ঢাকা, বুধবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

বাংলাদেশকে সতর্ক করতে ১৩ তম সার্ক সম্মেলনে যোগ দেয়নি ভারত

ইসমাইল হোসেন, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৪২ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০১১
বাংলাদেশকে সতর্ক করতে ১৩ তম সার্ক সম্মেলনে যোগ দেয়নি ভারত

নয়াদিল্লী: বাংলাদেশকে একটি সতর্ক বার্তা দেওয়ার জন্য ২০০৫ সালের দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) ১৩ তম শীর্ষ সস্মেলনে যোগ দেয়নি ভারত। একটি সদস্য রাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে সম্মেলন না হওয়ার বিধান থাকায় ফেব্রুয়ারীর সে সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছিল।

 

মঙ্গলবার ভারতের দ্য হিন্দু’র অনলাইন সংষ্করণে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ খবর দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে ব্যতিক্রমী গণমাধ্যম উইকিলিকসের মাধ্যমে পাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি গোপন কূটনৈতিক বার্তা থেকে নিরুপমা সুব্রাহ্মানিয়ান প্রতিবেদনটি তৈরী করেছেন।

২০০৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক তারানজিত সাঁধুর সঙ্গে ভারতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের এক কর্মকর্তার আলাপের সূত্র ধরে ওয়াশিংটনকে পাঠানো এক গোপন কূটনৈতিক বার্তায় এ তথ্য জানানো হয়।

১০ ফেব্রুয়ারী দূতাবাসের ওই কর্মকর্তা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের বড়ভাই সুলভ ওই সিদ্ধান্তের কথা ওয়াশিংটনকে জানান। ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারির ৬ থেকে ৭ তারিখ- এই দুই দিনব্যাপী সার্কের ওই সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সম্মেলনে যোগদান না করার দুটি কারণ দেখায় যুক্তরাষ্ট্রকে। প্রথমটি হচ্ছে, নেপালের রাজা কর্তৃক নেপালে জরুরি অবস্থা ঘোষণা।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ২০০৪ সালে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলাসহ আরো বেশ কয়েকটি বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলা এবং বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলার সার্বিক অবনতি। সার্ক সম্মেলনের মাত্র কয়েকদিন আগেই ২৭ জানুয়ারী হবিগঞ্জে এক সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় মারা যান আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া

স্থগিত হওয়া সার্কের শীর্ষ সম্মেলন পরে ২০০৫ সালের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হয়। তবে প্রথমবার সম্মেলনে যোগদান না করার কারণে ভারতের সঙ্গে তৎকালীন ক্ষমতাসীন চারদলীয় জোট সরকারের সম্পর্কের দীর্ঘস্থায়ী অবনতি হয়। সার্কের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেও এ নিয়ে বাড়তে থাকে তিক্ততা।

কূটনৈতিক বার্তায় জানানো হয়, ভারত সরকার সার্ক সম্মেলনে যোগদান না করার কারণ হিসেবে কখনো কোনো ব্যাখা দেয়নি এবং দুঃখও প্রকাশ করেনি। এতে বাংলাদেশ সরকার অসন্তুষ্ট হয়েছে। ভারত সরকারের দিকে থেকে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগও দেখা যায়নি। এর কারণ হিসেবে কূটনৈতিক বার্তায় বলা হয়, ভারত সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশকে একটা সতর্ক বার্তা দেওয়া।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা সাঁধু জানান, বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা এবং ভারত-বিরোধী মনোভাবের কারণেই ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে চাপে রাখার দরকার হয়েছিল।

সাঁধু যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান সার্কের শীর্ষ সম্মেলনে যোগ না দেয়ার নয়াদিল্লীর সিদ্ধান্তের বিষয়টি তারা যেন গুরুত্বের সঙ্গে দেখে। বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী এবং প্রবীণ রাজনীতিবিদদের ভারতবিরোধী বক্তব্যের একটা তালিকাও তিনি দূতাবাস কর্মকর্তার হাতে তুলে দেন। এই প্রসঙ্গে সাঁধূ যুক্তরাষ্টেকে জানান, এটা সার্কের প্রেরণা হতে পারে না।

সাঁধূ বলেন বাংলাদেশের প্রতি ভারতের এই বার্তা নেতিবাচক বার্তা নয়। বরং এই বার্তার মাধ্যমে বাংলাদেশকে কিছু কিছু বিষয়ে আরো চিন্তা করার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। ভারত চেয়েছে বাংলাদেশ বুঝুক- কিছু বিষয়ে ব্যবস্থা না নিলে কি রকম বিপদ হতে পারে।

বার্তায় আরো জানানো হয়, বাংলাদেশের ইসলামী গ্রুপগুলো খালেদা জিয়ার পুরো শাসনামলেই ভারতের উদ্বেগের কারণ ছিল। তার ভাষায় ওই সময়টাতে ইসলামী গ্রুপগুলোর উন্মুক্ত চারনক্ষেত্রে পরিনত হয়েছে বাংলাদেশ। এটা ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকির কারণ মনে করেছে তারা।

