ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

গারো পাহাড়ের আদিবাসী গ্রামে উলফা নেতার নির্যাতন-বিভীষিকা

সাঈদুর রহমান রিমন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১২৬ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১০



[ভারতের আসাম রাজ্যের নিষিদ্ধ-ঘোষিত-বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠন উলফা বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার গারো পাহাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে একের পর এক ঘাঁটি গড়ে ত্রাসের রাজত্ব গড়েছে। তাদের গড়া এ ঘাঁটিগুলোর এক একটি  রীতিমতো অস্ত্রাগার।

একে-৪৭, উজি গান, রকেট লঞ্চার, আর্জেস গ্রেনেডসহ বিপজ্জনক নানা অস্ত্র ও গোলাবারুদে ঠাসা এসব ঘাঁটি। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডির সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট সাঈদুর রহমান রিমন দীর্ঘ এক পক্ষকাল গারো পাহাড়ের নানা দুর্গম এলাকা ঘুরে তুলে  এনেছেন উলফার অনেক অজানা তথ্য, অনেক বিভীষিকাময় কাহিনী।   ৫ কিস্তিতে পড়ুন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। আজ তৃতীয় কিস্তি ]

২০০৪ সালে মাঝামাঝিতে গারো পাহাড়ে ভারতের নিষিদ্ধ-ঘোষিত উলফা জঙ্গিদের ঘাঁটি থেকে ৬৮টি আর্জেস গ্রেনেড খোয়া যায়। উলফা নেতারা এজন্য স্থানীয় আদিবাসী যুবকদের দায়ী করেন। গ্রেনেড উদ্ধারের জন্য গজনী এলাকার কয়েকটি গ্রামের আদিবাসী নেতাদের নিয়ে উলফা নেতারা বৈঠকে করেন। গ্রেনেডগুলো ফিরিয়ে না দিলে পুরো এলাকা ছাড়খার করে দেওয়া হবে বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন উলফা কমাণ্ডার রঞ্জন চৌধুরী।

গ্রেনেড চুরির অভিযোগে উলফা কমান্ডাররা বড় গজনী  ও নামাপাড়ার স্যামুয়েল মাংসাং, বিপুল কুবির পরিবারসহ কয়েকটি পরিবারকে এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেন।   গত ৬ বছরেও বাঁকাকুড়ায় নিজ গ্রামে ফিরতে পারেননি তারা। এছাড়াও অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হন গ্রামের অনেকেই। রঞ্জন চৌধুরী ও তার বাহিনীর লোকদের নির্যাতনের শিকার গ্রামবাসী সেসব কথা মনে করে এখনও আঁতকে ওঠেন।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডি’র অনুসন্ধানকালে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কথিত গ্রেনেড চোরদের সন্ধানে শতাধিক উলফা সদস্য গজনী, বাঁকাকুড়া, দুধনই, নামাপাড়াসহ ৬/৭টি পাহাড়ি গ্রামে শুরু করে সীমাহীন তান্ডব। তারা রাত-দিন বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালায়। নিছক সন্দেহের বশে যাকে তাকে ক্যাম্পে নিয়ে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন চালাতে থাকে। বড় গজনীর কলেজ ছাত্রী প্রতিমা কুবি থেকে শুরু করে ফ্রেজিনা কুবি’র মতো বয়স্ক নারীও রঞ্জন চৌধুরী ও তার বাহিনীর নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি।

সে সময় বাঁকাকুড়া গ্রামের হাসেন দালবৎ এর ছেলে দিনাল চাম্বুগং (২৬), ছোট গজনী গ্রামের সামুয়েল মাংসাং এর ছেলে রুপন কুবি (২৩), টিলাপাড়া গ্রামের পরিমল কুবি’র ছেলে নিপিন দফো (২৭), ওয়ালেম সাংমা (৩২), বিপুল কুবি (২৮), ছোট গজনীর গারো হেডম্যান প্রভাত কুবি (৪৫), প্রফুল্ল কুবি (৩৫), নামাপাড়া গ্রামের আমরুশ চাম্বুগং (৩৮), মাইকেল দফো (২৮), দুধনই গ্রামের মজম আলী (৩০), বাঁকাকুড়া শনিবারিয়া মিশন স্কুলের শিক দিলীস ম্রং (৩৪), ছোট গজনী নামাপাড়া গ্রামের জানেন্দ্র চাম্বুগং এর ছেলে ক্যাপ্টিন মানখিন (২৬), সুধীর সাংমা (২৭) সহ ২০/২২ জন গ্রামবাসীকে উলফারা গ্রেনেড চোর হিসেবে ৮/১০ দিন পর্যন্ত ক্যাম্পে আট্কে রাখে। তাদের উপর চালায় অমানবিক নির্যাতন। আতঙ্কে পুরো এলাকা যুবকশূন্য হয়ে পড়ে। আগস্টের শেষ সপ্তাহ ও সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে চলে রঞ্জু চৌধুরীর বিভীষিকা।

