ঢাকা, বুধবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

বেসরকারি কলেজে ভর্তি বাণিজ্য

মাজেদুল নয়ন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩৪ ঘণ্টা, জুলাই ৪, ২০১১
বেসরকারি কলেজে ভর্তি বাণিজ্য

ঢাকা: বেসরকারি কলেজগুলো লাগামহীনভাবে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তির ফি নিচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন কলেজ ঘুরে দেখা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত ভর্তি ফি ৫ হাজার টাকার নিয়ম মানছে না কেউ।



অভিভাবকদের অভিযোগ, বেসরকারি কলেজগুলো প্রতিবছর উন্নয়ন ও অন্যান্য খাত ধরে অতিরিক্ত ফি আদায় করলেও সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কিছু কলেজ আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন আর বাড়তি সুযোগ-সুবিধা প্রদানের আশ্বাস দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা।

গত বছরের মতো এবারও একাদশ শ্রেণীর ভর্তি নীতিমালায় বলা হয়েছে, কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে বোর্ড নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত ফি নিলে পাঠদানের অনুমতি, স্বীকৃতি ও এমপিও বাতিল করা হবে।

পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কলেজের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভর্তির প্রক্রিয়া চলছে প্রতিটি কলেজে। কোনো কোনো কলেজে চলছে বিলম্ব ফি দিয়ে ভর্তির কার্যক্রম। গত দুদিন বিভিন্ন কলেজে ভর্তি কার্যক্রম অনুসন্ধান করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

ভর্তি নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে, ভর্তিচ্ছু প্রার্থীদের কাছ থেকে ভর্তির আবেদন ফরমের মূল্য এবং ভর্তি ব্যবস্থাপনা ব্যয় নির্বাহের জন্য ৮০ টাকা নেওয়া যাবে।

এছাড়া ভর্তির সময় রেজিস্ট্রেশন ফি ১০০, ক্রীড়া ফি ৩০, রোভার স্কাউট/গার্লস গাইড ফি ১৫, রেড ক্রিসেন্ট ফি ১৫, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফি ৭, শাখা পরিবর্তন ফি ২৫ টাকা নেওয়া করা যাবে। তবে কোনো শিক্ষার্থীর পাঠ বিরতি থাকলে এবং বিলম্বে ভর্তি হলে তার কাছ থেকে পাঠ বিরতি ফি ১০০ টাকা ও বিলম্ব ফি ৫০ টাকা নেওয়া যাবে।

নীতিমালায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে উন্নয়ন বা ডোনেশন ফিসহ সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা ভর্তি ফি নিতে পারবে একটি প্রতিষ্ঠান।

এছাড়াও বোর্ডের পূর্বানুমতি ছাড়া নির্ধারিত আসনসংখ্যার অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করা যাবে না বলেও এবারের নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু রাজধানীর মতো বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে অবস্থিত প্রধান কলেজ, এমনকি জেলা ও উপজেলা শহরে অবস্থিত কলেজগুলোতেও বিধিমালা লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের খবর পাওয়া গেছে।

রাজধানীর ধানম-ি আইডিয়াল কলেজে মোট ভর্তি ফি ধরা হয়েছে ৮ হাজার ১৬০ টাকা। এর মধ্যে শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ফি ধরা হয়েছে ২০০ টাকা। বোর্ডের জন্যে ২৫ টাকা, পকেট ব্যাগ ৫০ টাকা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ১০০ টাকা, খেলায় ১০০ টাকা, পরিচয়পত্রে ১০০ টাকা, ভর্তি ফি ৯০০ টাকা।

কলেজ উন্নয়ন দুই হাজার ৭০০ টাকা নিলেও বাথরুম ও কমনরুমের জন্যে ৮০০ টাকা এবং রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের ৭০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রশংসাপত্র ২০০ টাকা, কলেজ মার্কশিট ২০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া আরও কয়েকটি খাতে টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে যেগুলোকে ভর্তিচ্ছুরা অস্বাভাবিক মনে করছে। কলেজটিতে বিজ্ঞান শাখায় ৫০০, ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় এক হাজার এবং মানবিকে ২০০ শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে।

এই কলেজে ছেলের জন্যে ভর্তি ফর্ম নিতে এসেছেন নিয়ামুল হক। সরকারি কলেজগুলোতে ভর্তি হওয়া কঠিন। অন্যদিকে, বেসরকারি কলেজগুলোর টাকা আদায় দেখে মনে হচ্ছে তাদের চা খাওয়ার টাকাও শিক্ষার্থীদের থেকে নিচ্ছে।