ভারত সন্দেহ করতো ইসলামী গ্রুপগুলোর পেছনে পাকিস্তানি সহায়তা রয়েছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের উপর যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে চাপ তৈরী করতে নয়াদিল্লী সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল।
বাংলাদেশে ধীরে ধীরে তালিবানিস্তান কায়েম হচ্ছে-ভারতের এমন দাবির পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র বারবার প্রমান চাইলে সাঁধু বলেন বাংলাদেশে কি হচ্ছে এটা একটা মূর্খও বুঝতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের ওই কূটনৈতিক যখন বললেন শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যাকা- তদন্তে এফবিআই’র তদন্ত কর্মকর্তা বাংলাদেশে যাচ্ছেন। তখন সাঁধু যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত কর্মকর্তার সক্ষমতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন।

সার্ক সম্মেলনে যোগ না দেয়ায় বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে- যুক্তরাষ্ট্রের এমন ধরনের মূল্যায়নের ব্যাপারে সাঁধু দ্বিমত পোষন করেন। গ্যাস পাইপ লাইন নিয়ে আলোচনা চলছে জানিয়ে তিনি বলেন অর্থনৈতিক সম্পর্কে তেমন প্রভাব পড়বে না। কিন্তু ভারত চায় বাংলাদেশ যাতে ভারতের রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তার বিষয়গুলোর দিকে নজর দেয়।

তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের স্বার্থে ভারত সার্ক সম্মেলনে যোগ দেয়নি- যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিকের এমন সমালোচনা প্রত্যাখান করে সাঁধু বলেন, সম্মেলনে যোগ না দেয়ার সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। ভারতকে ওভাবে দেখা উচিত নয়। বাংলাদেশে যা হচ্ছে- সে বিষয়ে কারও না কারও মনোযোগ আকর্ষণ করাতে হবে।

বার্তায় আরো বলা হয়, ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত হেমায়েত উদ্দিন ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের উপ-রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে একদিন দুপুরের খাবারের সময় সার্ক সম্মেলনে ভারতের যোগ না দেয়া নিয়ে তাঁর হতাশা এবং ক্ষোভের কথা জানান।

তিনি জানান, বাংলাদেশকে আগে থেকে কিছু না জানিয়ে ভারত ২ ফেব্রুয়ারী ঘোষণা দেয় যে তারা সম্মেলনে যোগ দিচ্ছে না।

বার্তায় আরো বলা হয়, ক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু ইতিবাচক উন্নতির কথাও উল্লেখ করেন। একটি স্টীল কারখানার প্রকল্পে টাটা গ্রুপের ২ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের কথা তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। যদিও পরে ২০০৬ সালে টাটার ওই প্রকল্পটি বাতিল করা হয়।

২০০৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারী, ঢাকায় যুক্তরাষ্টের দূতাবাস থেকে পাঠানো পৃথক আরেকটি কূটনৈতিক বার্তায়ও ভারতের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বাংলাদেশের ক্ষোভের কথা জানানো হয়। দূতাবাস কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার সময় মন্ত্রীসভার সদস্যরা বলেন এর আগে পাকিস্তানে এবং নেপালে সার্ক সম্মেলন হওয়ার সময় সেখানকার অবস্থার খারাপ ছিল। কিন্তু তখন ভারত সার্ক সম্মেলনে যোগ দিয়েছে।

২০০৫ সালের ১৩ এপ্রিল পাঠানো আরেকটি গোপন কূটনৈতিক বার্তায় বলা হয়, বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের উত্থাপিত অভিযোগগুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা আনতে ভারতের নিরন্তর চেষ্টায় কিছুটা হলেও কাজ দিয়েছে। সেসময় সফররত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপ-সহকারী সচিব জন গ্যাস্টরাইট ভারতের পররাষ্ট মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নীলাম দেওকে বলেন ভারতের তাড়ার ফলেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পরিস্থিতির দিকে সতর্ক নজর রাখছে।

গ্যাস্টরাইট নীলামা দেওকে জানান বাংলাদেশ ইতিমধ্যে লক্ষ্য করেছে যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সুশাসন প্রতিষ্ঠার উপর জোর দিচ্ছে। দেশটি সম্প্রতি দাতাসংস্থাগুলোর পরামর্শ মোতাবেক কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে।

তিনি আরো বলেন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী সচিব ক্রিস্টিনা রোকার আসন্ন সফরের সময় বাংলাদেশ যাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আরো কাজ করে সেজন্য কঠিন শর্ত দিতে হবে।

নীলাম দেও গ্যাস্টরাইটকে জানান শুধুমাত্র গ্রেনেড হামলার বিষয়টিই সার্ক সম্মেলনে যোগ না দেওয়ার পেছনে মূল কারণ নয়। দুই দেশের মধ্যে প্রকৃত অর্থেই অবন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক তৈরী হয়েছে। তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী টাটার প্রকল্পটি দেখছেন। এটা নিয়েও নীলাম দেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

নীলাম দেও সবশেষে দিল্লীর দীর্ঘদিনের দাবি পূনর্ব্যক্ত করে বলেন, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বাংলাদেশে সক্রিয় রয়েছে।

বাংলাদে সময়: ০৩১৬ ঘন্টা, মার্চ ৩০, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।