গাছ মানেই উপকারী। এটা এক আপ্ত ধারণা।
নানা কারণে আনা হচ্ছে বিদেশি গাছ, যা পরিবেশের জন্য চরম ক্ষতিকর। বিদেশি গাছে কোনো দেশি পাখি বা প্রাণী বাস করে না। প্রাণীরা গন্ধ শুকেই বুঝতে পারে গাছ দেশি, না বিদেশি। বিদেশি গাছে তারা বংশবৃদ্ধি করে না। ফলে পরিবেশ-ভারসাম্য হারাচ্ছে গোটা বাংলাদেশের আর দশটি শহরের মতো রাজধানী ঢাকা। আশার কথা, ২০১০ সালে আমগাছকে এ দেশের জাতীয় বৃক্ষ ঘোষণা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে দু:খের কথা একথা অনেকেই জানেন না। দেশি গাছের জন্য সরকারি কোনও প্রচারও নেই।
বিদেশি ক্ষতিকর গাছের মধ্যে সবচে বড় উটকো আপদটির নাম ইউক্যালিপটাস। সেইসঙ্গে আছে একাশিয়ার একাধিক প্রজাতি। এরা মাটি থেকে অতিরিক্ত পানি শোষণ করে মরুময়তার সৃষ্টি করে। সেই সাথে উপকারি কীটপতঙ্গ ধ্বংস হয় যার ফল ভয়াবহ বলে জানালেন অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা।
গণপূর্ত বিভাগের আরবরিকালচার বিভাগ থেকে জানা যায়, চন্দ্রিমা উদ্যানের শতকরা ৮০ ভাগ গাছই একাশিয়া। এব্যাপারে অধ্যাপক শর্মা বলেন, ‘আসলে ঢাকা শহরের কোনো উদ্যানই সুপরিকল্পিত নয়। ’
পাখি নিয়ে গবেষণার জন্য অধ্যাপক ড.কাজী জাকের হোসেন জাতিসংঘের পরিবেশ-পদকসহ একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন । পাখি ও বিদেশি গাছ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নির্দিষ্ট প্রাণী নির্দিষ্ট গাছ ছাড়া বসে না। পর্যাপ্ত দেশি গাছ না থাকায় গাছের ওপর নির্ভরশীল পাখি ও বন্যপ্রাণী আসছে না। এতে অনেক প্রজাতির প্রাণীও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ক্রমেই। ’
তিনি জানান, ২০/২২ বছর আগেও ঢাকায় ৩০০ প্রজাতির বানর, ১০০ প্রজাতির কেঁচো ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে শতাধিক প্রজাতির বানরের বিলুপ্তি ঘটেছে। দেশীয় ঘুঘু ছিল চার-পাঁচ প্রজাতির। সেখানে এখন মাত্র দু`একটি প্রজাতির ঘুঘু দেখা যায়। এক সময় দেখা মিলত কারাকুকস্ফা পাখির। কিন্তু এখন আর ঢাকায় এ পাখি দেখা যায় না। কমেছে প্রজাপতির প্রজাতিও। গত কয়েক বছরে শতাধিক প্রজাপতির প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটেছে। যার জন্য বিদেশি গাছ দায়ী।
তিনি বলেন, সরকারি স্লোগান গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচান বদলে দেশি গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচান করা উচিত।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের গবেষক আর আহমেদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের এম কে হোসেনও ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানোর প্রভাব পরীক্ষা করেছেন। তারা দেখেছেন যে, ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানোর ফলে মাটির উর্বরতা ১৫ শতাংশ কমে গেছে। বাষ্পীভবনের হার অত্যন্ত বেশি। মাটির নিচে থাকা পানির ভান্ডার এরা দ্রুত শেষ করে দেয়। ৯২ শতাংশ মানুষ এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানেনই না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে ঢাকায় প্রায় ২ শতাধিক প্রজাতির বিদেশি গাছ রয়েছে। ইউক্যালিপটাস থেকে শুরু করে মানুষের কাছে অতি পরিচিত সেগুন ও রেইন ট্রিও বিদেশি গাছ।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সহিদ আকতার হুসাইন বলেন, ঢাকার স্বাভাবিক পরিবেশের যে অবনতি হচ্ছে, তা বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে।
পরিবেশ রক্ষায় তাই অনেক ক্ষেত্রে কৃত্রিম উপায় ব্যবহার করা হচ্ছে। আনা হচ্ছে বিদেশি গাছ যা দেশীয় প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করছে। আর গাছপালা না থাকায় নেই বন্যপ্রাণীও।
এ ব্যাপারে উদ্ভিদবিজ্ঞানী অধ্যাপক এ কে এম নজরুল ইসলাম জানান, ঢাকা শহরের রাস্তা, অ্যাভিনিউ, পার্ক সব জায়গাতেই বিদেশি গাছ দেখা যায়।
ঢাকায় বনজ গাছের তুলনায় বিদেশি গাছের সংখ্যা বেশি। এর মধ্যে ইউক্যালিপটাস, কেকারান্দা, লংগু, রয়্যাল পাম, মেহগনি, শিশু, আফ্রিকান টিউলিপ, আপসাইড ডাউন ট্রি, সিলভার ওক, ব্রেডফ্রন্ট ট্রি ও ইপিল ইপিলসহ প্রায় ২শ` প্রজাতির বিদেশি গাছ রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড.রমিজউদ্দিন মিয়া জানান, বিদেশি গাছের পাশে দেশি গাছ বংশ বৃদ্ধি করতে পারে না। কারণ বিদেশি গাছের মূল থেকে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ বের হয় যা দেশি গাছের জন্য ক্ষতিকর।
এছাড়া এদেশের পশু-পাখি বিদেশি গাছের ফুল-ফলও গ্রহণ করে না। উপকারি কীটপতঙ্গও মরে যায়। যা গাছের জন্য ভয়াবহ । এর প্রভাব একসময় পুরো মানব সমাজের উপর পড়বে বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেনের মতে, পলিনেটর নামের এক ধরনের জিন-ফ্লু গাছকে সমন্বিত রাখে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পলিনেটর কমে যাওয়ায় গাছ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
গাছের প্রজাতির সংখ্যা তুলনামূলক হারে ঠিক থাকলেও প্রতিনিধিত্বকারী সংখ্যা কমছে। অনেক ক্ষেত্রে গাছ শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। এতে বহু প্রজাতির গাছ বিলুপ্তির পথে চলেছে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন‘র ( পবা ) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, আমরা দেশি গাছ লাগানোর জন্য প্রচার চালাই। কিন্তু নানা কারণে বিদেশি গাছের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। সরকারিভাবে এ ব্যাপারটাকে সামনে আনা উচিত।
বাংলাদেশ সময়:২২৩৩ঘণ্টা, মে ২১, ২০১১