উলফার গ্রেনেড চুরি নিয়ে যা ঘটেছিল


গ্রেনেড চুরির অভিযোগ তুলে ছোট গজনীর বাড়ি থেকে মাঝরাতে ধরে বাঁকাকুড়ায় উলফা ক্যাম্পে নিয়ে টানা চারদিন নির্যাতন চালানো হয় বিপুল কুবি (২৮)’র উপর। এক সপ্তাহের মধ্যে যে করেই হোক গ্রেনেডগুলো উদ্ধার  করে দেবে বলে ছাড়া পেয়ে গ্রাম থেকে পালিয়ে যান তিনি।


বিপুল কুবি’র পিতার নাম স্যামুয়েল মাংসাং। উলফা কমান্ডার রঞ্জন চৌধুরীর ভয়ে গত প্রায় ৬ বছর ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বিপুল। নিজের গ্রাম থেকে প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার দূরে মধুপুর গড় এলাকায় আত্মগোপনে থাকা বিপুল কুবি গ্রেনেড চুরি ও উলফা নির্যাতনের বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরেন।


বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডি কে বিপুল কুবি বলেন, ‘তারিখটি ঠিক মনে নেই, তবে ১৪ কি ১৫ আগস্ট হঠাৎই করেই বাঁকাকুড়া ও গজনী ক্যাম্পের উলফা সদস্যরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। অস্ত্রশস্ত্র কাঁধে ঝুলিয়ে দিনের বেলাতেই তারা বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালাতে থাকে। আমাকে ডেকে তারা তাদের ক্যাম্প সংলগ্ন বড়ই গাছতলায় নিয়ে জানায়, সেখানে মাটির নিচে পুঁতে রাখা অনেক হাই পাওয়ার আর্জেস গ্রেনেড চুরি হয়ে গেছে। ’ এলাকার কে বা কারা এ গ্রেনেড চুরি করেছে তার খোঁজ বের করার দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে।


এরপর বিপুল গ্রামের কয়েকজন যুবককে নানা প্রলোভন দিয়েও গ্রেনেডের হদিস জানার চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন। একপর্যায়ে উলফার কাছ থেকে নগদ টাকা নিয়ে তিনি আরো ক’জন যুবকের কাছে অস্ত্র ও গ্রেনেড কেনার টোপ দেন। এর দু’দিন পরই রাত সাড়ে ১১ টার দিকে একটি বড় বস্তা মাথায় নিয়ে বিপুলদের বাড়ি সংলগ্ন জঙ্গলে হাজির হয় পাশের গ্রামের নিপিন দফো ও দিনাল চাম্বুগং নামে দু’ যুবক। কিছুণ পরে সেখানে যায় টিলাপাড়ার বাসিন্দা ওয়ালেম সাংমা। তারা বস্তা খুলে একটি একটি করে গ্রেনেড বের করে দেখায় এবং প্রতিটি গ্রেনেডের দাম হাঁকে ১’শ টাকা করে। তারা গ্রেনেডগুলোকে ভারতে তৈরি শক্তিশালী বোমা বলে জানায়। বিপুল প্রতিটি গ্রেনেডের দাম ৮৫ টাকা করে মিটিয়ে দিনালের হাতে এক হাজার টাকা অগ্রিম তুলে দেন।

বিপুল কুবি দাবি করেন, গ্রেনেডগুলোর ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পরই তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। এরপর আর গ্রেনেড কেনায় আর কোনো আগ্রহ দেখাননি বিপুল। বরং গ্রেনেডভর্তি বস্তা জঙ্গলে ফেলে দিয়ে দিনাল ও নিপিনকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। এ খবর ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়। পরদিনই রঞ্জন চৌধুরীর লোকেরা এসে চড়াও হয় টিলাপাড়া গ্রামের ওয়ালেম সাংমার বাড়িতে। ওয়ালেম সাংমা ও তার সহযোগী দুধনই গ্রামের মজম আলীকে উলফারা বাঁকাকুড়া ক্যাম্পে নিয়ে রাতভর নির্যাতন চালায়।


বিপুল আরো জানান, অকথ্য নির্যাতনের মুখে ওয়ালেম গ্রেনেডের ব্যাপারে স্বীকারোক্তি দেয়। উলফা সদস্যদের সাথে নিয়ে ওয়ালেম তার বাড়ির টিউবওয়েলের পাড় খুঁড়ে তিনটি গ্রেনেড তুলে দিয়ে জানায়, বাকিগুলো নিপিন ও দিনালের কাছে আছে। ওয়ালেম সাংমা’র দেয়া তথ্য অনুযায়ী উলফা সদস্যরা একে একে আরো অনেক  যুবককে আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে অত্যাচার চালাতে থাকে।


