ঢাকা : সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব চূড়ান্ত করা নিয়ে চাপের মধ্যে আছে বিশেষ কমিটি। বিশেষ করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, বিসমিল্লাহ এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রাখার বিষয়টি নিয়ে কমিটির ভেতরে-বাইরে মতপার্থক্য ও বিরোধিতা রয়েছে।
প্রধান দুই শরিক আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, বিসমিল্লাহ ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রাখার পক্ষে। তবে মহাজোটের অন্য শরিক দলগুলোর এ ব্যাপারে রয়েছে ঘোর আপত্তি।
সংবিধান সংশোধন বিশেষ কমিটিতে মহাজোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের দুই সদস্য সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও বিসমিল্লাহ বাদ দেওয়ার ও ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিশেষ কমিটির আলোচনার সময়ও মহাজোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, ন্যাপ এবং গণতন্ত্রী পার্টি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও বিসমিল্লাহ বাদ দেওয়ার ও ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করেছে। তাদের প্রস্তাব মানা না হলে সংবিধান সংশোধন কমিটির প্রস্তাব চূড়ান্ত করার সময় কমিটির দুই সদস্য নোট অব ডিসেন্ট দেবেন বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।
অন্যদিকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, বিসমিল্লাহ এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বহাল রাখার প্রস্তাব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। তাদের দেওয়া প্রস্তাব অনুযায়ীই কমিটি তাদের সংশোধন প্রস্তাব তৈরি করতে যাচ্ছে বলে কমিটির একাধিক সদস্য বাংলানিউজকে জানিয়েছেন।
দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিশেষ কমিটিতে মতামত দেয়ার সময় এ বিষয়গুলো বহাল রাখতে বলেছে। এগুলো বহাল রাখার ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে মহাজোটের আরেক শরিক জাতীয় পার্টি।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি কমিটিতে না আসেনি এবং কমিটির কাছে তাদের দলের মতামত দেয়নি। তবে তারা সভাসমিতি, টক শো সহ বিভিন্ন ফোরামে বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বহাল রাখার জোর দাবি জানিয়ে আসছে তারা। এ তিন স্পর্শকাতর বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের মৌলিক মতপার্থক্য না থাকলেও খোদ মহাজোটের শরিকদের সঙ্গেই আওয়ামী লীগের দ্বিমত থেকে যাচ্ছে।
এছাড়াও বিশেষ কমিটির আমন্ত্রণে সাবেক প্রধান বিচারপতি, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, বিশিষ্ট নাগরিক এবং জাতীয় পত্রিকার সম্পাদকদের অধিকাংশই সংবিধানে বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রাখার ঘোর আপত্তি জানিয়েছেন। এদের অনেকেই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে সমর্থন সহযোগিতা দিয়ে আসছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের এই অবস্থান মানতে পারছেন না তারা। এমনকি আওয়ামী লীগের সুহৃদ বলে পরিচিত ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতা শাহরিয়ার কবির তো ‘আওয়ামী লীগ জাতির সাথে বেঈমানি করছে’ বলে সাংবাদিকদের কাছে উষ্মা প্রকাশ করেছেন।
এছাড়া সংসদের বাইরে থাকা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিও (সিপিবি) এ ব্যাপারে কমিটির কাছে দেওয়া লিখিত প্রস্তাবে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, বিসমিল্লাহ বাদ দিতে এবং ধর্শভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে।
এই সকল রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিজীবীর মতে, ধর্মীয় এই বিষয়গুলো বহাল রাখা হলে তা হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের এক নেতা (কমিটির সদস্য) বাংলানিউজকে বলেন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, বিসমিল্লাহ, ধর্মীয় রাজনৈতিক দল ৭২ এর সংবিধানের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ হলেও ধর্মীয় স্পর্শকাতর হওয়ায় এই বিষয়গুলোতে কোনোভাবেই হাত দেবে না আওয়ামী লীগ।
কমিটিতে না এলেও বিষয়গুলো নিয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির যেন কোনো ইস্যু তৈরি করতে না পারে সে ব্যাপারে আওয়ামী লীগ বেশ সতর্ক অবস্থানে।
এ অবস্থার মধ্যেই প্রস্তাব চূড়ান্ত করার দুরূহ কাজটি করতে যাচ্ছে সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটি। চূড়ান্ত প্রস্তাবটি সংসদের আগামী অধিবেশনেই উপস্থাপন করার সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী ২২মে সংসদের পরবর্তী অধিবেশন আহ্বান করা হয়েছে।
বিশেষ কমিটির কাছে দেওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও শ্রেণী পেশার প্রতিনিধিদের দেওয়া মতামতগুলো পর্যালোচনা ও সমন্বয়ের কাছ চলছে। কয়েক দিনের মধ্যে কমিটি বৈঠকে বসে তাদের প্রস্তাব চূড়ান্ত করবে।
এ বিষয়ে বিশেষ কমিটির সদস্য, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বাংলানিউজকে বলেন, ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, বিসমিল্লাহ, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বাদ দেয়ার কথা কমিটিতে বলেছি। কমিটি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে এই বিষয়গুলো বহাল রাখা হলে কমিটির সদস্য হিসেবে আপত্তি (নোট অব ডিসেন্ট) জানাবো।
বিশেষ কমিটির অপর সদস্য জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘সকলের মতামতগুলোর সমন্বিত রূপ ৫/৬ দিনের মধ্যে কমিটিতে আসবে। এরপর কমিটি চূড়ান্ত প্রস্তাব তৈরি করবে। এইগুলো সংবিধানে রেখে রাজনৈতিক অনুমোদন দেওয়া ঠিক হবে না। এতে ধর্মের রাজনীতিকিকরণ এবং রাজনীতিকে সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হবে। সংবিধানে এগুলো রাখা হলে আপত্তি (নোট অব ডিসেন্ট) জানাবো। ’
এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বিশেষ কমিটির কো-চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কোনও মন্তব্য করতে চাননি। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘দেখা যাক কী হয়! এই সময়ের মধ্যেই আমরা প্রস্তাব চূড়ান্ত করবো। ’
এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে সংবিধান সংশোধন কমিটির সদস্য আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক, সাবেক আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু বাংলানিউজকে বলেন, ‘রাজনৈতিক দল ও শ্রেণীপেশার মানুষের কাছ থেকে যে প্রস্তাবগুলো এসেছে, কমিটিতে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করেই প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হবে। কোন বিষয় থাকবে আর কোন্্ বিষয় থাকবে না সে সিদ্ধান্ত আলোচনা করেই নেওয়া হবে। কোনও বিষয়ে কমিটির কারো দ্বিমত থাকলে তারা ‘নোট অব ডিসেন্ট‘ দেবে।
বাংলাদেশ সময় ১৯০০ ঘন্টা, মে ১০, ২০১১