ৮টি, ১৯৯৮ সালে ২টি, ১৯৯৯ সালে ৪টি, ২০০০ সালে ৫টি, ২০০১ সালে ১টি, ২০০২ সালে ৩টি, ২০০২ সালে ৩টি, ২০০৪ সালে ৪টি, ২০০৫ সালে ৬টি, ২০০৭ সালে ৪টি বাঘ প্রাণ হারিয়েছে। ১৯৯৭ সালে সবচেয়ে বেশি ৮টি বাঘ প্রাণ হারায়। বাঘ বেশি হত্যা হয় চাঁদপাই রেঞ্জে।
বাংলাদেশ সময়: ২০২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১১