এরপর কয়েকদিন উলফার অত্যাচার-নির্যাতন বন্ধ থাকে। কিন্তু চুরি যাওয়া গ্রেনেড অন্যত্র পাচার হয়ে গেছে এমন খবর পেয়ে উলফা নেতারা আবারও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তারা আবারও শুরু করেন বাড়িবাড়ি তল্লাশি। চুরি যাওয়া গ্রেনেড অন্যত্র পাচারের অভিযোগ তুলে তারা দিনাল, নিপিন, রুপন কুবিকে ২৩ আগস্ট রাতে অস্ত্রের মুখে ধরে নিয়ে যান। বিপুলকে না পেয়ে তার মা ফ্রেজিনা কুবি ও ছোট বোন কলেজপড়–য়া প্রতিমা কুবিকে রাতের আঁধারে ধরে বাঁকাকুড়া ক্যাম্পে নিয়ে আট্কে রাখেন তারা। সেখানে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয় বলে ফ্রেজিনা কুবি অভিযোগ করেন। তারপর একে একে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ওয়ালেম সাংমা (৩২), প্রভাত কুবি (৪৫), আমরুশ চাম্বুগং (৩৮), মাইকেল দফো (২৮), প্রফুল্ল কুবি (৩৫), মজম আলী (৩০), সুধীর সাংমা (২৭) স্কুলশিক দিলীস ম্রং (৩৪), ক্যাপ্টেন মানখিন (২৬)সহ ২০/২২ জনকে। তাদের কয়েকজনকে একটানা ১০/১২ দিন পর্যন্ত ক্যাম্পে বেঁধে নির্যাতন চালানোর অভিযোগ রয়েছে।


ওই সময় বারোমারী খ্রিস্টান মিশনের ফাদার যোশেফ এর মধ্যস্থতায় গ্রামবাসীরা উলফার কবল থেকে উদ্ধার  পেলেও স্যামুয়েল মাংসাং-ফ্রেজিনা কুবিসহ কয়েকটি পরিবারকে গ্রামছাড়া করে উলফা। এসব বিষয় বিস্তারিত উল্লেখ করে গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে শেরপুরের তৎকালনি পুলিশ সুপার নীবাস চন্দ্র মাঝি’র কাছে লিখিত অভিযোগ করেও সুরাহা পাননি বলে তারা অভিযোগ করেন। পরে পত্র-পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর উলফা দমনে কিছু প্রশাসনিক উদ্যোগ নেওয়া হয়। গজনী চৌরাস্তা মোড়ে বসানো হয় পুলিশ ক্যাম্প। বাড়ানো হয় বিডিআর এর টহল চৌকি। র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার ঘন ঘন অভিযানের মুখে রঞ্জন চৌধুরী ও তার অস্ত্রবাজ ক্যাডাররা সীমান্ত ডিঙ্গিয়ে মেঘালয়ের জঙ্গলে আস্তানা স্থানান্তর করতে বাধ্য হয়। কিন্তু অভিযান ঝিমিয়ে যেতেই কয়েক মাসের মধ্যেই রঞ্জন চৌধুরী আবারও গজনী-বাঁকাকুড়ার পুরনো ক্যাম্পে ফিরে এসে সদলবলে অবস্থান নেন।
উলফার সশস্ত্র অবস্থানের কারণে নিজ গ্রামের ভিটেমাটিতে আর ফিরে যেতে পারেননি বিপুল কুবি, স্যামুয়েল মাংসাং, ইলিয়াস ম্রং, দাজেল মারাক, মৃণাল চাম্বুগংসহ আটটি পরিবারের সদস্যরা। তাদের ভিটেতে এখন ঘুঘু চড়ছে। অথচ তারা এখন অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছেন।


ফ্রিজেন কুবি এখন মধুপুরের কালিয়াকুড়ি গ্রামের এক বাড়িতে আশ্রিত। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডি কে তিনি বলেন, ‘ছোট গজনী গ্রামে তিনটি চৌচালা টিনের ঘর আর আট বিঘা ফসলি জমি থাকা সত্ত্বেও আজ আমি অন্যের বাড়িতে কামলা খেটে জীবন বাঁচাই। ’ সরকার ও প্রশাসনের কাছে বিপন্ন আদিবাসী এই নারীর প্রশ্ন: ‘স্বাধীন দেশে ভিনদেশী সন্ত্রাসীদের কারণে কেন আমাদের ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াতে হবে?’ ফ্রিজেন কুবি অবিলম্বে নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়ার নিরাপদ ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন।


বাঁকাকুড়া গ্রামের সম্ভ্রান্ত আদিবাসী পরিবারের সদস্য ইলিয়াস ম্রং জানান, উলফার (উলফা) অবাধ বিচরণ, সামাজিক কর্তৃত্ব ও দাপটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কারণেই জীবনতার দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। ৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিজের বাড়িঘরে ফিরতে পারছেন না ইলিয়াস ম্রং। তিনি বলেন, ‘অস্ত্রবাজ উলফা কমান্ডারদের কারণে বাবা-মা, ভাই- বোনদের খোঁজ খবরটা পর্যন্ত নিতে পারি না। আর কত দিন এ যন্ত্রণা বইতে হবে বলতে পারেন?’

 

বাংলাদেশ সময় ১০১৩ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।