প্রায় প্রতিটি বেসরকারি কলেজই এ ধরনের খাত ধরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণীর ভর্তি নির্দেশিকায় কলেজটিতে ভর্তির জন্য প্রায় সাড়ে ১১ হাজার টাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে ভর্তি ফি ৬০০ টাকা, বোর্ড রেজিস্ট্রেশন ফি ১৬২ টাকা, বার্ষিক সেশনচার্জ তিন হাজার টাকা, ডায়েরি-সিলেবাস-বর্ষপঞ্জি বাবদ ২০০ টাকা, এককালীন উন্নয়ন ফি ৫ হাজার টাকা, জামানত ১০০ টাকা যার ৫০ শতাংশ ফেরতযোগ্য, রোভার ও গার্লস গাইড ফি ৩৭ টাকা, নবীনবরণ ও বিদায় অনুষ্ঠান ৪০০ টাকা ও বেতন (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এক হাজার ৮০০ টাকাসহ মোট ১১ হাজার ২৯৯ টাকা। এর বাইরে গবেষণা ফি ও কম্পিউটার ফি ৫০০ টাকা।

ভর্তিতে অতিরিক্ত ফি সম্পর্কে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির প্রধান অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম বলেন, সরকার তাদের নীতিমালায় সরকারি অংশের ফি উল্লেখ করেছে। বেসরকারি অংশ কলেজের গভর্নিং বডি ফি নির্ধারণ করে। গত বছরও এ পরিমাণ টাকা নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, কলেজের বিভিন্ন বিল (বিদ্যুৎ, গ্যাস ইত্যাদি) দিতে হয়। এগুলো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় গভর্নিং বডি সিদ্ধান্ত নিয়েই এই ফি নির্ধারণ করেছে বলে জানান তিনি।

জানা যায়, ভিকারুন্নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি হতে একজন অভিভাবককে তার সন্তানের জন্য দিতে হচ্ছে শাখা ভেদে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা।

ভিকারুন্নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হোসনে আরাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, তার কলেজে শাখা ভেদে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা লাগছে। উন্নয়ন ফি ৫ হাজার। তার প্রতিষ্ঠানে অনেক শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত নন। তাদের বেতন ভাতার জন্যই একটু বেশি ফি নিতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এছাড়াও রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে বাংলা ও ইংরেজি শাখায় ভর্তির জন্যে প্রতি শিক্ষার্থীকে দিতে হচ্ছে ১১ হাজার ও ১৪ হাজার টাকা। অভিভাবকদের অভিযোগ, ইচ্ছামতো খাত বানিয়ে হাজার হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে। সিটি কলেজে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তির জন্য প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে দিতে হচ্ছে ১৭ থেকে ১৮ হাজার, মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে ১০ হাজার, তেজগাঁও কলেজে ৯ হাজার ২০০, খিলগাঁওয়ের কোয়ালিটি এডুকেশন কলেজে ৯ হাজার ৯০০, মগবাজারে অবস্থিত নাশনাল ব্যাংক পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি হতে প্রতি শিক্ষার্থীকে গুনতে হচ্ছে ৯ হাজার ৪০০ টাকা করে।

এছাড়াও ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা কমার্স কলেজে ভর্তি হতে একজন ভর্তিচ্ছুকে গুনতে হচ্ছে প্রায় ২০ হাজার টাকা। আইডিয়াল কমার্স কলেজে ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় ১৪ হাজার এবং বিজ্ঞানে প্রায় ১৬ হাজার টাকা লাগছে।

বেসরকারি কলেজগুলোর এই লাগামহীন ভর্তি ফির ব্যাপারে যুগ্ম-সচিব (কলেজ) মুফিজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, সরকারি নীতিমালায় উল্লিখিত টাকার অতিরিক্ত কেউ নিতে পারবে না। এছাড়া গভর্নিং বডি কোনো ফি ধার্য করতে পারে না। কোন কলেজ নীতিমালায় উল্লিখিত টাকার বেশি ফি নিলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, সরকারি নির্দেশের বাইরে কেউ নয়। কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে মন্ত্রণালয় অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫২ ঘন্টা, জুলাই ০৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।